Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বলরাম হাড়ি ও লালন: নিপীড়িত মানুষের নেতা ও ত্রাতা

বাংলাদেশের লেখক-বুদ্ধিজীবীরা লালন ফকির ও হাছন রাজার মতো লোকসাধকদের চিনলেও বলরাম হাড়িকে তেমন চেনেন না। তাঁকে না-চেনার কারণ হল, মানুষটি বাস করতেন উনিশ শতকের মেহেরপুর নামক অজপাড়াগাঁয়ের এক দীনহীন অস্পৃশ্য সমাজে। যার জীবনকাহিনিতে বীরত্বের মহিমা নেই, বিত্ত-বৈভবের জৌলুস নেই কিংবা অলৌকিকতার জাদু নেই— এমন এক চালচুলোহীন মানুষকে নিয়ে বাঙালি সমাজ মাতামাতি করে না। উনিশ বা বিশ শতকীয় শিক্ষিত বঙ্গসমাজও বলরাম হাড়িকে নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। লালনের জীবনকাহিনি নিয়ে কবিতা-গান, নাটক-যাত্রাপালা রচিত হলেও বলরাম হাড়িকে নিয়ে উল্লেখ করার মতো কিছুই হয়নি। অথচ তাঁর জীবনকাহিনিতেও নাটকীয়তা ছিল। তাঁকে নিয়েও সিনেমা বা উপন্যাস বানানো যেতে পারত।

এই সাধকের নামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে মেহেরপুরের শৈলেন হালদার নামক এক মৎস্যজীবী এবং তাঁর দীক্ষাগুরু জামাল ফকিরের মাধ্যমে। বলরাম হাড়িকে তাঁরা প্রাণের ঠাকুর হিসেবে মান্য করেন। গানে গানে আরাধনা করেন। প্রতিসন্ধ্যায় মালোপাড়ার বউঝিরা বলরামের মন্দিরে পুজো দেন, ধূপধুনো জ্বালেন, বলরামের উদ্দেশে প্রণাম জানান। কিন্তু শৈলেনের সাফ উচ্চারণ: ‘ফুলে-জলে দেবতার পূজা হয় না। দীপ-ধূপ-নৈবেদ্য লাগে না পূজার দ্বারে।’

অসাধারণ মানুষ শৈলেন হালদার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিংবা কেতাবি লেখাপড়া না থাকলেও বিভিন্ন সাধকের সান্নিধ্য-সাহচর্য পেয়ে অর্জন করেছেন গভীর কাণ্ডজ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। নিজেকে লালন ও বলরামি-ভাবাদর্শের একজন নিষ্ঠাবান-ভক্ত হিসেবে দাবি করতে ভালবাসেন। তিনি জাতে শূদ্র, বৃত্তিতে মালো, সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দু। কিন্তু দীক্ষাগ্রহণ করেন মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত লালনপন্থী ফকির জামাল শাহের কাছে। জামাল ফকিরও জাতাজাতি মানেন না।

বলরাম হাড়ির সাক্ষাৎ-শিষ্য বৃন্দাবন হালদারের মৃত্যুর পর (১৯৮৫) মেহেরপুরের জামাল ফকির ও শৈলেন হালদার এবং বারোখাদার বলরামি সজল দাসরাই মূলত বলরামি তত্ত্বের প্রধান ভাষ্যকার ও প্রচারক। বড় বড় ধর্মের দোর্দণ্ড দাপটের মধ্যে তারাই বলরামি মতাদর্শের দীপশিখাটি জ্বালিয়ে রেখেছেন। আমার নিজের ভেতর প্রশ্ন জাগে, এত ভেদবুদ্ধি, এত জাতপাতের মধ্যে সকলকে নিয়ে বাঁচার তাগিদ বা স্পিরিট মেহেরপুরের শৈলেন-জামাল ফকির কিংবা কুষ্টিয়ার সজল দাসদের মতো ব্রাত্যজনেরা পেলেন কোথায়? এঁদের জীবনচর্যার মধ্যে কি খুঁজে পাওয়া যেতে পারে সত্যিকারের বলরাম হাড়ি ও লালনের মানবিক দর্শনের প্রায়োগিক রূপ? সত্যিই তাই। কেতাবের পাতা থেকে পাওয়া বলরাম হাড়ি কিংবা লালন আর পথে-পথে ঘুরে বেড়ানো প্রান্তজনের জীবনবেদ থেকে পাওয়া বলরাম-লালনের মধ্যে যে বিস্তর তফাত! কেতাবি শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চবর্গের বুদ্ধিজীবীরা হয়তো এমন এক বলরামের কথা বলবেন, যিনি হয়তো রামকৃষ্ণদেবের মতো একজন ধর্মসাধক। কিন্তু নিম্নবর্গের জামাল ফকির-শৈলেন হালদাররা বলেন অন্য এক মানবিক বলরাম, ভিন্ন এক মানবিক লালনের কথা। যাঁরা সবার ওপরে মানুষকেই সত্য বলে জেনেছেন। আমরা যারা কেতাবি শিক্ষায় শিক্ষিত তারা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের ভিক্টোরিয়ান রুচির অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে পাতার পাতা ভরে একটির পর একটি থিসিস রচনা করে চলেছি। বড়মুখ করে বাঙালি জাতীয়তাদের স্ফূরণ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গৌরবগাথা রচনা করে কত যে শ্লাঘা অনুভব করি, তার হিসেব-নিকেশ নেই! অথচ অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে গ্রামবাংলার লোকসাধকদের জাতগোত্রহীন মানবিক ভাবনা থেকে উৎসারিত, তা একবারের জন্যও আমরা ভাবতে পারি না। অজপাড়াগাঁয়ের সাধকরাও যে শত শত বছর ধরে শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে বঞ্চিত-অধিকারহারা মানুষকে বৃক্ষের মতো জাগিয়ে রেখেছেন, এটা আমরা কোনওভাবেই স্বীকার করতেই চাই না। মেহেরপুরের ভৈরবের তীরে জন্ম নেয়া কোনও এক নিভৃতচারী-নিঃসঙ্গ সাধকও যে আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে ব্রিটিশ-কবলিত, জমিদারতন্ত্র শাসিত সমাজে বাস করে ধর্মান্ধতা, শোষণ, নিপীড়ন, উচ্চবর্গের অহমিকার বিরুদ্ধে নিম্নবর্গীয় মানুষকে এককাট্টা করতে পারেন, এটা আমরা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারি না!

হ্যাঁ, আমি মেহেরপুরের বলরাম হাড়ির কথা বলছি। আঠারো শতকের শেষের দিকে মেহেরপুরের মালোপাড়ায় জন্ম নেয়া এক অন্ত্যজ নেতার কথা বলছি। নেতাই বটে! তিনি কোনও সাধক বা সংস্কারক ছিলেন না, মরমি বা মর্মজ্ঞও নন। ছিলেন একেবারেই নিচুতলার মানুষের নেতা। তাঁর সব আবেগ-আকুতি, আচার-আচরণ ছিল গভীরভাবে মানবিক, সর্বতোভাবে ইহজাগতিক। দেব-সাধনার মাধ্যমে পরমার্থিক মুক্তির কথা তিনি কখনও বলেননি, বলতে পছন্দও করতেন না। মাটির মানুষকে ভালবেসে মানব-ভজনার মাধ্যমে বৈষম্যহীন মানবসমাজ গড়ার সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, অনুসারীদের ঠেলে দিয়েছিলেন জমিদার-পুরোহিতবিরোধী সংগ্রামের বিস্তৃত ময়দানে। লালনের মতো তিনিও মানুষতত্ত্বের সাধক ছিলেন। জাতিভেদহীন মানবিকতার অস্ত্র নিয়ে তিনি লড়াই করেছিলেন মূর্তিপূজা, ঘটপূজা, শাস্ত্রশাসন ও বৈদিক মন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাঁর শিষ্যরাও এ থেকে বিচ্ছিন্ন নন।

বলরাম হাড়ির মন্দির, মেহেরপুর, বাংলাদেশ।

বলরামী বা বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের প্রবর্তক বলরাম হাড়ির জন্ম উনিশ শতকের গোড়ায়, আনুমানিক ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে অস্পৃশ্য ‘হাড়ি বংশে’। বাবা গোবিন্দ হাড়ি, মা গৌরমণি। সেকালে হাড়িদের জীবিকা ছিল শুয়োর চরানো, গাছগাছড়ার ওষুধ বিক্রি, লাঠিয়ালগিরি কিংবা বড়লোকদের দারোয়ানগিরি। বলরাম ছিলেন মেহেরপুরের বিখ্যাত ধনী পদ্মলোচন মল্লিকের দারোয়ান। নদীয়া জেলার জমিদারদের যেসব পাইক-বরকন্দাজ ও দারোয়ান ছিলেন তাঁদের মধ্যে বলরাম ছিলেন বেশ শক্তিশালী-সামর্থ্যবান। তির ছোড়ায় ও লাঠিয়ালগিরিতে ছিলেন অতুলনীয়। জমিদার পদ্মলোচন মল্লিকের বাড়িতে পছন্দমতো কাজ পেয়ে বেশ হেসেখেলে দিনকাল কেটে যাচ্ছিল তাঁর। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় জীবনটা তাঁর এলোমেলো হয়ে যায়। রুদ্ধ হয়ে যায় জীবন-জীবিকার পথ। এক রাতে মল্লিকদের গৃহদেবতার সমস্ত অলংকার চুরি হয়ে যায়। সন্দেহ গিয়ে পড়ে বলরামের ওপর। তাকে গাছে বেঁধে প্রচণ্ড প্রহার চলে। শেষপর্যন্ত সকলের পরামর্শে গ্রাম থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় জমিদার-বড়লোকদের প্রতি তাঁর ঘৃণা জন্মাল। হয়ে উঠলেন এক প্রতিবাদী মানুষ।

বলরামের জীবন-কাহিনিটা বেশ নাটকীয়তায় ভরপুর, লালনের সঙ্গে খানিকটা মিলও রয়েছে। ব্রাত্য, মন্ত্রবর্জিত, অভিমানী লালন ফকির একদিন ঘর ছেড়ে, আমাদের সম্ভ্রান্ত সমাজের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। ভদ্র-অভিজাত সমাজে আর ফিরে আসেননি। যে-সমাজ তাঁকে অপাঙ্‌ক্তেয় করে রাখতে চেয়েছিল, সেই সমাজ ছেড়ে বসবাস করেছেন কুষ্টিয়া শহরের বাইরে কালীগঙ্গা তীরবর্তী কুমারখালির ছেঁউড়িয়ার আখড়ায়। কোনও সম্প্রদায়ের বৃত্তে নিজেকে আটকাতে চাননি; কারণ সকল সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে এক স্বপ্নময় রাজ্যে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন। তিনি বক্তৃতা করতেন না, শাস্ত্রপাঠ করে ধর্মের অমৃতকথাও শোনাতেন না। তাঁর একমাত্র সম্বল ছিল গান— কেবলই গান। এই গান দিয়েই তিনি সকলকে মুগ্ধ করে রাখতেন। লালনের মতো বলরাম হাড়ি গান বাঁধতে জানতেন না। তিনিও লালনের মতো গৃহত্যাগ করেন, তবে চিরদিনের জন্য নয়। বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করে তিনি মেহেরপুরে ফিরে এসেছিলেন। তবে জমিদারতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষিত-নিয়ন্ত্রিত ভদ্রসমাজে নয়। তিনি ফিরে আসেন ভিন্ন সাজ-পোশাকে, ভিন্ন রূপে-চেহারায়। উচ্চধর্ম ও উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন বলরামি সম্প্রদায়। সনাতন ধর্মের পরিমণ্ডলের বাইরে ভৈরবের তীরে গড়েন ভিন্নধারার মন্দির। বাউলদের মতো বলরামের অনুসারীরাও শাস্ত্রের প্রাণহীন নিরসতত্ত্ব মেনে নেননি। তাঁর অনুসারীরা ছিলেন হাড়ি, ডোম, বাগদি, মুচি, বেদে, নমঃশূদ্র, মালো এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে মুসলমানও। বাংলার সকল লোকধর্মে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ কিংবা বৈশ্যদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও বলরামী সম্প্রদায়ে উচ্চবর্ণের লোকজন প্রবেশ করতে পারেনি।

বলরামীদের গানে যে-মানবিক ভাবনার স্পিরিট পরিস্ফূট হয়েছে তা বৃহত্তর কুষ্টিয়া-যশোরের লালনিক ধারার বাউলদেরও প্রভাবিত করেছে। লালনের মতো বলরাম হাড়ি ও তাঁর অনুসারীরাও জাতিভেদ মানেন না, এরা মানুষভজনে বিশ্বাসী। এরা কেউ গৃহস্থ, কেউ উদাসীন। বলরামীদের আবির্ভাব মূলত শোষিত-বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনপ্রতিষ্ঠা ও বাঁচার তাগিদে। যেমন, তীতুমীরের বিদ্রোহ, বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে মুণ্ডাদের আন্দোলন, লালনের ফকিরি ধর্ম, হরিচাঁদ ঠাকুরের মতুয়া আন্দোলন, রূপচাঁদ, মনমোহনের আন্দোলন ধর্মীয় মোড়কে উপস্থিত হলেও তা ছিল অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য, শোষিত, নিগৃহীতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

বলরামের অনুসারী ও চ্যালারাও জীবন-জীবিকায় গরিব ক্ষুদ্রচাষি, ভূমিহীন দিনমজুর, অরণ্যচারী, ভবঘুরে ও অচ্ছুত। কিন্তু শুদ্ধ ও নৈতিক জীবনাচরণের দিকে বিশেষ আগ্রহী। সেই সঙ্গে দুর্নিবার, সাহসী ও দুর্বার স্বভাবের। কুষ্টিয়ার বারোখাদা গ্রামের বলরামীরা ছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর এস্টেটের বিস্তৃত জমিদারিতে লেঠেল কিংবা ঠাকুরবাড়ির লেঠেলদের প্রতিদ্বন্দ্বী-লেঠেল ছিলেন ওই হাড়িরামের চ্যালারাই। ‘‘কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত সাময়িকপত্র কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ ঘাঁটলে ঠাকুরবাড়ির লেঠেল বাহিনীর সঙ্গে প্রজাদের লড়াইয়ের বিবরণ মেলে।… একবার খোদ কুষ্টিয়ায় দেবেন্দ্রনাথ বা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেঠেলদের অত্যাচার থেকে গরিব প্রজাদের বাঁচাতে স্বয়ং লালন ফকির তাঁর দলবল নিয়ে লাঠিসোঁটা হাতে বেরিয়ে আসেন আশ্রম ছেড়ে।’’

রবীন্দ্রনাথের একটি গানে আছে: ‘বৃষ্টিনেশা ভরা সন্ধ্যাবেলা/ কোন বলরামের আমি চ্যালা’। এই বলরাম কি পৌরাণিক বলরাম? নাকি মেহেরপুরের অন্ত্যজ নেতা বলরাম হাড়ি? ‘বলরামের চ্যালা’ শব্দটির সঙ্গে উনিশ শতকের গ্রামবাংলার জনজীবন বেশ পরিচিত ছিল। সে কারণে কবিয়াল কুবির গোঁসাই লিখেছেন: ‘বলরামের চ্যালার মতো/ কৃষ্ণকথা লাগে তেতো।’ রবীন্দ্রনাথ হয়তো কুষ্টিয়ার জুগিয়া-বারোখাদা গ্রামের বলরামের চ্যালাদের দুর্নিবার, দুর্বার ও দুর্দম জীবনের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে এ গান রচনা করেছেন। মেহেরপুরের ভৈরব তীরবর্তী বলরামের মন্দিরের কারুময় উদ্ভাস এবং শৈলেন হালদার, জামাল ফকির ও সজল দাসদের সরল-সহজ মুখ কিংবা মেহেরপুরের মালোপাড়া, নদীয়ার নিশ্চিন্তপুরের বিশ্বাসী ভক্তদের স্নিগ্ধ সমাবেশের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কেন এরা বড়লোকদের সমাজ এবং ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন। কেন এরা ডাকাত হয়ে একটি লোকধর্মের সম্প্রদায়ের খেরোখাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, দুশো বছরেরও আগে ‘একজন ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী এদের পরিত্রাণের মন্ত্র এনে দিয়েছেন। রক্তে দিয়েছেন প্রত্যয়। পায়ের তলায় শক্ত মাটি। বেদ বেদান্ত ব্রাহ্মণ শাস্ত্র দলিত মথিত করে গ্রামে গ্রামে বয়ে দেন গুপ্ত প্লাবন। অথচ এরা দীন দরিদ্র দুঃখভারানত।’

আর-পাঁচটা লোকসম্প্রদায়ের সঙ্গে বলরামের চ্যালাদের তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এরা এতই দুর্নিবার, বেপরোয়া, উদ্ধত ও যুক্তিনিষ্ঠ যে দেবদ্বিজে, শাস্ত্র-কেতাবে, ভুতপ্রেত, আলাভোলাই মোটেই বিশ্বাসী নন। এদের কারও কারও রক্তে ডাকাতির নেশাও ছিল। অনেকেই বড়লোক ব্রাহ্মণদের বাড়িতে ডাকাতি করতেন। কিন্তু কেন ডাকাতি করতেন? অভাব-আকালে, নাকি উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার জন্য? জমিদার আর বড়লোক ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে যারা সমাজচ্যুত হয়ে গ্রামছাড়া হন, তারাই আত্মরক্ষার তাগিদে জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গম এলাকা সাফ-সুতরো করে বসতি স্থাপন করেন। তারা সম্ভবত মেহেরপুরের বৃন্দাবন হালদার, জামাল-আরাফাত, শৈলেন হালদার, সজল দাসদের মতো নিচুতলার মানুষগুলোর পূর্বপুরুষ। বলরাম হাড়ি একদিন এই নিপীড়িত-অত্যাচারিত, সমাজচ্যুত-অপমানিত মানুষগুলোর সামনে তুলে ধরেন বাঁচার এক নতুন মন্ত্র, নতুন চেতনা। তাঁর ও তাঁর চ্যালাদের মধ্যেও ভক্তি-বিনয়-বিশ্বাস ছিল, কিন্তু তাতে ধর্মের দাগ ছিল না। হাড়িরাম মূলত পালন করতে চেয়েছিলেন জাতিভেদহীন মানবতাবাদী সহজ ধর্ম। লালনও তাই চেয়েছিলেন। তিনিও অলৌকিকতা ও যুক্তিহীনতায় বিশ্বাস করতেন না। দুই সাধকের মধ্যে খানিকটা পৃথকতাও থাকলেও মিল ছিল ঢের বেশি। ফোঁটা-তিলক, টিকি-টুপি তথা বাহ্যিক কায়কর্মের প্রতি লালনের একদম সমীহ ছিল না। ধর্মের নামে আচার-সর্বস্ব লোকদেখানো ভড়ংবাজিতেও বিশ্বাস রাখতে পারেননি। লালন দ্বিধাহীন ভাষায় সাফ বলে দিয়েছেন: ‘মাটির ঢিবি কাঠের ছবি/ ভূত ভাবে সব দেবাদেবী/ ভোলে না সে এসব রূপি/ ও যে মানুষ রতন চেনে।।/ জিন ফেরেশতার খেলা/ পেঁচাপেঁচি আলাভোলা/ তার নয়ন হয় না ভোলা/ ও যে মানুষ ভজে দিব্যজ্ঞানে।’

মেহেরপুরের বলরাম হাড়ি ও লালন দুজনেই ছিলেন মানবতাবাদী সাধক। দুজনের ধর্মমতের সারকথা অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিক অধ্যাত্মবাদ। দুজনেই মানুষকে ভালবেসে মানুষের জন্য কখনও গান গেয়েছেন, কখনও লাঠিয়ালগিরি করেছেন। জমিদারতন্ত্র ও ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি ভ্রূকুটি করে নির্ভীকচিত্তে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। দুজনেই ছিলেন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায় এবং ধর্মের মিলনসাধক। ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি তাঁদের স্পর্শ করতে পারেনি। বয়সের হেরফের থাকলেও বলরাম হাড়ি (১৮২৫-১৮৯০) ও লালন ফকির (১৭৭৪-১৮৯০) একই সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলার জল-হাওয়ায় পরিপুষ্ট হয়েছেন, দুজনের চিন্তার মধ্যেও রয়েছে যথেষ্ট সাদৃশ্য ও সমরূপতা। তাহলে কি দুই মানবভজনিয়ার মধ্যে কোনও মনোজাগতিক যোগাযোগ ছিল? তাঁরা কি পরস্পরকে চিনতেন!

চিত্র: বলরাম হাড়ির মন্দির, মেহেরপুর, বাংলাদেশ
4.5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
sanjay ghosh
sanjay ghosh
1 year ago

খুব ভালো তথ্য ও যুক্তিপূর্ন লেখা ।

Recent Posts

রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সোমেন চন্দ: এক বহ্নিময় কথাকার

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »