মুখবন্ধ
ভারতে শাস্ত্রীয় নৃত্য হিসেবে যে নৃত্যশৈলীগুলি এলিট ভদ্রবিত্তমহলে সর্বোচ্চ সন্মান অধিকার করে আছে, সেগুলি হল ভরতনাট্যম, কথক, কথাকলি, কুচিপুড়ি, মোহিনীয়াট্টম, মণিপুরী, ওড়িশি, সত্রীয়া। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের মত বিশ্বের দরবারে ভারতের সংস্কৃতির পরিচায়ক এই আটটি শাস্ত্রীয় নৃত্য। এত অবধি পড়লেই পাঠকের মনে যে প্রশ্নগুলি আসা স্বাভাবিক সেগুলি পর্যালোচনা করব।
শাস্ত্রীয় নৃত্য কী? কবে থেকে শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রচলন? কে বা কারা দিলেন এই তকমা? এগুলিই একমাত্র ভারতের নৃত্যসংস্কৃতির পরিচায়ক হবে কেন? কারাই বা ঠিক করলেন এই নাচগুলিকেই বিশ্বের দরবারে ভারতের সাংস্কৃতিক পরিচয় হিসেবে তুলে ধরা হবে?
প্রথমত, শাস্ত্রীয় নৃত্য/ ক্ল্যাসিকাল ডান্স/ ধ্রুপদী নৃত্য এই নাম নিয়ে এখনও কিছু মতামত বা মতপার্থক্য রয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। কেউ কেউ মনে করেন, ক্ল্যাসিকাল শব্দটিতে উপনিবেশের গন্ধ রয়েছে, আবার ক্ল্যাসিকাল বলতে পশ্চিমা ইতিহাসে যেমন একটি যুগকে নির্দেশ করা হয় এখানে নাচের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটা তো নয়, তাই একে শাস্ত্রীয় বা ধ্রুপদী নৃত্য বলাই যথোপযুক্ত হবে। আবার পশ্চিমী ধরনে নির্দিষ্ট যুগ না হলেও বহু প্রাচীনকালের (বৈদিক) সঙ্গে সংযুক্ত; এই মর্মে ক্ল্যাসিকাল ডান্স হিসেবেই এই নৃত্যধারাগুলি অধিক পরিচিত। আবার যেহেতু পশ্চিমী সভ্যতার সামনে ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচায়ক হিসেবে তুলে ধরতে হবে তাই ক্লাসিকাল (ইংরেজি শব্দ) অধিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। যাই হোক ক্লাসিকাল বা শাস্ত্রীয় নৃত্যধারা ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচায়ক হয়ে উঠেছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
শাস্ত্রীয় নৃত্য ও নাট্যশাস্ত্র প্রসঙ্গ
যে নৃত্যগুলির চলন প্রকরণ, মুদ্রা অভিব্যক্তি, সঙ্গীত, বেশভূষা নির্দিষ্ট শাস্ত্রগ্রন্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তাই শাস্ত্রীয় নৃত্য এবং এই শাস্ত্রগ্রন্থটি হল নাট্যশাস্ত্র। যদিও শুধু নাট্যশাস্ত্র নয় প্রতিটি শাস্ত্রীয় নৃত্য যেহেতু অঞ্চলভেদে পৃথক ধারা বহন করে তাই সেই অঞ্চলের অন্য আরও একটি বা দুটি শাস্ত্রগ্রন্থ অনুসারী হয়ে থাকে সেই অঞ্চলের নৃত্যশৈলী। যেমন, ভরতনাট্যম, প্রথম স্বীকৃত শাস্ত্রীয় নৃত্যধারা নাট্যশাস্ত্র ব্যতিরেকে অভিনয়দর্পণ অনুসারী। মোহিনীয়াট্টম নৃত্যের ক্ষেত্রে হস্তলক্ষণদীপিকা, বলরামভারতম, ওড়িশিতে অভিনয়চন্দ্রিকা, নাট্যশাস্ত্র ব্যতিরেকে অন্য শাস্ত্রগ্রন্থ অনুসরণ করে। এই শাস্ত্রগ্রন্থগুলি যেহেতু ভরত নাট্যশাস্ত্রের পরবর্তীকালের রচনা এবং নাট্যশাস্ত্রের সঙ্গে বেশকিছু সাদৃশ্য আছে তাই আকরগ্রন্থের মর্যাদা পাচ্ছে ‘ভরত নাট্যশাস্ত্র’। এ কারণেই মূলগতভাবে সব নৃত্যধারা নাট্যশাস্ত্র অনুসারী হবে এটাই শাস্ত্রীয় নৃত্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার মূল শর্ত। এতে নৃত্যধারার প্রাচীনতার শর্তও পূরণ হয়। এ শর্ত স্বাধীন ভারতে ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘সংগীত নাটক একাডেমী’ দ্বারা ঘোষিত এবং এই শর্তেই আটটি নৃত্য ক্ল্যাসিকাল বা শাস্ত্রীয় নৃত্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। নাট্যশাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করার কারণ কী? এ প্রশ্ন আসতেই পারে।
নাট্যশাস্ত্রের শুরুতেই বলা হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা এই নাট্যবেদ রচনা করছেন ইন্দ্র সহ অন্যান্য দেবতাদের অনুরোধে। বলা হচ্ছে, ত্রেতাযুগে জম্বুদ্বীপ যখন দেবতা, দানব, গন্ধর্ব, রাক্ষস এবং উরগ পূর্ণ হল তখন ইন্দ্র ব্রহ্মার কাছে গেলেন। অনুরোধের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যেহেতু বাকি চারটি বেদচর্চার অধিকার শূদ্রদের নেই তাই তাদের জন্য পঞ্চম একটি বেদ চাই, যা অন্যান্য চারটি বেদের শিক্ষা বহন করবে। এই যে এত ধরনের গোষ্ঠীর কথা বলা হল, তাদের মধ্যেও বেদের অনুশাসন প্রয়োগের আকাঙ্ক্ষা স্পষ্টত নাট্যশাস্ত্র রচনার একটা কারণ। এরপর নাট্য নিয়ে দেবতা আর অসুরদের বিবাদ নাট্যশাস্ত্রেই রয়েছে। এত এত গোষ্ঠী তাদের নিজেদের বিধিনিয়ম দ্বারাই তাদের জীবনজীবিকা চালাত নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে তাদের ওপর দেবতাদের নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা সহজে সম্পন্ন হয়নি সে পুরাণজুড়ে দেবাসুরের কাহিনি প্রমাণ করে। অর্থাৎ এর উদ্দেশ্য অবশ্যই রাজনৈতিক। যাইহোক, এরপর ব্রহ্মা ঋকবেদ থেকে পাঠ, সামবেদ থেকে গান, যজুর্বেদ থেকে অভিনয় এবং অথর্ববেদ থেকে রসসমূহ নিয়ে এবং উপবেদ (আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধর্ববেদ ও স্থাপত্য) থেকে উপাদান নিয়ে সৃষ্টি করলেন নাট্যবেদ। নাট্যবেদ হবে ধর্ম অর্থ আর যশলাভের উপায় ও পরম্পরাগত নীতির সংগ্রহ, ভবিষ্যতের মানুষের সকল কর্মের পথপ্রদর্শক।
এই বক্তব্যের মধ্যেই সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যটি লুকিয়ে আছে। ১) বর্ণপ্রথা অনুসরণ, ২) সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরুষতন্ত্রের প্রতীক, ৩) নাট্যবেদ নামকরণ অর্থাৎ যার নিয়মবিধি অলঙ্ঘনীয়, ৪) ধর্ম অর্থ যশোলাভের উপায় অর্থাৎ একটি কাজের জায়গা তৈরি করা যা থেকে অর্থাগম হবে এবং যশোলাভও হতে পারে। হতে পারে বলছি কারণ, পরের শব্দটি হল পরম্পরাগত নীতি যা নাট্যবেদে সংরক্ষিত তার অনুসারী হলে তবেই যশোলাভ অর্থলাভের উপায় হবে। নীতির প্রশ্নে একটু বিস্তারিত বলা দরকার। কোন নীতি পরম্পরা অনুসরণের কথা বলা হয়েছে? যে নীতি পুরুষতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণপ্রথার বিরোধিতা করবে এমন কোনও নীতি কি অনুসরণ করা যাবে? স্পষ্টতই না, কারণ এই শাস্ত্র তেমন কোনও নীতি নিয়ে তৈরি হয়নি। বৈদিক মতানুযায়ী ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় সমাজের স্বার্থ রক্ষিত হয় এবং মানুষ সেই রীতি মেনে চলে তেমন শিক্ষাই দেবে এই শাস্ত্র। নীতি শাসক বানায় তার শাসন রক্ষার্থে, ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করে রাখতে সেই শাসক বা তৎকালীন দেবতাদের প্রতিপত্তি অক্ষুন্ন রাখতে যে নীতি প্রচলিত তা নাট্যের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে এবং নাট্যকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই নাট্যবেদের প্রচলন।
যুগে যুগে একই নীতি কি প্রচলিত থাকতে পারে? মানুষের সহজ বুদ্ধি বলবে, না। কিন্তু একেবারে গোড়া থেকে যদি বেঁধে দেওয়া যায়, মগজধোলাই করা যায়! এই শাশ্বত, এভাবেই এত হাজার বছর চলে আসছে তখন কিছু ঘাড়ত্যাড়া লোকের বাইরে সবাই মেনে নেবে, এই আমাদের ঐতিহ্য এবং তা পালনই মানুষের কর্তব্য। আমরা শুধু আমাদের এত হাজার বছরের ঐতিহ্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম হস্তান্তরিত করে যাব এই আমাদের দায়, আর কিছু নয়, অর্থাৎ প্রজন্মের পর প্রজন্ম আর এক ধরনের দাসত্ব প্রচলিত হল, পার্থক্য শুধু এই এক্ষেত্রে যারা দাসত্ব করবে তারা জানবেই না তারা আসলে দাসত্ব করছে, বরং ভক্তিতে উদ্বেলিত চিত্তে মোক্ষলাভের কথা ভাববে। দ্বিতীয়ত, অর্থলাভ হবে বললেই বোঝা যায় যে, এখানে একজন দাতা, একজন গ্রহীতা রয়েছে। দাতা সে যে ভোগ করছে আর গ্রহীতা সে যে দাতাকে আনন্দদান করছে।
এরপরের অংশেই বলা হয়েছে (ভরত নাট্যশাস্ত্র: নাট্যের উৎপত্তি; ১৯-২২) নাট্য রচনা করে ইন্দ্রকে দিলেন ব্রহ্মা এবং বললেন যে, দেবগণের মধ্যে নাট্যের প্রবর্তন করুন, যারা কৌশলী বিজ্ঞ প্রগলভবাক কঠোর শ্রমে অভ্যস্ত। কিন্তু ইন্দ্র বললেন, দেবতারা নাট্যকর্মের জন্য যোগ্য ব্যক্তি নন, একে বুঝতে ও প্রয়োগ করতে অক্ষম। ঋষিরা যারা বেদের রহস্য জানেন এবং কঠোর শ্রম করতে অভ্যস্ত তারা নাট্য প্রয়োগ করুন, অর্থাৎ দেবতারা শুধু উপভোগ করবেন এবং এর জন্য মূল্য ধরে দেবেন। সাধারণত নৃত্যের ইতিহাসেও আমরা দেখব রাজদরবার বা মন্দির গৃহ অথবা বাইজিবাড়ি সবক্ষেত্রেই এই মূল্য ধরে দিচ্ছেন উপভোক্তা, যাদের শিল্পের পৃষ্ঠপোষক বলা হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই উপভোক্তার রুচি অনুযায়ী বা তাকে তুষ্ট করার বাসনা থেকেই যাবে এহেন পরিবেশিত শিল্পে। সুতরাং শাসকের নীতি নিয়মকানুন এর মধ্য দিয়েই সুচারুভাবে প্রচার করা সম্ভব হল।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও নৃত্যের সংস্কার: প্রেক্ষাপট
উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যখন জাতীয়তাবাদের উত্থান হচ্ছে, মন্দিরের চার দেওয়ালের পিছনে দেবদাসী প্রথার মাধ্যমে যৌনশোষণ সমালোচিত হচ্ছে, মামলা হচ্ছে, তখনই এই জাতীয় নাচগুলিকে সংস্কার করে নাট্যশাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করে ক্লাসিকাল আখ্যা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, অবশ্যই তৎকালীন অভিজাত ভারতীয়দের এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের দ্বারা।
ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশ গড়ার আগে মোঘল সাম্রাজ্যে এক বিশাল অঞ্চল তাদের শাসনের আওতায় এসেছিল। তাছাড়াও ছিলেন ছোট ছোট অঞ্চলের ছোট রাজা ও ভূস্বামীরা। এই সময় নৃত্যক্ষেত্রে সবচেয়ে মূল্যবান যোগদান হল কথক নৃত্য। কথকের গল্প বলাকে আরও আকর্ষণীয় করতে চলন, ভাব আঙ্গিক প্রকরণ যোগ করতে করতে যে যাত্রা শুরু তা নবাবের পৃষ্ঠপোষকতায়, ইরানি নৃত্যশিল্পীদের দ্বারা যুক্ত হওয়া আঙ্গিক প্রকরণের দ্বারা নতুন রূপ পেল। পরবর্তীকালে ওয়াজেদ আলী শাহের দরবারে পরিপূর্ণ শিল্প হয়ে উঠল। শিল্পবোধ খুব দুর্লভ এক বিষয়। সবার তা থাকে না, ফলে শিল্পের আবেদন ইন্দ্রিয়ভোগ ও বিলাসিতায় পর্যবসিত হয়– এমনি অবস্থা এসে দাঁড়ায় গোটা উত্তর পশ্চিম পূর্ব মধ্য ভারত জুড়ে। বাইজি আর নাচনী, এদের মধ্যেই একপ্রকার আটকে পড়ল নৃত্যশিল্প। দক্ষিণ অংশে চলছিল রাজার দরবারে নৃত্যের পাশাপাশি অন্য এক ধারা, দেবদাসী প্রথা। পূর্বে ওড়িশাতেও এই প্রথার প্রচলন ছিল। দেবতার দাসী এবং ব্রাহ্মণেরও। মন্দির তো ব্রাহ্মণের, আর মন্দিরের পৃষ্ঠপোষক রাজা অমাত্য তথা ধনী ব্যক্তিবর্গ।
এই অবস্থারও পরিবর্তন হল। ব্রিটিশ এই প্রথাকে ভালভাবে গ্রহণ করেনি এবং তৎকালীন শিক্ষিত সমাজের মানুষও এই প্রথার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। ফলত ব্রিটিশ সরকারও এই প্রথা রদ করার জন্য আইনি পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। ১৯৩০ সালে মুথুলক্ষ্মী রেড্ডির তৎপরতায় মাদ্রাজ আইনসভায় পুরু বা পোড় (নির্দিষ্ট দেবতার উদ্দেশে কোনও বালিকাকে উৎসর্গ করা) প্রথা রদ করা হয়। এখানেও বেশ কিছু বিতর্ক আছে। যেমন কারও কারও মতে দেবদাসী হোক বা বাইজি তারা বস্তুত স্বাধীন ছিলেন, তারা যাই করতেন তা স্বইচ্ছায়। প্রশ্ন আসে, কেমন স্বাধীনতা? কোন নবাবের বা রাজার সভায় নাচবেন বা নাচবেন না তা নির্ধারণ করার স্বাধীনতা? বিখ্যাত কোনও কোনও বাইজির ক্ষেত্রে এমন অল্প উদাহরণ আছে তবে তাও কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তি বা নবাবের ক্ষমতা ও অর্থবলে। দেবদাসী হলে কোনও রাজা বা ব্রাহ্মণের শয্যাসঙ্গী হবেন না তার স্বাধীনতা দেবদাসীদের ছিল বলে আমরা তেমন কিছু জানতে পারি না। রইল দেবদাসী হতে চান কি না, বা বাইজি– এ সিদ্ধান্ত। এও কি সেই নারীরা নিতেন? অবশ্যই না। রাজা তার বালিকা কন্যাকে মন্দিরের মূর্তির সঙ্গে বিবাহ দিয়ে দেবদাসী প্রথায় সিলমোহর দিচ্ছেন এ ইতিহাস আমরা পাই। অর্থাৎ রাজা এ কাজ করলে রাজ্যের প্রজাদের আর এ কাজে আপত্তি থাকবে না। দেবতার তথা ব্রাহ্মণ এবং পুরুষপ্রভুর সেবা– এই তো নারীজন্মের সার্থকতা! তা আরও আগেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে মহাকাব্যে, পৌরাণিক কাহিনিতে। পুরুষতন্ত্রের প্রতি নিবেদিত নারী (অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা, মন্দোদরী) ‘সতী’ হওয়ার মর্যাদা পেয়েছেন, প্রতিবাদী নারী (সীতা) না। পৌরাণিক কাহিনি নৃত্যের মাধ্যমে প্রচারে পুরুষতন্ত্র ও নিবেদিতপ্রাণা নারীর আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হল সমাজে এবং এই আদর্শে অচল নারীদের জন্য রইল অর্থ ও যশোলাভের পথ, শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চা।
স্বাধীনতা আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদ
সারাদেশ তখন স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদের মহড়া চলছে যে ধারায় তা ঠিক কেমন জাতীয়তাবাদ সেটা দেখাও জরুরি। ১৯২৭ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে সারা ভারত সঙ্গীত সম্মেলন হয় মাদ্রাজে, যেখান থেকেই মাদ্রাজ মিউজিক একাডেমি স্থাপনের ঘোষণা করা হয়। ১৮ আগস্ট ১৯২৮ সালে ই. কৃষ্ণ আইয়ারের (সক্রিয় কংগ্রেস নেতা ও গান্ধীবাদী) নেতৃত্বে গঠিত হয় মাদ্রাজ মিউজিক একাডেমি। দেবদাসী নৃত্য বা সাদীর আট্টম থেকে ভারতনাট্যম নৃত্যের পুনর্গঠন ও প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হবে এই একাডেমি থেকেই। ১৯৩০ সালে আর এক গান্ধীবাদী কবি ভাল্লাথোল নারায়ণন মেনন এবং তাঁর সহযোগী মুকুন্দরাজা স্থাপন করলেন ‘কেরালা কলামণ্ডলম’। কথাকলি ও পরবর্তীকালে মোহিনীয়াট্যম নৃত্যের পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে কলামণ্ডলমে। মোহিনীয়াট্যমকে কলামণ্ডলমের শিক্ষাপ্রণালীতে যুক্ত করতে অনেক প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁদের। কোনও ছাত্রী না জোটায় মুকুন্দরাজা তাঁর অনুগত আশ্রিত এক পরিবারের মেয়েকে নিয়ে আসেন নাচ শেখাবার জন্য। থাঙ্কমণি, কলামণ্ডলমের প্রথম ছাত্রী, পরে গুরু গোপীনাথ যাঁকে বিয়ে করেছিলেন। মোহিনীয়াট্যম নৃত্যের কোনও সামাজিক সম্মান যখন আর অবশিষ্ট ছিল না তখনই তাকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন তাঁরা। মূল উদ্দেশ্য এক, ভারতের নিজস্ব শিল্পসংস্কৃতির ধারাগুলিকে উজ্জীবিত করে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের কাঠামো নির্মাণ। বিদেশের দরবারে যা ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচয় দেবে এবং এর থেকেই শিল্পীদের সম্মানজনক আয়ের ব্যবস্থা করা যাবে। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তৎকালীন রাজনৈতিক প্রভাবশালী অভিজাত ব্যক্তিবর্গ, আরও স্পষ্টভাবে বললে জাতীয় কংগ্রেসের অনুরাগী ব্যক্তিবর্গ।
স্বাধীনতার আগের এই জাতীয়তাবাদী ভাবনাই জন্ম দিয়েছে আটটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের, যা বিদেশে ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। কী সেই পরিচয়? মন্দির, মূর্তিপূজা, ভক্তি, সমর্পণের সংস্কৃতির পরিচয়। প্রতিটি নৃত্যধারাকে নাটাশাস্ত্র আর পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার ফলে গড়ে উঠেছে যে পরিচয়। প্রাচীন এক শাস্ত্রকে চাপিয়ে দেওয়া হল, নৃত্যশৈলীগুলিকে বেঁধে ফেলা হল সেই একই ছকে। পৌরাণিক কাহিনিগুলির মাধ্যমে বর্ণভেদ, জাতিভেদ, লিঙ্গবৈষম্য সমস্ত সংস্কার ছড়িয়ে দেওয়া হল প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সেই সনাতন ধর্মের শিক্ষা, এ কোন জাতীয়তাবাদ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ই. কৃষ্ণ আইয়ার এবং রুক্মিণী দেবী অরুন্ডেল সাদীর বা দেবদাসী নৃত্য থেকে ভরতনাট্যম নৃত্যের গড়ে ওঠার পিছনের মূল কারিগর। নীলকান্ত শাস্ত্রীর কন্যা রুক্মিণী দেবী তাঁর বাবার মতই থিয়োলজিস্ট অ্যানি বেসান্তের অনুগামী এবং পরবর্তীকালে থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হন। ঐশ্বরিক ও আধ্যাত্মবাদের প্রচারের কাজে ভরতনাট্যম নৃত্যকে যুক্ত করেন তিনি, প্রতিষ্ঠা করেন কলাক্ষেত্র। মন্দির অন্দরের নৃত্যের শৃঙ্গার (ইরোটিক) রসটিকে ভক্তির আধারে পরিবেশনে তাঁর ভূমিকা অসামান্য। তিনিই এই নৃত্য মঞ্চ-পরিবেশনার উপযোগী করে গড়ে তুললেন। পোশাক, অলংকার, সাজসজ্জা সবকিছু নতুনভাবে গড়ে তুললেন। আজ এত বছর পরে এসে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের পরিসর সারাদেশে বড় শহরগুলিতে অর্থনীতির একটা অংশ দখল করে আছে। নৃত্যশিক্ষা থেকে প্রথম মঞ্চে ওঠা পর্যন্ত এবং আরও বেশ কিছু বছর বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। আরেঙ্গাত্রমে (শিক্ষার্থীর প্রথম মঞ্চে প্রবেশ) বড় অংকের গুরুপ্রণামী (সোনার হার পর্যন্ত দেওয়া হয়) ছাড়াও পোশাক অলংকারে হাজার হাজার টাকা খরচ হয়। এসবের পর যদি কেউ কেউ বড় শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন, তবে তার অর্থাগম হবে। সবাই যদিও বড় শিল্পী হবেন না। নাচের অর্থনীতি বিষয়ে বিস্তারিত যাব না এ প্রবন্ধে, শুধু এইটুকু বলার যে, ধর্ম ভক্তি নাচ মিলেমিশে বহু কর্মসংস্থান যেমন হল তেমনই হিন্দুধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে গেল প্রজন্মের পর প্রজন্মের মননে। জীবাত্মার (ভক্ত বা নৃত্যরত নারী) মুক্তি বা মোক্ষলাভ পরমাত্মার (ইষ্টদেবতা) সঙ্গে মিলনে, এই তত্ত্বের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আগাগোড়া শাস্ত্রীয় নৃত্যের বিষয়বস্তু। আরও একটি বড় পরিবর্তন হল, নৃত্যশিল্প থেকে সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা ক্রমে সরে গেলেন, সামনের সারিতে চলে এলেন উচ্চবিত্ত, প্রভাবশালী পরিবারের নারীরা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার কারণেই। রুক্মিণী দেবী অরুন্ডেল (রাজ্যসভার সদস্য), রাগিণী দেবী, ইন্দ্রাণী বাজপাই (রহমান) প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। নৃত্যের সামাজিক প্রতিষ্ঠা হল, যৌনতাকে ভক্তির আড়ালে লুকিয়ে এবং নিম্নবিত্ত, বর্ণপ্রথায় তথাকথিত নীচুজাতির নারীদের দূরে সরিয়ে দিয়ে।
উপসংহার
“এরিষ্টটল রাজনীতি থেকে কাব্যকে (লিরিক, মহাকাব্যিক এবং নাট্যকাব্য) সম্পূর্ণ স্বাধীন বলে ঘোষণা করেছেন। এইখানে আমি যা বলতে চাইছি তা হল এইটা দেখানো যে এই ঘোষণা সত্ত্বেও এরিষ্টটল প্রথম ভয়ংকর শক্তিশালী কাব্যিক রাজনৈতিক একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন দর্শককে ভয় দেখানোর জন্য, শাসকের মতে খারাপ বা বে-আইনী প্রবণতাকে দর্শকদের মধ্যে থেকে মুছে ফেলার জন্য। এই ব্যবস্থা, আজকেও শুধুমাত্র প্রথাগত থিয়েটারে নয়, টভির সোপ অপেরা এবং পশ্চিমা সিনেমাতেও চলছে; মুভি থিয়েটার এবং টেলিভিশন একজোট হয়ে এরিষ্টটলের পোয়েটিক্সের ওপর দাঁড়িয়ে, মানুষকে শোষণ করার ব্যবস্থা চালাচ্ছে।
কিন্তু এরিষ্টটলের থিয়েটরই একমাত্র থিয়েটার নয়।’’ ১
উদ্ধৃত অংশটি আমাদের আলোচনা ক্ষেত্রেও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। ব্রাহ্মণ্য পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়েই মঞ্চ থেকে টিভি সবক্ষেত্রে শাসকের কাঠামোকে বজায় রাখার কাজ চলেছে। আগে যা ছিল মৃদু তালে ছন্দে এখন তাই জোরেশোরে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠায় তৎপর। আজকের এই অবস্থা একদিনে হয়নি, আশাকরি এতক্ষণের আলোচনায় তা বোঝাতে পেরেছি। মননে হিন্দুত্ব, পুরুষতন্ত্রের শাসন কায়েম করার কাজ অনেক আগেই শুরু হয়েছিল, এখন তা ভয়ের রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে অর্থাৎ কোনও শিল্পই রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়, বরং রাজনীতিই এর চলার পথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু এরপরেও বলতেই হবে এই একমাত্র ধারা নয়।
যে প্রশ্নগুচ্ছ দিয়ে শুরু করেছিলাম পরপর তা আলোচনা করেছি এতক্ষণ। শেষত আসি শাস্ত্রীয় নৃত্যই একমাত্র ভারতীয় পরিচয় বহন করে কি না সে প্রশ্নে। উত্তর, না। সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব। যতই চেষ্টা করা হোক না কেন রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুত্বের খাঁচায় পুরতে পারবে না ধর্মধ্বজীর দল। সংকীর্ণ ধর্মীয় স্বার্থের অনেক উপরে তাঁর অবস্থান। বাংলা ও বাঙালি লালন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পথের পথিক, বিশ্বের দরবারে সে পথও বহুজনবিদিত ও সম্মানিত।
১. নিপীড়িতের থিয়েটার: আউগুস্তো বোয়াল, অনুবাদ: শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ; মৌহারী প্রকাশনা; পৃষ্ঠা ২৯
চিত্র: গুগল
হ্যাঁ, অবশ্যই একমত। এই ধর্মকে সংস্কৃতির নামে চালানোর কল চলতে চলতে আমাদের অস্থি-মজ্জায় জেঁকে বসেছে। এজন্য আমরা এর বাইরের সাধারণ আম্নুষের সংস্কৃতিকে “ফোক” বলে চালিয়ে দিই – সে “প্রান্তিক”ই থেকে যায়, অথচ সেই সংস্কৃতিই এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠের। ভারতকে চিনতে হলে লালনকে চিনতে হবে।
সেই সংখ্যাগরিষ্ঠের আঙ্গিক, সংগীত তাল ছন্দ সবই নিয়ে তাকেই পলিশ করে নিজেদের তত্ত্ব অনুযায়ী পরিবেশন করা হয়েছে, তবেই তো ভদ্রবিত্তের সংস্কৃতি হয়েছে।