Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

একশো এক কৌরব-কথা

মহাভারত ভারতীয় শিরা-উপশিরাতে জড়িয়ে থাকা মহাকাহিনি, যেখানে অতীত থেকে বর্তমান ভারতবর্ষের একটি সামগ্রিক রূপ ফুটে ওঠে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে মহাভারত হয়ে দাঁড়িয়েছে নিছক কৌরব ও পাণ্ডবদের দ্বন্দ্বের গল্প, আর সেই মহাযুদ্ধের আড়ালে মূল কাহিনি যেন ঢাকা পড়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর একশো সন্তান থাকলেও আমরা দুর্যোধন ও দুঃশাসন ছাড়া বাকি অনেকের নাম পর্যন্ত জানি না। কিন্তু আদতে দুর্যোধনের অন্য ভাইদের সবাই পাণ্ডব-বিদ্বেষী ছিলেন না, এমনকি অনেক ভাই প্রকাশ্যে দুর্যোধনের বিরোধিতা করে তাঁর রোষানলেও পড়েন। অনেকেই পাণ্ডবদের পরমবন্ধু ছিলেন, আবার শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত বলেও পরিচিত ছিলেন অনেকেই। কিন্তু ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক চিত্রের মত প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেও পরে আবার সেই পথ থেকে সরে চলে আসতে হয়, এমনকি ইচ্ছে না থাকলেও শুধু দুর্যোধনের অনুরাগ পাবার জন্যে অনেককে পাণ্ডবদের বিরোধিতা করতে হয়। এই বৈপরীত্যের মধ্যে শত কৌরব ভাইকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়।

বলা হয় কৌরব ভাইদের মধ্যে বিরোধিতা থাকলেও তাঁদের জন্ম ও মৃত্যুর স্থান একই, এমনকি পদ্ধতিও অনেকটা এক। মহাভারত থেকে আমরা জানতে পারি, ভীষ্ম একরকম জোর করেই ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে গান্ধারীর বিয়ে দেন। ভীষ্ম জানতে পারেন গান্ধারীর কাছে শতপুত্রের জননী হওয়ার আর্শীবাদ রয়েছে। এই বিয়ে দেওয়ার জন্যে ভীষ্মকে রক্তক্ষয়ী কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, ভীষ্মের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করবার জন্যে ভীষ্ম তার সৈন্য নিয়ে গান্ধাররাজ সুবল সহ তাঁর উনশতজন পুত্রকে হত্যা করেন, বেঁচে থাকেন শুধুমাত্র সুবল-পুত্র শকুনী। সুবল মারা যাওয়ার সময় শকুনীকে কুরু বংশকে ধ্বংস করবার দায়িত্ব দিয়ে যান। আমরা মহাভারতের পরবর্তী অধ্যায়ে দেখতে পাই এই কুরু বংশের ধ্বংসের একমাত্র নেপথ্যনায়ক সুবল-পুত্র শকুনী।

ব্যাসদেবের আশীর্বাদে এবং ভগবান নারায়ণের ইচ্ছায় পৌরস্তাদি রাক্ষসরা গান্ধারীর গর্ভে সন্তানরূপে আশ্রয় পায়। একরাতে গান্ধারী নিজের গর্ভের থেকে রাক্ষসের মত ভীষণাকৃতি চেহারার কিছু মূর্তি গর্ভের মধ্যে দেখতে পান। সেই সময় যুধিষ্ঠিরের জন্মের কথাও গান্ধারীর কানে আসে। স্বভাবতই ক্ষোভে, দুঃখে, ভয়ে গান্ধারী লোহার দণ্ড দিয়ে নিজের গর্ভে আঘাত করেন। সঙ্গে সঙ্গে শক্ত মাংসখণ্ড শরীর থেকে বেরিয়ে আসে। গান্ধারী এই মাংসপিণ্ড ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ব্যাসদেবের আদেশমত পরে সেই মাংসপিণ্ডকে একশোটি খণ্ডে খণ্ডিত করে প্রতি খণ্ড ঘি ভরা কলসির ভেতরে রেখে দেওয়া হয় এবং গান্ধারীকে দু’বছর পরে সেই কলসিগুলো খুলতে বলা হয়। দু’বছর পরে সেই মুখবাঁধা কলসি থেকে প্রথমে দুর্যোধনের জন্ম হয়, পরে সেখান থেকে একমাস পরে পরে উনশত পুত্র ও এক কন্যার জন্ম হয়। অবশ্য এই শতপুত্র ও এক কন্যা ছাড়াও ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে সৌবলী নামের এক বৈশ্যা দাসীর গর্ভে যুযুৎসু নামে আর-এক সন্তানের জন্ম হয়, মহাভারতের যুদ্ধের পরও ইনি বেঁচে ছিলেন।

ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্র ও এক কন্যার নাম:

১) দুর্যোধন, ২) দুঃশাসন, ৩) দুঃসহ, ৪) দুঃশল, ৫) দুর্মুখ, ৬) দুর্মমুখ, ৭) দুদ্ধর্ষ, ৮) দুষ্কর্ণ, ৯) দুর্ম্মদ, ১০) দুষ্প্রহর্ষ, ১১) দুর্বিরোচন, ১২) দুরাধন, ১৩) বিকর্ণ, ১৪) বিকটানন, ১৫) বিবিৎসু, ১৬) বিবিংশতি, ১৭) জলসন্ধ, ১৮) জরাসন্ধ, ১৯) সত্যসন্ধ, ২০) দৃঢ়সন্ধ, ২১) চিত্রাক্ষ, ২২) সুলোচন, ২৩) দীর্ঘলোচন, ২৪) বিন্দ, ২৫) অনুবিন্দ, ২৬) সুবাহু, ২৭) চিত্রবাহু, ২৮) আয়োবাহু, ২৯) মহাবাহু, ৩০) সহস্রবাহু, ৩১) দীর্ঘবাহু, ৩২) দুষ্প্রধর্ষন, ৩৩) অঙ্গদ, ৩৪) চিত্রতারা, ৩৫) উপচিত্র, ৩৬) চারুচিত্র, ৩৭) সমচিত্র, ৩৮) ঊর্ণনাভ, ৩৯) পদ্মনাভ, ৪০) নন্দচাঁদ, ৪১) উপানন্দ, ৪২) সেনানন্দ, ৪৩) সুষেণ, ৪৪) কুন্তোদর, ৪৫) মহোদর, ৪৬) চিত্রবর্মা, ৪৭) সুকর্মা, ৪৮) রৌদ্রকর্মা, ৪৯) দৃঢ়কর্মা, ৫০) চন্দ্রবর্মা, ৫১) চিত্রচাপ, ৫২) সুকুণ্ডল, ৫৩) ভীমবেগ, ৫৪) ভীমবল, ৫৫) ভীমবিক্রম, ৫৬) ভীমশর, ৫৭) ভীমরথ, ৫৮) বলাকী, ৫৯) উগ্রায়ুধ, ৬০) কনকাসুর, ৬১) দৃঢ়ায়ুধ, ৬২) দৃঢ়ক্ষেত্র, ৬৩) সোমকীর্তি, ৬৪) অনুদর, ৬৫) উগ্রশবা, ৬৬) উগ্রসেন, ৬৭) উগ্রবেগ, ৬৮) বাতবেগ, ৬৯) দৃঢ়রথ, ৭০) অপরাজিত, ৭১) পণ্ডিতক, ৭২) সুবর্চ্চা, ৭৩) দণ্ডীপাল, ৭৪) নাগদত্ত, ৭৫) অগ্রযায়ী, ৭৬) কবচী, ৭৭) আদিত্যকেতু, ৭৮) নিষঙ্গী, ৭৯) ধনুগ্রহ, ৮০) সুহস্ত, ৮১) ক্ষেমমূর্তি, ৮২) বীরবাহু, ৮৩) বীরচাঁদ, ৮৪) আলোলুপ, ৮৫) বিশালক্ষ, ৮৬) দৃঢ়হস্ত, ৮৭) চিত্রক, ৮৮) চণ্ডপাল, ৮৯) কুণ্ডভেদী, ৯০) বীরপাল, ৯১) দণ্ডধারী, ৯২) অভয়চাঁদ, ৯৩) অনাধৃষ্য, ৯৪) ব্যুঢোরু, ৯৫) কনকাঙ্গদ, ৯৬) চিত্রাঙ্গদ, ৯৭) দিনকুণ্ড, ৯৮) কনকধ্বজ, ৯৯) সুকর্ণ এবং ১০০) বিরজা। এক কন্যার নাম দুঃশলা এবং ধৃতরাষ্ট্রের দাসী গর্ভজাত আরেক পুত্রের নাম যুযুৎসু।

দুর্যোধন সহ তাঁর বাকি উনশত ভাই প্রত্যেকেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মারা যান। কিন্তু স্বভাবচরিত্র বিচার করে তাঁদের তিনভাগে ভাগ করা যায়। একভাগ যাঁরা দুর্যোধনের মত পাণ্ডব-বিদ্বেষী, দ্বিতীয়ভাগ যাঁরা ছিলেন পাণ্ডবদের প্রিয়, এই দুই ভাগ ছাড়া তৃতীয় ভাগ ছিলেন বিবিধ, অর্থাৎ এঁরা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা চরিত্র। এঁরা প্রথম দিকে নিজেদের কাজে এবং ধর্মে কর্মে আত্মনিয়োগ করে রেখেছিলেন, পরে শ্রীকৃষ্ণের আদেশ অনুসারে ক্ষাত্রধর্ম পালন করতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।

প্রথম দল অর্থাৎ দুর্যোধনের মত পাণ্ডব-বিদ্বেষী কৌরব ভাইদের মধ্যে দুঃশাসন ছাড়াও দুর্মমুখ, দুদ্ধর্ষ, দুর্ম্মদ, বিকটানন, উগ্রসেন, সেনানন্দ, চিত্রচাপ, ভীমবল, ধনুগ্রহ প্রমুখের নাম করা যায়। এঁদের মধ্যে দুর্ম্মদ, ধনুগ্রহ, উগ্রসেন আলাদা আলাদাভাবে খুব ছোট বয়সে একাধিকবার অর্জুন-হত্যার পরিকল্পনা করেন। ভীমবল ভীমকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। বিকটানন একলব্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন, উদ্দেশ্য হল পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে তাঁকে ব্যবহার করা। সেনানন্দের পরিকল্পনা ও পরম উৎসাহে পাশা খেলা হয়, আবার চিত্রচাপ দৌপদীকে হরণ করবার পরিকল্পনা করেন। অন্যদিকে বিকর্ণ, বিবিৎসু, বিবিংশতি, সুবাহু, সুহস্ত, বিরজা প্রমুখ ভাইরা ছিলেন পাণ্ডবদের পরমবন্ধু। এঁদের অনেকেই পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে দুর্যোধনের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করেন এবং দুর্যোধনের বিরাগভাজন হন। ব্যুঢোরু তো কুরুক্ষেত্রের কয়েকদিন আগেও ভীমের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন। অগ্রযায়ীকে দুর্যোধন অনেকদিন পর্যন্ত কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখেন।

মহাভারত ভারত তথা মানবসমাজের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক পরম্পরার মহা আখ্যান। স্বভাবতই মহাভারতের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে দলাদলি থাকবে না সেটা অস্বাভাবিক ঘটনা হবে। তবে সিংহাসন নিয়ে পাণ্ডব-কৌরবদের যেমন বিরোধ বাধে, তেমনই কৌরব ভাইদের মধ্যেও বিরোধ বাধে। দুর্যোধনের যুবরাজের মর্যাদা লাভ তাঁর নিজের ভাইদের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। বিশেষ করে জরাসন্ধ কৌরবভ্রাতা দুর্যোধনের সিংহাসনে আরোহণের ঘটনার এমন বিরোধিতা করেন যে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। দুর্যোধনের যুবরাজ হওয়ার বিরোধিতা করেন পদ্মনাভ ও দৃঢ়কর্মা। দুর্যোধনের ইচ্ছেতে শকুনীকে বন্দি করা হলে বিকর্ণ তার সমালোচনার পাশাপাশি সরাসরি দুর্যোধনের বিরোধিতা করেন।

কৌরব ভাইদের অনেকেই প্রজাবৎসল ছিলেন। অনেকেই নিজের দেশের বাসিন্দাদের জন্যে অনেক জনহিতকর কাজ করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে আমরা প্রথমেই বিকর্ণের নাম জানতে পারি। আর-এক কৌরব ভাই ঊর্ণনাভ প্রজাদের মঙ্গলের জন্যে কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টিপাতের ব্যবস্থা করেন। প্রজাপ্রীতি ছিল নন্দচাঁদেরও, তিনি প্রথম হস্তিনাপুরে চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই চিকিৎসালয়ে দূর দূর থেকে চিকিৎসকেরা এসে হস্তিনাপুর থেকে প্রজাদের চিকিৎসা করতেন। আবার কৌরব ভাই উপচিত্র হস্তিনাপুরে আর-্এক চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সুহস্ত নগরোন্নয়নের জন্যে বিভিন্ন রকমের পরিকল্পনা করবার পাশে প্রচুর দানধ্যান করতেন। অন্য আর-একজন প্রজাদরদী কৌরব ভাই ছিলেন ভীমরথ। বিবিংশতি নামের এক ভাই প্রজাদের বাঁচাতে হস্তিনাপুরের কাছাকাছি এক গ্রামে সিংহ ঢুকে পড়লে নিজের জীবন তুচ্ছ করে সেই সিংহকে মারতে চলে যান। পদ্মনাভ প্রজাদের জন্যে সরোবর খনন করেন।

তবে কৌরব ভাইদের সবাই অবশ্য প্রজাবৎসল ছিলেন না, অনেকেই নারীলোভী, কামাতুর ছিলেন। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই দুঃশলের নাম করতে হয়। দুঃশল নিজের মেয়ের প্রতি কামাতুর হয়ে পড়েন। এছাড়া দুর্মমুখ, দুদ্ধর্ষ, উগ্রায়ুধ প্রমুখ নারীলোভী কৌরব ভাইদের অত্যাচারে হস্তিনাপুরের মেয়ে-বউরা অতিষ্ঠ ছিলেন। প্রায়ই প্রজাদের পক্ষ থেকে দুর্যোধনের কাছে তাঁর ভাইদের বিরুদ্ধে নালিশ জানানো হত। কিন্তু এই ভাইয়েরা প্রত্যেকেই ছিলেন দুর্যোধনের অত্যন্ত প্রিয়, তাই দুর্যোধন প্রজাদের কথাতে কোনও গুরুত্ব দিতেন না। স্বভাবতই দুর্যোধন সহ তাঁর বাকি ভাইদের ব্যবহার জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। দুর্যোধনের কোনও কোনও ভাই আবার অন্য ভাইয়ের স্ত্রীদের সঙ্গেও জোর করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। কেউ কেউ আবার দ্রৌপদীর দিকেও হাত বাড়ান। যেমন দৃঢ়সন্ধ, তিনি হঠাৎ দ্রৌপদীকে প্রেমপত্র লেখেন এবং দ্রৌপদীর কাছে চরম অপমানিত হন।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে গুরুপত্নী ও গুরুকন্যাদের নিজ মাতা ও নিজ ভগিনীরূপে ভাববার ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু কৌরব ভাইদের অনেকে গুরুপত্নী বা গুরুকন্যাদের প্রেম নিবেদন করেন। যেমন কৌরব ভাই সুকুণ্ডল তাঁর গুরুকন্যাকে বিয়ে করেন, অপর ভাই অনাধৃষ্য গুরুকন্যাকে হরণ করে নিয়ে চলে যান।

বেশ কয়েকজন কৌরব ভাই ছিলেন নিজ বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল ও স্বতন্ত্র। যেমন কৌরব ভাই জলসন্ধের খুব দেশভ্রমণের নেশা ছিল। তিনি আবার পরম ব্রহ্মজ্ঞানীও ছিলেন। কৌরব ভাইয়ের মধ্যে সব থেকে পণ্ডিত ছিলন সত্যসন্ধ। চিত্রতারার পুত্র জন্মানোর পরেই মারা যায়, বাকি জীবন চিত্রতারা এই শোক নিয়েই বেঁচে থাকেন।

কৌরব ভাদের মধ্যে অপরাজিত থাকতেন মামা শকুনীর বাড়িতে ও শকুনী-পত্নী আর্শি তাঁকে নিজের সন্তানের মত স্নেহ করতেন। কৌরবভ্রাতা আলোলুপ ছিলেন বামন, কিন্তু মজার ব্যাপার হল চোল রাজার যে তিনকন্যার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় সেই তিনজনও ছিলেন বামন। একানব্বইতম ভাই দণ্ডধারী ছিলেন কুষ্ঠ রুগি, তবে তাঁর স্ত্রী শিলাবতী পরমযত্নে তাঁর সেবা করে অসুখ থেকে তাঁকে মুক্তি দেন। শিলাবতী ও দণ্ডধারী দুজনেই সংখ্যাতত্ত্ব বিশারদ ছিলেন।

দুর্যোধন সহ অন্যান্য কৌরব ভাইদের অনেকেই শ্রীকৃষ্ণ-বিদ্বেষী থাকলেও একমাত্র কনকাঙ্গদ ছিলেন চরম নাস্তিক। কনকাঙ্গদ ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না, পুরাণকে বলতেন আজগুবি। তবে কনকাঙ্গদ ছাড়া বাকি সবাই আস্তিক ছিলেন বলে জানা যায়। কেউ কেউ কালীভক্ত ছিলেন, যেমন ক্ষেমমূর্তি। আবার চিত্রাক্ষ শবসাধনা করতেন। দীর্ঘলোচন প্রেতনিধন যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন।

কৌরব ভাইদের অনেকেরই চরম দম্ভ ছিল। এই দম্ভ ও অহংকারের জন্যে তাঁরা কেউ গান্ধারীকেও মানুষ বলে মনে করতেন না। গান্ধারী দুর্যোধন সহ অন্য সবাইকে এক ভাতৃঘাতী লড়াই থেকে নিজেদের সংযত করে সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকবার কথা বলেন। যদিও দুর্যোধন সহ তাঁর ভাইরা এই সব কথার কোনও গুরুত্ব দেননি। সবচেয়ে মাতৃভক্ত ছিলেন বিরজা।

কিছু ভাল গুণ প্রজাবাৎসল্য কোনও কোনও কৌরব ভাইয়ের মধ্যে থাকলেও একশো কৌরব ভাইয়ের সবার পতন হয় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। বেঁচে থাকেন একমাত্র যুযুৎসু। তিনি যুদ্ধের শেষে ধৃতরাষ্ট্র ও যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে কৌরবদের বিধবা ও তাঁদের পুত্রকন্যাদের দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

মহাভারত ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এখানে পঞ্চপাণ্ডব যেমন পুরুষের পাঁচটি গুণকে রূপকের আশ্রয়ে বর্ণনা করে, তেমনই কৌরব ভাইরা প্রতিবেশীদের ইঙ্গিত করে আর যুদ্ধ আমাদের নিজস্ব দ্বন্দ্ব।

চিত্রণ: মুনির হোসেন
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »