Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

শিলং ঘোরা

ভ্রমণ বাঙালির কাছে আনন্দ-উৎসব পালন করার মত। করোনা অতিমারী মিটলে আমি আর আমার বর ঘুরতে বের হই বিশ্ব ভালবাসা দিবসের দিনে। ঠিক হল শিলং যাব। বরমশাই আন্তর্জাল খুঁজে বলল, জায়গাটা নাকি খুব খামখেয়ালি; এই মেঘ তো এই রোদ। প্রেমের রং-ও তো খেয়ালি। তখনই অভিমানের মেঘ কালো করে আসে তো তখনই ভালবাসার যত্নে সবকিছু আলো হয়ে যায়। শিলং-এ গিয়ে দেখি যা ভেবেছি তাই। এই শহর নিজেই এক কিশোরী প্রেমিকা, যার মনমেজাজের কোনও ঠিক নেই। শীতের পোশাক পরলে রোদের তাপে তা খুলে ফেলতে হয়। আবার, তার গোঁসা ঘুচলে শীতে কাঁপতে কাঁপতে গায়ে চাদর জড়াতে হয়। তবে আর যাই হোক, এই প্রেয়সী শহর কিন্তু সৌন্দর্যবিলাসীও বটে। চারিদিকে পাইন আর সুপারি বনের বাহার। কত রঙের ফুল চারিদিকে নিজেকে এত সুন্দর করে সাজিয়েছে। এই শহর সাজতেও ভালবাসে। তবে, সবসময় নয় কিন্তু। ঘোর বর্ষায় এই শান্ত স্নিগ্ধ সজ্জা খুলে ফেলে সে হাজির হয় দুর্দম রূপে। সে যাই হোক, আমরা শুধু তার অপরূপ সুন্দর দিকটাই দেখেছি।

চারিদিকে পাইন আর সুপারি বনের বাহার।

শুরুর দিন আমাদের যাত্রার প্রথম স্থান হল পাইন বন। এখানে চারিদিকে ঘন পাইন গাছ একে অপরের ঘাড় বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাদের ফাঁকে ফাঁকে আলো ঝিকমিক করছে, সঙ্গে খানিক আঁধারও লুকোচুরি খেলছে। এই বনের ক প্রাএন্ত থেকে আরেক প্রান্তে উঁচুনীচু ঢালু সমতল জমিতে গাছগুলো কেমন অভিজ্ঞ জ্ঞানীর মতো অটল, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই জায়গায় এক অদ্ভুত প্রশান্তি আছে। চারিদিক স্থির, নিশ্চুপ, জীবন যেন এক পলকের জন্য থেমে গেছে। মুঠোফোনে ব্যাটারি ফুরিয়ে গেলে আমরা যেমন তা চার্জ করি; ঠিক তেমনই কোনও ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বিধ্বস্ত মানুষ যদি এই বনে চোখ বুজে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে কথা দিচ্ছি অফুরন্ত স্নিগ্ধতা আর অপার আনন্দ সাথে নিয়ে সে ফিরে যাবে। এই আনন্দ হল আদি; সেই সরল পথ যাকে বাঁকাবার শক্তি কারও নেই। একে একপলক ছোঁয়ার আশায় জীবনসুধার প্রতিটা বিন্দু বাজি রাখা যায়।

চারিদিক স্থির, নিশ্চুপ, জীবন যেন এক পলকের জন্য থেমে গেছে।

এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

এই জায়গায় এক অদ্ভুত প্রশান্তি আছে।

যদি খুব সহজভাবে পরিস্থিতিটা বর্ণনা করি তা হল এখানে একটা নদী আছে। এলাকার মানুষজন এর আশেপাশে বেড়ে ওঠা বড় বড় গাছপালার মোটা শিকড়গুলো দিয়ে তার ওপর একটি জীবন্ত সেতু বানিয়েছে। একজন ঋষি বা সন্ন্যাসী যেভাবে তার মাথার চুলগুলোকে ধীরে ধীরে জটায় পরিণত করে, এখানকার মানুষ ঠিক সেইভাবে গাছের শিকড় দিয়ে একটা আস্ত সেতুই গড়ে তুলেছে। আমরা যখন বেড়াতে যাই, নদীটায় অল্প জল ছিল। তাই, রুট ব্রিজ-এর পাশাপাশি তার তলায় হেঁটে চলাটাও উপভোগ করতে ছাড়িনি।

এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রামের খেতাব পেয়েছে গ্রামটি।

এরপর আমরা পৌঁছলাম মৌলিলং গ্রামে। এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রামের খেতাব [১] পেয়েছে এটি। এখানে পৌঁছতে নিজের চোখে দেখলাম পরিচ্ছন্নতা বলতে আসলে কী বোঝায়? গ্রামবাসী প্রচণ্ড পরিবেশবান্ধব। গোটা গ্রামে কোত্থাও প্লাস্টিকের চিহ্ন নেই। আবর্জনা ফেলার জায়গাসুদ্ধ পরিবেশবান্ধব। গ্রামবাসীরা নিজেদের হাতে বাঁশের ঝুড়ি বানিয়ে কিছুটা দূরে গাছের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে। এও দেখলাম এখানে মানুষের থেকে আবর্জনা ফেলার ঝুড়ি বেশি। স্পষ্ট বুঝলাম এরা প্রকৃতির মাঝে নয়, প্রকৃতি এদের মধ্যে বসত করে। চারদিকে বাগান, ফুল-ফলে ভরা। বাগান ঘেরা ছোট্ট ঘর। কী যে নিবিড় শান্তি! এত প্রাচুর্য, এত সমৃদ্ধি আর কৈ আছে? মনে হচ্ছিল যেন কোনও স্বপ্নের আস্তানায় আছি যার সাথে বাইরের দুনিয়ার কোনও মিল নেই। এখানকার বাসিন্দারা তথাকথিত প্রগতিশীল দুনিয়ার চিরাচরিত নিয়মকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রচনা করেছে সম্পূর্ণ আলাদা বিশ্ব। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কাটছিল।

আহ, কী স্বচ্ছ জল। কোনও আড়াল নেই।

এরপর আমরা গেলাম ডাউকি নদী দেখতে। আহ, কী স্বচ্ছ জল। কোনও আড়াল নেই, নেই কোনও মুখোশ। নদী কেমন যেন বেপরোয়া, খোলামেলা অথচ কী গভীর। জলের প্রতিটা রেখা স্পষ্ট। কোনও খুঁত নেই। এক্কেবারে তলা অব্দি দেখা যায়। মানুষের হৃদয়ও যদি এমন স্বাধীন, সাবলীল হোত! প্রকৃতির মাঝে যতই সময় কাটাই, ততই কম মনে হয়। প্রতি মুহূর্তে এই উপলব্ধি হয়– আমরা কত কৃত্রিম, কতই না আবদ্ধ।

জলের প্রতিটা রেখা স্পষ্ট। কোনও খুঁত নেই। এক্কেবারে তলা অব্দি দেখা যায়।

এই নদীর মাঝখানে একটা মস্ত পাথরের চাঁই। তারপরে সিলেট, বাংলাদেশের শুরু। কোনও বেড়া নেই। প্রকৃতি নিজে দাঁড়িয়ে দুই পারের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। সেখানে একটা ছোট মেলার মত বসেছে। ওপার-এপারের মানুষ একসাথে কেনাকাটি করছে। কী অপরূপ শোভা। পরে জানতে পেরেছি এটাও আমাদের দেশের সবচেয়ে পরিস্রুত নদী হিসেবে পরিগণিত হয়। [২]

কী অপরূপ শোভা।

শেষ দিন গেছিলাম ‘বড়াপাণি’-তে। মেঘালয় ঘুরতে গিয়ে এটিই ছিল আমাদের শেষ গন্তব্য। অসাধারণ সুন্দর একটি হ্রদ আছে এখানে। তবে, আমার বেশি করে মন কেড়েছে একে ঘিরে থাকা বাগানটা। খুব মনোরম পরিবেশ। চারপাশে গাছপালা, মাঝে মধ্যে বসার ব্যবস্থা, সাজানো পাথরের রাস্তা। বড়াপাণি হ্রদে ঘোরার জন্য স্পিড বোট-এর বন্দোবস্ত আছে। আমার জীবনে এই প্রথম বোট-এ চড়া। ফলে, উত্তেজনাটা বুঝতেই পারছেন। প্রচণ্ড মজা পেয়েছি। যদিও মনখারাপ ছিল। কারণ এবার বাড়ি ফিরতে হবে।

যদি কখনও মনে হয়, অন্তরাত্মার একটু বিশ্রাম দরকার, ক্লান্ত-বিধ্বস্ত মনটার একটু উপশম প্রয়োজন, সটান চলে আসুন মেঘালয়ে। প্রকৃতির এত অপার প্রাচুর্যের সাক্ষী হবেন যে তার স্মৃতি ভাঙিয়ে অবসর স্নিগ্ধ হয়ে যাবে। এই ব্যস্তময় জীবনের লড়াই-এর জন্য অনেকখানি প্রাণসুধা আপনার পুরো সত্ত্বাকে সুবাসিত করে তুলবে। এখানে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আপনার অনুভূতিকে সুদৃঢ় করবে।

তথ্যসূত্র:
[১] The Cleanest Village in Asia, is in India 🙂 – Ek Titli.Org
[২] https://fb.watch/rAk2V2eLge/

4 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
সংকেত হক
সংকেত হক
1 year ago

বাহ, খুব ভাল লাগলো

Jyotirmoy Dasgupta
Jyotirmoy Dasgupta
1 year ago

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটক ও বাংলাদেশ

ঋত্বিক ঘটকের জীবনের প্রথম বাইশ বছর (১৯২৫-১৯৪৭) কেটেছে মূলত পূর্ব-বাংলায়, যা এখনকার বাংলাদেশ। তাঁর জন্ম ঢাকার ২,ঋষিকেশ দাস রোডের ঝুলন বাড়িতে। ১৯৪৭, অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি মূলত পূর্ব-বাংলায় কাটান। আমরা দেখব, পূর্ব-বাংলা যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে-দেশ, সে-ভূমির প্রভাব তদনুরূপ ঋত্বিকেরও পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে।

Read More »
মণিকর্ণিকা রায়

অনুগল্প: অর্জন

অসহায় বৃদ্ধের খাওয়া হয়ে গেলে মাঝেমাঝে গল্পও করত ওঁর সাথে। আদিত্য লক্ষ্য করেছিল এই ব্যাপারটা যেন তার মনে একটা বদল আনছে— যেন রোজ তার শরীর-মন জুড়ে সঞ্চালিত হচ্ছে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি। যেন সে সত্যিই মানুষ হয়ে উঠছে।

Read More »
মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গা মাঈ কী! জয়!

ঢাকা বা সমগ্র বাংলাদেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজোর চাঁদা আদায়ের চল খুব একটা নেই। মণ্ডপে এসেই পাড়ার লোক চাঁদা দেন। জবরদস্তি করে চাঁদা আদায়ের যে বীভৎসতা কলকাতা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে আছে, তা অন্তত ঢাকা আর বরিশালে দেখিনি। পুজোর দিনেও অনেকে এসে প্যান্ডেলের পাশে চাঁদা আদায়কারীদের টেবিলের সামনে এসে চাঁদা দিয়ে যান। পাড়ার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। স্বেচ্ছায় এসে চাঁদা দিয়ে যান। এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

Read More »