কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানীর পাশাপাশি স্বপ্ননগরীও। এই স্বপ্ননগরীর পূর্বদিকে একটা বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট জলাভূমি এলাকা যা পূর্ব কলকাতা জলাভূমি (East Kolkata Wetlands) নামে পরিচিত। এর ব্যাপ্তি কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মোট ১২৫ বর্গকিলোমিটার জুড়ে। লবণাক্ত জলের বিল, নোনা জমি, নিকাশি ফার্ম ও স্থায়ী পুকুর বেষ্টিত এলাকাটি মূলত কলকাতার নিকাশিক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এখানে বেশ কিছু ভেড়িও রয়েছে, যেখানে মাছ চাষ করা হয়। এছাড়াও রয়েছে বিস্তৃত জমি যেখানে শাক-সবজি চাষ করা হয়।
প্রচলিত আছে, ‘ময়দান’-কে যদি কলকাতার ফুসফুস বলা হয়, তাহলে পূর্ব কলকাতা জলাভূমির এই সুবিস্তৃত এলাকা হল কলকাতার কিডনি। কারণ স্থানীয় জেলে এবং কৃষকদের দ্বারা পরিকল্পিত এই জলাভূমিগুলি মূলত কলকাতা শহরের প্রাকৃতিক নিকাশি শোধনাগার হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও জলাভূমিটি প্রাকৃতিক জলশোষক হিসাবেও কাজ করে অর্থাৎ মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টির জল শোষণ করে এবং শহরের দূষণ প্রতিরোধে সামান্য হলেও সহায়তা করে।
১৯৯১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এক অনাবাসী ভারতীয়ের একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে একটি বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র নির্মাণের জন্য এবং সেই উদ্দেশ্যে ২২৭ একর জলাভূমি বরাদ্দ করে। ফলস্বরূপ, পিপল ইউনাইটেড ফর বেটার লিভিং ইন ক্যালকাটা (পাবলিক) এনজিও কলকাতা হাইকোর্টে জলাভূমিগুলির গুরুত্ব সম্পর্কিত বিষয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে এই মর্মে যে, জলাভূমিগুলি যেমন ছিল তেমনি রেখে দেওয়া উচিত। এই বিষয়ে রায়কে যুগান্তকারী বলে মনে করা হয়। পূর্ব কলকাতা জলাভূমি শুধুমাত্র একটি জলাভূমির সংজ্ঞাই নয়, এর মাধ্যমে জলবায়ুর অবস্থান বজায় রাখা, দূষণ শোষণ করা, জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা ইত্যাদিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের মত দেশ যেখানে নিজেদের অবস্থান পর্যালোচনার মধ্যেই যায়নি, সেখানে আমাদের গবেষণাকারীরা বার বার জোর দিয়েছেন জলাভূমি সংরক্ষণ ও এর কার্যকরী মানগুলির ওপর। ফলস্বরূপ, বিশ্ব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং কঠোর শর্তাবলি আরোপ করা হয় এবং জানানো হয়, ‘পরিবেশবিদদের মতের সঙ্গে একমত না হওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাই না এই প্রেক্ষিতে যে, জলাভূমিগুলি সংরক্ষণ করার প্রয়োজন রয়েছে এবং কোনওরকম হস্তক্ষেপের বা পুনরুদ্ধারের অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।’
১৯৯২ সালে কলকাতা হাইকোর্টের এই রায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার মেনে নেয়। পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকে রামসার কনভেনশনের অধীনে ‘আন্তর্জাতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলাভূমি’ হিসাবে মনোনীত করার আবেদন জানানো হয় যা ২০০২ সালে প্রাপ্ত হয়। অবশেষে, ২০০৬ সালে রাজ্য এবং নাগরিক সমাজের অংশীদারিত্বের প্রতিফলন হিসাবে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি আইন পাস হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও, বছরের পর বছর ধরে এই জলাভূমিগুলি ক্রমাগত দখলের চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমানেও কমবেশি দখল অব্যাহত থাকলেও পূর্ব কলকাতা জলাভূমি স্বহিমায় অবস্থান করছে।
কিন্তু বর্তমানে স্থানীয় শহুরে সংস্থাগুলির ওপর আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত এই পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতে অবৈধভাবে বর্জ্য ফেলা এবং জলাশয় দূষিত করার অভিযোগ রয়েছে। এই বর্জ্য নিষ্পত্তির বিষয়ে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালের (এন জি টি) আদেশ অমান্য করার কারণে সংস্থাগুলিকে শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। জলাভূমিগুলির মধ্যে বিধি লঙ্ঘনের মূল্যায়নের জন্য এনজিটি দ্বারা গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি মোল্লার ভেড়ি সাইটে কঠিন বর্জ্য ফেলা বন্ধ করার জন্য সুপারিশ করেছিল। কমিটির তরফে জানানো হয়েছিল, ‘যেহেতু পূর্ব কলকাতা জলাভূমি একটি রামসার সাইট, সেহেতু মোল্লার ভেড়ি সাইটে কঠিন বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা উচিত। কঠিন বর্জ্য ফেলার জন্য কোনও বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে বের করা উচিত।’
এই পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্ট ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে ‘পিপল ইউনাইটেড ফর বেটার লিভিং ইন কলকাতা’-র দায়ের করা একটি পিটিশনের ভিত্তিতে জলাভূমি এলাকার ১২ হাজার ৫০০ একরের মধ্যে কোনও ভূমির পরিবর্তন নিষিদ্ধ করে এবং এটিকে ‘নো ডেভেলপমেন্ট জোন’ হিসাবে ঘোষণা করে। বর্তমানে ফের বেআইনি জমি ভরাটের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এই জলাভূমিটিকে আলাদা করে চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষিতে জাতীয় পরিবেশ আদালতে জলাভূমির সার্বিক দূষণ সম্পর্কিত একটি মামলা দায়ের করা হয়, যেখানে জলাভূমি এলাকাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার আবেদনও জানানো হয়। সেই মামলার রায়ে সম্প্রতি জাতীয় পরিবেশ আদালত উপযুক্ত সমীক্ষা করে পিলার বসিয়ে সমগ্র পূর্ব কলকাতা জলাভূমি এলাকাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে ঘিরে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
এর আগে মোল্লার ভেড়ির দূষণ প্রসঙ্গে বিধাননগর পুরসভাকে দু’কোটি টাকা জরিমানা করেছিল আদালত। নির্দেশ অনুযায়ী, দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা হিসাবে তিন বছরের মধ্যে মোট ৪০ লক্ষ মেট্রিক টন বর্জ্য সরাতে হবে। কিন্তু, আদালতের অভিযোগ, গত মার্চ থেকে কত পরিমাণ বর্জ্য বায়োমাইনিং করে সরানো হয়েছে তার তথ্য পুরসভা দেয়নি। চার সপ্তাহের মধ্যে সেই তথ্য জানিয়ে হলফনামা দিতে হবে পুরসভাকে, এমনটাই নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আদালতের আরও নির্দেশ, আগামী জুলাইয়ের মধ্যে এই এলাকার সম্পূর্ণ বর্জ্য সরাতে হবে। প্রয়োজনে পরিকাঠামো বাড়াতে হবে। সেইসঙ্গে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী দু’মাসের মধ্যে মোল্লার ভেড়িকে বেড়া দিয়ে ঘিরে দিতে হবে।
এই প্রসঙ্গে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি নিয়ে সার্বিক পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে, এমনটাই হলফনামা আদালতে জমা দিয়েছে রাজ্য। তাদের বক্তব্য, সেই প্রকল্প কার্যকরী করতে ৪০ শতাংশ খরচ বহন করবে রাজ্য। প্রকল্পের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য কেন্দ্রের বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের কাছে পাঠানো হয়েছে বলেই খবর পাওয়া গিয়েছে। মন্ত্রকের আইনজীবীকে আদালতের তরফে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বাকি ৬০ শতাংশ অর্থের জন্য তাদের পরিকল্পনা ও প্রকল্পের ছাড়পত্র সম্পর্কিত বক্তব্য চার সপ্তাহের মধ্যে জানাতে হবে। গত ৩০-এ অক্টোবর এরই পরিপ্রেক্ষিতে যত দ্রুত সম্ভব কাজ শুরু করার নির্দেশও দিয়েছে আদালত। পূর্ব কলকাতার জলাশয়ের ওপর এলাকার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল, প্রচুর পরিমাণে মরসুমি ফসল উৎপাদন হয় এখানে। এই অঞ্চলে প্রান্তিক মানুষদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ এই চাষযোগ্য জমির ওপর নির্ভরশীল। কোনওভাবে পূর্ব কলকাতা জলাশয় বিপর্যয়ের মুখে পড়লে এই পিছিয়েপড়া মানুষদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি এই জলাশয়ের ওপর দাঁড়িয়ে এই বিশাল অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো। এটি কোনওভাবে ভারসাম্য হারালে তো চূড়ান্ত ক্ষতি।