আরণ্যক প্রেমকথা
স্বপ্নের ঘোরে আমি ফিরে গেছি নিযুত বছর আগে
সম্মুখে ছিল অববাহিকার একহাঁটু তক কাদা
উত্তাল ঢেউ সমুদ্র খাঁড়ি কুমিরের আনাগোনা।
আমি হয়ে গেছি আদিম-পুরুষ খুব ডাকাবুকো যুবা
প্রিয়সঙ্গিনী আদিম রমণী ইভার আকুল দাবি—
‘সমূহ বিপদ বিঘ্ন পেরিয়ে যাও ওপারের বনে
এনে দিতে হবে সুস্বাদু ফল, সোনার আপেল
খুব তরতাজা পারিজাত ফুল মৃগনাভি কস্তুরী।’
সামনে প্রকট ঘন বনবীথি কণ্টক ঝোপে ঢাকা,
মৃগাঙ্ক পথ খুব উঁচুনীচু দিশাহীন আঁকাবাঁকা।
আমি আপ্রাণ দু’হাতে সরাই কণ্টক বল্লরী,
সর্বশরীর কাঁটার আঘাতে আরক্ত বিক্ষত।
বিষধর সাপ পোকা ও মাকড়ে অরণ্য ছয়লাপ
কানে এসে ঠেকে ক্রূর শ্বাপদের ক্ষুধার্ত হুংকার।
আচমকা ভয়ে ঘেমেনেয়ে চোখ মেলে চেয়ে দেখি,
সে ইভা এখন ঘুমে আলুথালু, কবরী কুসুমে ঢাকা,
অনামিকা ঘিরে হিরের আংটি, দু’ঠোঁটে রুজের ছাপ।
সারা গা হতে ভিনদেশি কোনো আতরের নির্যাস,
ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে বসন্ত পরিষেবা।
তার দুটো হাত গলদেশ ঘিরে নির্ভরতার ফাঁস।
তৃপ্ত শ্রীমুখ ভরসা পেয়েছে হৃৎকমলের কাছে।
◊♦◊
ভালবাসা যদি—
ভালবাসো কুয়াশার আঁধি কিংবা কুজ্ঝটিকা হলে,
হাতে হাত রেখে কত দূর যেতে পারি মগ্ন অভিসারে!
ভালবাসো যদি হয় সাতরঙা রামধনু শরৎ আকাশে,
রিমঝিম বৃষ্টিভেজা মোলায়েম সোনালি রোদ্দুরে,
কিংবা শিশিরের হিরেকণা হয়ে ওঠে ঘাসের শিয়রে,
তবে একসাথে হাঁটা যায় হাজার যোজন,
এলোমেলো আঁকাবাঁকা রুখাশুখা মেঠোপথ ধরে।
যদি অন্ধকার নেমে আসে পৃথিবীর পিঠের ওপর,
আমি তুমি ক্লান্ত ডানা পিপাসার্ত চকোর চকোরী
আঁধারের অন্তঃপুরে খুঁজে নেব প্রণয়বাসর।
◊♦◊
অসফল প্রণয়ের প্রতিকৃতি
আমি বারংবার দাঁড়িয়েছি গ্রীষ্মের অপরাহ্ন তাপে।
আনত মস্তক যবুথবু বেঁটেখাটো ছায়ার ভিতর,
খুঁজেছি তোমার মুখ ছাতিমের ছড়ানো চিকুর।
ঝরে পড়া ঘামে সন্তরণ সুনির্মল ডুবস্নান সেরে
আরাধ্যার পূজাআর্চা করেছি নিষ্পাপ হৃদয়ে।
বুকের বাঁ-ধারে রাখা ফাল্গুনের ঝরাপাতা,
গোছা গোছা প্রেমপত্রে সুবিন্যস্ত সবুজ লিখন,
অশ্রু ঘামে একাকার এলোমেলো কালো আঁকিবুকি,
আঁতিপাঁতি খুঁজে কোথাও পাইনি তবু্ সে চেনা আদল।
পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,
লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।
এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।
বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।
নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,
বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।
হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,
অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।
সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।
◊♦◊
দুরন্ত ঘোড়া তুরন্ত দৌড়
লাগাতার ছুটে ঝরাচ্ছি আমি সাত সমুদ্র ঘাম।
সামনের পথ পিছল হচ্ছে, কত দূরে যেতে হবে?
প্রান্তপথের দিশার নকশা দেয়নি পথিকৃৎ।
আর কতকাল এভাবে ছুটব জানতে পারিনি আমি।
পথের দু’পাশে বৃক্ষবীথির সবুজের উদ্ভাস,
মাথার উপর গগনপটুয়া কত শত ছবি আঁকে,
ইন্দ্রধনুক তারা-জোনাকির আলো অরূপ চন্দ্রহাস,
মেঘপুঞ্জের অলকা চিকুরে এলোমেলো দৌড়ঝাঁপ,
একপলকের তাকিয়ে দেখার হয়নিও অবকাশ।
পায়ের তলায় পিষে মরে যায় লাখো লাখো পিপীলিকা,
ঘাসের শিয়রে শিশির-কান্না শুনতে পাই না আমি।
দুরন্ত ঘোড়া তুরন্ত দৌড় রাতদিন ঘুমহীন,
কলজে মগজ ছোটার কদম অচল অবশ প্রায়,
মুখ থুবড়ে পড়ার মাহেন্দ্রক্ষণ কখন সুস্বাগত?
প্রভাত গোধূলি সায়ংসন্ধ্যা আট প্রহরের দৌড়,
কতদূর গেলে কিনতে পারব সাড়ে তিন হাত জমি?
এসব প্রশ্নে অদৃশ্য সেই মহান পথিকৃৎ,
চির উদাসীন ভাবলেশহীন মৌন নির্বিকার।
তাই রোদ জল জাড় তুষারঝঞ্ঝা মরুপ্রদেশের ঝড়ে
ক্লান্ত পথিক বিরামবিহীন দৌড়ে চলেছি আমি।
◊♦◊
অকূল মাঝির বসতবাড়ি
মেঘ জমেছে অকূল মাঝির বসতবাড়ির কাছে।
সে বাড়ি নয় অট্টালিকা আকাশছোঁয়া ছাদ
চাঁদ রূপসীর সঙ্গে তার হয় না মুলাকাৎ
খড়বিচালির ভাঙা কুঁড়ে দেরাজ হাটখোলা
ঝরোকাগুলোয় জাফরি নেই, ছাদের মাথায় ছ্যাঁদা।
ঘরেতে নেই বাসনকোসন বাক্সপ্যাঁটরা কিছু
খোলা হাওয়ার উঁকিঝুকি দেদার চলাফেরা।
অকূল নাইয়ার কী আসে যায় রোদ বর্ষা ঝড়ে!
চাঁদনি রাত দুপুর রোদ অমারাতের কালো
জলের ওপর ভাসিয়া ‘না’ উজান ভাটায় চলা।
মেঘ জমেছে অকূল মাঝির বসতবাড়ির কাছে,
মেঘের সঙ্গে আড়ি করা তার কি এখন সাজে!
আকাশভাঙা জলের তোড়ে বাড়ুক নদীর জল,
মেঘের ভিতর বাজের কড়াৎ হাসুক খলখল।
যাক ভেসে যাক বসতবাড়ি দু’কূল ছাপা জলে।
নৌকোখানি অটুট থাক ভাসুক অকূল জলে
ওটাই তার ঘরকন্না জীবনপ্রীতি যাপন সম্বল।
(না— নৌকো এবং নাইয়া— নাবিক/ মাঝি/ পেশাগত আঞ্চলিক পদবি)
◊♦◊
হলুদ জামা ও কালো বিছানা
ভোরের কুয়াশা ফেঁড়ে সূর্য তার সাজায় সংসার।
সোনালি ডানার পাখি প্রভাতী রোদ্দুর উড়ে এসে
আমার ধূসর উঠোনে খোঁজে, প্রাতরাশ দানা।
সারারাত অভুক্ত ঘুমহীন শীতার্ত শিশুরা
নতুন হলুদ জামায় ঢেকে আদুল শরীর,
পাখিটাকে কানামাছি খেলার নিকটবন্ধু ভেবে
খুদে আঙিনায় মহানন্দে লুটোপুটি খেলা খেলে।
আমি সূর্যপ্রণাম আর সকালের প্রাণায়াম সেরে
নেমে পড়ি দানাপানি কানাকড়ি যোগাড়ের পথে।
দুপুরের খরতাপে অশ্রু ঘামে নাজেহাল জেরবার,
হিম হতাশায় শূন্য ভিক্ষেথলি হাতে ঘরমুখো হই।
ঘরে ফিরে দেখি শিশুদের গায়ে নেই সে নতুন জামা
হলুদপাখিটা গোলাপি আবির মেখে সায়ংসন্ধ্যায়
ফিরে গেছে পশ্চিমী পাহাড় পার অন্য কোনো দেশে।
শিশুরা নেতিয়ে পড়েছে ফের রাত্রির কালো বিছানায়।
◊♦◊
ঋতুসংহারের গল্পগাছা
পাহাড়ি অরণ্যঘেঁষা কোনো এক স্থানে জনশ্রুতি,
স্বর্গ হতে নেমে আসে সালংকারা ষোড়শী রূপসী,
লতাকুঞ্জে হাওয়া দোলনায় দোলে ফাল্গুনী রাতে।
চারপাশে গড়ে ওঠা নয়া নয়া অতিথিশালায়
সে দৃশ্য দেখার জন্য প্রায়শই শত শত পর্যটক আসে।
রুদ্ধকাম বৃদ্ধস্বামী সহ জনৈক তিরিশের নবপরিণীতা
সেখানে হাজির হয় মধুচন্দ্রা যাপনের মগ্ন অভিপ্রায়ে।
বৃদ্ধের হৃদয়ে ও চোখেমুখে প্রতিবর্ত বসন্তবিলাস,
কাহিল শরীরে নেই দহনের যুৎসই সুদাহ্য ইন্ধন।
নবোঢ়ার মনে ও শরীরে মজুত টাটকা বারুদ
স্ফুলিঙ্গের আসঙ্গলিপ্সায় উন্মাদ উন্মুখ।
সারাদিন ঘুরে ঘুরে তারা দেখে নিসর্গের শোভা,
হরিণহরিণী আর পাখিদের যূথবদ্ধ প্রণয়-বিহার।
রাতের বিছানা শ্মশানের নিস্তব্ধ পরিত্যক্ত চিতা।
একদিন পড়তি বিকেলে ফোয়ারায় সান্ধ্যস্নান
অঙ্গরাগ প্রসাধন-শেষে নববধূ হাসিমুখে বলে—
‘পাহাড়ি ঝোরার কাছে কোনো এক নির্জন গুহায়
কবিরাজী জ্ঞান আছে জনৈক যুবক সন্ন্যাসী
যৌবনের সঞ্জীবনী জড়িবুটি, তাগা, সালসা দেয়,
আমি গিয়ে নিয়ে আসি, রাতগুলো বর্ণময় হবে।’
তারপর প্রতীক্ষায় বহুরাত বহুদিন অতিক্রান্তপ্রায়
সে আর ফেরেনি অথর্বের ভাড়া করা অতিথিশালায়।
সে বৃদ্ধ এখন বদ্ধপাগল অর্ধনগ্ন বোবা পর্যটক
পাহাড়ি ঝোরার কাছে খুঁজে চলে সন্ন্যাসীর গুহা।