বিলাপ
অভিসার
জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল
নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে
শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল
লজ্জা আমার আবির হয়ে ছড়িয়ে আছে জলে
লজ্জাহীনা বলুক লোকে, বলুক কটু কথা
মিথ্যে মিথ্যি জল আনতে যাওয়ার নামে ছল
উত্তেজনায় শিউরে উঠি লজ্জাবতী লতা
গোপন অভিসারের জ্বালায় জ্বলছি অবিরল
গোধূলির এই লগ্নে আমি বিবশ ও বিমনা
প্রত্যেক দিন হই রে সখী, বিষাদে বিকল
জল আনতে যাওয়ার নামে তাই তো প্রতারণা
জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল
আকাশ ডোবে অন্ধকারে, তারারা উজ্জ্বল
এখন সময় অভিসারের, শান্ত প্রেমিকেরা
ভিড় করেছে আমায় ঘিরে, বেঁধেছে সব দল
উচ্ছলতার শেষে অবসন্ন ঘরে ফেরা
জানতে চাস কি সখী আমার প্রণয়ীদের নাম?
চাঁদ তারা আর নদীর তীরে নাম না-জানা ফুল
নরম বালির আদর স্নেহে জড়ানো বিশ্রাম
পাখির ডাকে প্রেমের চিহ্ন চিনতে না হয় ভুল
ফিরলে ঘরে আবার তো সেই রোজের ঘানি টানা
গোপন প্রেমের স্বাদ ছাড়া কি বাঁচতে পারি বল!
তুই ছাড়া আর সবার কাছে থাক এরা অজানা
জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল।
*
পাপ করেছি
পাপ করেছি জানিস সখী পাপ করেছি পাপ
গভীর রাতের অতিথিরা ঘাঁটছে এসে আমার শরীর
বাধা যে দিই বললে হবে সত্য অপলাপ
তলিয়ে যাচ্ছি গহীন হ্রদে, জল এখানে অনেক গভীর
আসছে যে কেউ জানতে পারি কলিংবেলের আর্তনাদে
লোলুপ চোখে ফসফরাসের দীপ্তি জ্বেলে ডাকছে তারা
ডুব দিতে চায় দেহের হ্রদে, কোমল মধুর বিছানাতে
আমার শরীর আহ্বানে দেয় অভিনয়ের নকল সাড়া
সব প্রেমেরই বিয়ে তো নয় বেলাশেষের পরিণতি
শরীর তবু শরীর খোঁজে, ঘি পেতে চায় আগুন আভা
ভালোবেসে শরীর দিলে কীইবা এমন ভীষণ ক্ষতি
শরীর শুচি না অশুচি এসব নিয়ে মিথ্যে ভাবা
শুচিতা তো লুকিয়ে আছে মনের কোনো গহিন কোণে
পাপ করেছি বলে কেন বিলাপ করে মরছি তবে
আমার এটা অন্য ব্যাপার, শরীর খুলি প্রয়োজনে
আস্তে আস্তে বলছি সবই, ধৈর্য ধরে শুনতে হবে
গরিব হয়ে বাঁচার থেকে মুক্তি চাওয়া অন্যায় নয়
বেকার প্রেমিক, মাতাল স্বামীর সঙ্গে করি প্রতারণা
হোক না শরীর স্বেচ্ছাচারী, ঘুচিয়ে ফেলি মন থেকে ভয়
একটু একটু বিষাদ থাকুক, মেঘলা দিনে হই বিমনা
উঁচিয়ে আছে সঙিন হয়ে সমুন্নত শঙ্খগিরি
স্তম্ভযুগল, পরিখা আর অরণ্যরা সেজেই থাকে
অন্যভাবে দেখলে শিখরচূড়ায় ওঠার এরাই সিঁড়ি
ঘষে মেজে যত্নে রাখি, ভুলেই থাকি সব ব্যথাকে
গরম সমাজ কন্যা বলে আজ আমাকে সবাই চেনে
এই তো আমি চেয়েছিলাম, চাইনি হতে নিষ্ঠাবতী
বিজ্ঞাপনে মুখ দেখালে সব ক্রেতারাই পণ্য কেনে
মন্থরতা ঝেড়ে ফেলে জীবনকে দিই জেটের গতি
যশ খ্যাতি আর অর্থ সবই আজ এই দুই হাতের মুঠোয়
আমার দেহে ডুবল যারা সবাই সম্মানিত পুরুষ
আমিই একা কলঙ্কিনী, কাদা আমার জামায় জুতোয়
টাকার যজ্ঞে শুদ্ধ হব, বল না কাকে দিই কত ঘুষ!
*
আমি যাই
জঙ্গলে চিৎকার করে ডাকে ধূধূ হাওয়া
আমি যাই
ঝরা ফুলে ছেয়ে আছে স্বপ্নের বাগান
আমি যাই
নিষিদ্ধ নারীর গালে কোমল শিশির
আমি যাই
জ্যোৎস্নার পালকে মোড়া আদুরি পৃথিবী
আমি যাই
আকাশে তারারা যায় শবানুগমনে
আমি যাই
উদাস সঙ্গম বাকি, তবু যেতে হবে
আমি যাই
ফেরির জাহাজে চড়ে গোধূলি এসেছে
আমি যাই
আকাশের নিচে খেলা ভেঙেছে তুফান
আমি যাই
*
মাধুকরী
আকাশে জ্বলে দারুণ রোদ, বাতাসে খরতাপ
ভিখারী কাঁটা ছড়ানো পথে, পুরুষ বা সে নারী
শরীরে তার দারিদ্র্যের একই মলিন ছাপ
হাতছানিতে পণ্য ডাকে দোকানে মনোহারী
রাজপ্রাসাদে সুসজ্জিত রাজা ও প্রজা দল
মিনতি ঢেলে বলেন রাজা, ‘আমাকে দিন ভোট
নির্বাচনে’, প্রজারা জানে রাজার যত ছল
সকলে বলে, ‘ডিএ বাড়ান’, সকলে একজোট।
এই গুচ্ছে কবির নিমগ্ন রোমান্টিকতা আমাদের স্পর্শ করেছে যেই, তখনি শেষ লেখাটিতে তিনি বুঝিয়ে দিলেন দিনাতিপাতের চাওয়া-পাওয়াও তাকে স্পর্শ করে। এই অকস্মাৎ বিনির্মাণ এক আশ্চর্য অনুভুতির মধ্যে পাঠককে দাঁড় করায়। কবি কখনো তাঁর কবিতায় যৌবনের উজ্জ্বল আলোকিত সময়টিকে দূরে রাখেন না; ছুঁয়ে আছেন আছেন বলেই গত শতকের সাতের দশকের উজ্জ্বলতা ঝলসে ওঠে আজও তাঁর পংক্তিতে। কোথায় যেন কে আবার নতুন করে বলে ওঠে, “তোমার সঙ্গে পাপ করেছি সেই তো আমার পুণ্য”