Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

মৃত্যু-শিল্প-আলো: তৃতীয় পৃথিবী

কয়েকদিন ধরে কতগুলো মৃত্যু আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। প্রথমটি হল ক্লদ মোনের স্ত্রী ক্যামিলের মৃত্যু। সেই মৃত্যুর ছবিটি, কথিত আছে যা মোনে পাশের ঘরে গিয়ে এঁকেছিলেন। দ্বিতীয়টি হল আকিরা কুরোসাওয়ার দাদার মৃত্যু। অনেকেই এটা জানেন নির্বাক যুগের চলচ্চিত্রে কথক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করা কুরোসাওয়ার দাদা সাতাশ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন। প্রথম মৃত্যুটি ক্যামিলের অসুখজনিত। আকিরার দাদা মারা গিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়।

মৃত্যুর পর আকিরাকে একজন বলেছিলেন যে তাঁর দাদার মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত অন্ধকার। এই অন্ধকারই টেনে নিয়ে গেছিল তাঁকে মৃত্যুর দিকে। যদিও সবাক চলচ্চিত্র আসার পর নির্বাক চলচ্চিত্রের কথকদের কাজ হারানোকেই অনেকে দায়ী করেন। সারাজীবন ফুল এবং প্রকৃতির মধ্যে থাকা মোনে স্ত্রীর মৃত্যুশয্যার ছবি আঁকতে গিয়ে অন্ধকার চেয়েছিলেন। অথচ তাঁর শিল্পসত্তা সেই অন্ধকারের ওপর বুলিয়ে দিয়েছিল চমৎকার কুয়াশার মত আলো।

মোনে স্ত্রীর মৃত্যুশয্যার ছবি আঁকতে গিয়ে অন্ধকার চেয়েছিলেন।

ঘুমের মধ্যে মরে যাওয়ার এক অদ্ভুত ভয় হয় আমার। মৃত্যুর কথাও আমার জানতে ইচ্ছে হয়। সরাসরি তাকাতে ইচ্ছে করে মৃত্যুর দিকে। জীবনের বেশ কিছুটা সময় ভাস্কর চক্রবর্তীর মতই মৃত্যুকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলাম। জীবনের অসহ্য যন্ত্রণা সেই বয়সে আমাকে এভাবে ক্লান্ত করেনি।

দুদিন আগে আমার বাড়ির সামনে এক নব্বই বছর বয়সী বৃদ্ধ এই জীবন ছাড়িয়ে বহুদূর চলে গেলেন। দুটো চিহ্ন তার সম্পর্কে মনে পড়ে। আমাদের ছাদে এলে দেখতাম জীর্ণ বাড়িটির একটি বারান্দায় বসে তিনি অনন্তের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখ স্পষ্ট করে কিছু একটা দেখছে, অথচ আমি জানি নির্দিষ্ট করে কিছু দেখার নেই।
গভীর রাতে তাঁকে ধরে বাথরুমে নিয়ে যেত তার ভাগ্নি। স্বামী অনেক বছর আগে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। সেই ভাগ্নি রাতের বেলা তার বৃদ্ধ মামাকে বাথরুমে নিয়ে আসত। দরজা দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। বাথরুম থেকে একটা হলুদ রঙের আলো এসে পৌঁছত আমার ঘর অবধি। দূর থেকে শুনতাম— সাবধানে সাবধানে…

একটা হলুদ রঙের আলো যেটি আর দুদিন ধরে জ্বলছে না। দাদার মৃত্যুর অনেক বছর পর কুরোসাওয়া নিজের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন। ক্যামিলের মৃত্যুর পর একটা সম্পূর্ণ নতুন সিরিজ এঁকেছিলেন ক্লদ মোনে।

একটা হলুদ আলো। একটা বসে থাকার মত বারান্দা। মনে রাখতে হবে আকিরা কুরোসাওয়ার দাদা ছিলেন নির্বাক যুগের চলচ্চিত্রের কথক। সিনেমা এখন নির্বাক নয়। ক্লদ মোনে ইম্প্রেশনিস্ট আন্দোলনের পিতাসমান। আজ সন্ধেবেলা ছাদে উঠে দেখলাম সেই বারান্দায় বসে আছেন আমাদের পাশের বাড়ির সদ্যমৃত বৃদ্ধ। চোখ তাঁর দূরে কোথাও। মুখে তাঁর স্মিত হাসি।

কভার: ক্লদ মোনে এবং তাঁর আঁকা মৃত্যুশয্যায় ক্যামিল মোনে।

চিত্র: গুগল
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »