Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

মামলেট

কৃষ্টে আর খ্রিস্টে কোনও তফাত নাইরে ভাই। একথা আমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করি। কিন্তু ওমলেট আর মামলেট এক; একথা স্বয়ং তাঁদের রূপ ধরে এসে কেউ বললেও আমল দেব না। ব‍্যাকরণ হয়তো বলবে এটা শব্দবিপর্যয় কিন্তু আমার মত অনেক বাঙালির কাছে এটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সমতুল্য।

ওমলেট একটা সম্পূর্ণ ব‍্যাকরণমান্য, ব্রেকফাস্টে আবশ্যিক, সুদৃশ্য টেবিলের শোভাবর্ধনকারী, কেতাদুরস্ত আইটেম। কিন্তু মামলেট বাঙালির সকাল থেকে রাত— সব সময়ের ইমোশন। কাঁসার থালায় গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, মুসুরির ডাল, কাঁচা লঙ্কা-পেঁয়াজ দিয়ে মাখা আলুসেদ্ধ আর তার সঙ্গে যদি একটা ডবল ডিমের মামলেট পায়, তবে ঈশ্বরী পাটনীর চাওয়াকে নৈশভোজনে পাঠিয়ে বাঙালি লাঞ্চে যে এদের‌ই শিরোধার্য করবে সেকথা বলাই বাহুল্য।

তবে শুধু লাঞ্চে নয়, বাঙালি ‘মামলেট’-কে কতরকম পদের অধিকার যে দিয়েছে, তা মনে হয় প্রাচীন পারস্যবাসীও যখন প্রথম ওমলেট বানিয়েছিলেন তখন কল্পনাও করতে পারেননি। মামলেট খাওয়ার কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। সকাল, দুপুর, বিকেল, রাত্রি— মামলেটকে মুড়িতে, রুটিতে, ভাতে, চৈনিক নুডলসকে চাউমিন বা ম‍্যাগিতেও স্থান পাইয়ে দিয়েছে বাঙালি, এমনকি পলমিশ্রিত অন্নর অর্থ বদলে দিয়ে মামলেট বানিয়ে সরু চালের ভাতের ওপর মিহি করে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে নবরূপ দিয়েছে।

বাঙালির অতিথি আপ‍্যায়নে, মাসের শেষে পকেটে টান পড়লে, আড্ডায় চায়ের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে ‘মামলেট’-ও ত্রাতার ভূমিকা নিয়ে তার কৃতজ্ঞতার ঋণশোধ করার চেষ্টা চালিয়েছে। এহেন সময়-অসময়ের সঙ্গীকে তাই বাঙালিও ‘শীত গ্রীষ্ম বর্ষা/ সব ঋতুতেই ভরসা’ বলে খাদ্যতালিকায় রেখে দিয়েছে আদর করে।

ওমলেটে সানফ্লাওয়ার অয়েল থেকে শুরু করে বাটার, অলিভ অয়েল লাগলেও বাঙালি তার একান্তই নিজস্ব ‘মামলেট’-কে সরষের তেলের স্নেহচ্ছায়াতেই বাঁচিয়ে রেখেছে। অশুভের নজর এড়াতে নাতি-নাতনিদের ঠাকুমা-দিদিমারা যেমন কাজলের টিপ পরিয়ে কোলঘেঁষা করে রাখেন, আজকের যুগের চিকিৎসকদের কথায় আমল না দিয়েই তেমনি ওমলেটের নজর থেকে পৃথক করতে বাঙালি তার স্নেহস‌ংস্করণ মামলেটকেও জন্মলগ্ন থেকে তার আরেক অত্যন্ত প্রিয় সরষের তেলের জিম্মায় দিয়ে তবেই নিশ্চিন্ত হয়েছে।

আসলে হালফিলের কিছু পরিবার ছাড়া সেকেলে বাঙালির রসনা ও বাসনা চিরকাল‌ই ঠাকুমা, দিদিমা, পিসিমা, মাসিমা, জেঠিমা, কাকিমাদের দ্বারা বেশি পরিচালিত ও পরিবাহিত হত। অনেকের‌ই যেমন কিছু বন্ধুকে দেখে ইচ্ছে থাকলেও তণ্বী হবার বাসনা মাঠে মারা যেত এঁদের একজনের বা কখনও সম্মিলিত অনুরোধ, উপরোধ, শাসন, ভালবাসার কাছে— তেমনি ওমলেট কখনও হাল্কাভাবে চিজ, ক‍্যাপসিকাম, টমেটো, মাশরুমের সঙ্গ উপভোগ করে স্কার্ট পরে স্মার্ট হতে পারলেও অধিকাংশ বাঙালির হেঁশেলে তাকে ‘ধিঙ্গিপনা’ দেখানোর জায়গা এটা নয় বলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে শুধুমাত্র দিদি ও বউদির মত পেঁয়াজ ও কাঁচালঙ্কার সঙ্গেই গভীরভাবে মেশার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অন্য কারও সঙ্গ এক্ষেত্রে ‘স্ট্রিক্টলি প্রহিবিটেড’ করে দেওয়া হয়েছে। তবে এসব দিকে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকলেও ভালবাসার ক্ষেত্রে যেমন বাঙালি কখনও ভাইপো-ভাইজি, ভাগ্না-ভাগ্নিকে আলাদা করেনি, তেমনি ‘মামলেট’-এর ক্ষেত্রেও হাঁস, মুরগি পার্থক্য করেনি। দুপক্ষকেই সমানভাবে সামলেছে।

আরও একটা বিষয়েও বাঙালির বিখ্যাত বৈশিষ্ট‍্য ‘মামলেট’-কে ওমলেট থেকে পৃথক করেছে। সেটা হল বাঙালি একবার যাকে চোখবুজে ভরসা করে পারতপক্ষে তাকে নজরছাড়া করতে চায় না। বিভিন্ন ‌ঋতুতে যেমন দীপুদা-র (দীঘা, পুরী [অনেকে বলেন পুরুলিয়া], দার্জিলিং) ঘর ফাঁকা যায় না, তেমনি মামলেটও শীতকালে গরম ভাতের সাথে, গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা (জল দেওয়া বা বাসি) ভাতের সাথে আর বর্ষাকালে তরলবৎ বা মাখোমাখো খিচুড়ির সাথে পরিবেশিত হয়ে নব নব স্বাদে ও সাজে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বাঙালির কাছে মামাবাড়ি যেমন, মামলেট‌ও অনেকটা তেমন। শয়েকবারের পরেও কখনও পুরনো হয় না, বরং ভাবলে বেশি মজাদার ও আকর্ষণীয়।

‘অমলেট’ আর ‘মামলেট’ জায়গা পেয়েছে বাংলা সাহিত্যেও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তিনসঙ্গী’ গল্পগ্রন্থের ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পে আছে:
‘‘লোকের সঙ্গে মেলামেশা করবার কলাকৌশল সোহিনীর ভালো করেই জানা আছে। মন্মথ চৌধুরী রেবতীর প্রথম দিককার অধ্যাপক। তাঁকে নিলে বশ করে। কিছুদিন চায়ের সঙ্গে রুটিটোস্ট, অমলেট, কখনো বা ইলিশমাছের ডিমের বড় খাইয়ে কথাটা পাড়লে।”
আবার সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘সুকান্ত সমগ্র’ গ্রন্থের পত্রগুচ্ছ-তে ‘মেজ বৌদি’-কে লেখা কবির হাতচিঠিতে রয়েছে:
‘‘… … …
অস্তি বারাণসী নগরে সব ভাল তো? এখানকার সবাই, বিশেষ করে মেজদা ডবল মামলার মামলেট খাওয়া সত্ত্বেও শরীরে ও মেজাজে বেশ শরিফ।…’’

Advertisement

প্রায় সত্তরের দশক থেকে এই ‘মামলেট’-কে অনেক কিছুর পরিত্রাতা হিসেবে বাঙালির আঁকড়ে ধরার প্রবণতা থেকে কিছু মানুষের রুটিরুজির সংস্থানও হয়েছিল। লম্বা গলার অ্যালুমিনিয়াম বা স্টিলের গ্লাসে একটা চামচ দিয়ে একটার পর একটা ডিম ভেঙে সুনিপুণ হাতে একটা সুরের মত তা ফেটিয়ে সাথে গোলগোল করে কাটা কাঁচালঙ্কা আর ছোট চারকোনা শেপে পেঁয়াজ কুচি মিশিয়ে, প্রায় কালচে হয়ে যাওয়া একধরনের হাতাওলা তাওয়ায় তাকে সযত্নে বিছিয়ে দিয়ে মাঝারি আঁচে এই মামলেট বানানো হত। এখনকার নামে যাকে বলে রোডসাইড ফুড স্টল, তখনকার দিনে তার সাথে পাব্লিকের খিদের ডিমান্ড অব ডেপথ্ মেনে পাউরুটি তার যোগ্য সঙ্গত করত।

ওমলেটের এই বঙ্গদেশীয় সংস্করণকে কতিপয় নাকউঁচু বাঙালি ক্লাস-চ‍্যুত খাবার হিসেবে দেখলেও খাদ্য আন্দোলনের শরিক বাঙালির তাতে কিচ্ছুটি এসে যায়নি। বরং সবহারা বাঙালি তার মৌলিক চাহিদার লড়াইয়ে লড়তে লড়তে, এই মামলেট পরিবেশনের (অ্যালুমিনিয়াম, পরে স্টিলের) প্লেটের উন্মুক্ত পরিসরে, ফেলে আসা মাঠ, খেতের কথা মনে করে মুহূর্তের জন্য এক অব‍্যক্ত মনকেমনের স্পর্শে মন হারিয়ে ফেলত। সুদৃশ্য চিনামাটির বোউলে ফেটানো, ননস্টিক তাওয়ায় তৈরি, গোলমরিচের গুঁড়ো ছড়ানো আর টমেটো ও চিলি সস সহযোগে পরিবেশিত ওমলেট খাওয়া এই প্রজন্মের বাঙালির কাছে সেই অনুভূতিকে উপলব্ধি করার উপায় নেই।

এই বিশ্বায়নের দুনিয়ায় সেই মামলেট আজ ব্রাত‍্য, যেমন আজকের মডিউলার কিচেনে বঁটি, শিলনোড়া ব্রাত‍্য। তবে যে বিশ্বাসে প্রথমেই বলেছি, ‘কৃষ্টে আর খ্রিস্টে কোনও তফাত নাই’, সেই বিশ্বাসেই জানি ব্রাত‍্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত কখনওই থেমে যায় না, ঠিক কেউ না কেউ তাকে ড্রিম সিম্ফনি হিসেবে মনে করে।

জনৈক জাহিদ অনিকের কয়েকটি পঙ্‌ক্তি নজরে এল। ‘সময়ের ব্যাপ্তি থেকে এক শ্রাবণ সকাল চেয়ে নিতে চাই/ যে সকালে থাকবে না তাড়াহুড়ো করা ডিমের মামলেট/ কিংবা মোজাবিহীন জুতো’। একজন যখন তাড়াহুড়ো করে বেরনো প্রতিটা সকালের চিহ্ন হিসেবে মোজাবিহীন জুতো আর মামলেটকে ছুটির দিনে পছন্দ করছেন না, তখন আবার ওয়েবসিরিজ ‘RIP Rest In প্রেম’-এর গান ‘টুম্পা সোনা’-য় আরব দে চৌধুরী লিখছেন, ‘চাঁদনী রাতে/ আমি টুম্পার সাথে/ যাব ডিনার ডেটে/ পোচ মামলেট খেতে!’

তাই আশা, ‘মামলেট’-কে বাঙালি শতাংশের বিচারে অনেক কম হলেও একেবারে ছেড়েছুড়ে বৈরাগী হতে পারবে না। খিদে বাড়ানো গন্ধ নিয়ে পরিপাটির অভাব হলেও যারা তাকে পছন্দ করেন, তারা সেভাবেই ভালবেসে গ্রহণ করবেন।

চিত্র : গুগল

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

6 + 18 =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »