কয়েকদিন ধরে কতগুলো মৃত্যু আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। প্রথমটি হল ক্লদ মোনের স্ত্রী ক্যামিলের মৃত্যু। সেই মৃত্যুর ছবিটি, কথিত আছে যা মোনে পাশের ঘরে গিয়ে এঁকেছিলেন। দ্বিতীয়টি হল আকিরা কুরোসাওয়ার দাদার মৃত্যু। অনেকেই এটা জানেন নির্বাক যুগের চলচ্চিত্রে কথক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করা কুরোসাওয়ার দাদা সাতাশ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন। প্রথম মৃত্যুটি ক্যামিলের অসুখজনিত। আকিরার দাদা মারা গিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়।
মৃত্যুর পর আকিরাকে একজন বলেছিলেন যে তাঁর দাদার মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত অন্ধকার। এই অন্ধকারই টেনে নিয়ে গেছিল তাঁকে মৃত্যুর দিকে। যদিও সবাক চলচ্চিত্র আসার পর নির্বাক চলচ্চিত্রের কথকদের কাজ হারানোকেই অনেকে দায়ী করেন। সারাজীবন ফুল এবং প্রকৃতির মধ্যে থাকা মোনে স্ত্রীর মৃত্যুশয্যার ছবি আঁকতে গিয়ে অন্ধকার চেয়েছিলেন। অথচ তাঁর শিল্পসত্তা সেই অন্ধকারের ওপর বুলিয়ে দিয়েছিল চমৎকার কুয়াশার মত আলো।
ঘুমের মধ্যে মরে যাওয়ার এক অদ্ভুত ভয় হয় আমার। মৃত্যুর কথাও আমার জানতে ইচ্ছে হয়। সরাসরি তাকাতে ইচ্ছে করে মৃত্যুর দিকে। জীবনের বেশ কিছুটা সময় ভাস্কর চক্রবর্তীর মতই মৃত্যুকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলাম। জীবনের অসহ্য যন্ত্রণা সেই বয়সে আমাকে এভাবে ক্লান্ত করেনি।
দুদিন আগে আমার বাড়ির সামনে এক নব্বই বছর বয়সী বৃদ্ধ এই জীবন ছাড়িয়ে বহুদূর চলে গেলেন। দুটো চিহ্ন তার সম্পর্কে মনে পড়ে। আমাদের ছাদে এলে দেখতাম জীর্ণ বাড়িটির একটি বারান্দায় বসে তিনি অনন্তের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখ স্পষ্ট করে কিছু একটা দেখছে, অথচ আমি জানি নির্দিষ্ট করে কিছু দেখার নেই।
গভীর রাতে তাঁকে ধরে বাথরুমে নিয়ে যেত তার ভাগ্নি। স্বামী অনেক বছর আগে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। সেই ভাগ্নি রাতের বেলা তার বৃদ্ধ মামাকে বাথরুমে নিয়ে আসত। দরজা দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। বাথরুম থেকে একটা হলুদ রঙের আলো এসে পৌঁছত আমার ঘর অবধি। দূর থেকে শুনতাম— সাবধানে সাবধানে…
একটা হলুদ রঙের আলো যেটি আর দুদিন ধরে জ্বলছে না। দাদার মৃত্যুর অনেক বছর পর কুরোসাওয়া নিজের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন। ক্যামিলের মৃত্যুর পর একটা সম্পূর্ণ নতুন সিরিজ এঁকেছিলেন ক্লদ মোনে।
একটা হলুদ আলো। একটা বসে থাকার মত বারান্দা। মনে রাখতে হবে আকিরা কুরোসাওয়ার দাদা ছিলেন নির্বাক যুগের চলচ্চিত্রের কথক। সিনেমা এখন নির্বাক নয়। ক্লদ মোনে ইম্প্রেশনিস্ট আন্দোলনের পিতাসমান। আজ সন্ধেবেলা ছাদে উঠে দেখলাম সেই বারান্দায় বসে আছেন আমাদের পাশের বাড়ির সদ্যমৃত বৃদ্ধ। চোখ তাঁর দূরে কোথাও। মুখে তাঁর স্মিত হাসি।
কভার: ক্লদ মোনে এবং তাঁর আঁকা মৃত্যুশয্যায় ক্যামিল মোনে।