Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

আগমনী

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

শেষবিকেলে নিউ টাউন শহরটা বেশ সুন্দর দেখায়। একটা কমলা আভা ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়টা বেশ ভাল। পুজো আসছে— এই অনুভূতি মনে সর্বক্ষণ জেগে থাকে।

অ্যাপার্টমেন্টের সামনে সার্ভিস রোডের এক প্রান্তে বিজয়ার গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। পাশ থেকে মাঝে মাঝে হুস-হুস করে ছুটে যাচ্ছে সাইকেল। বিমানবন্দর লাগোয়া শহরের এই অংশটি বিজয়া আর অমিতের সব থেকে বেশি পছন্দ হয়েছিল। মহানগরের কোলাহল থেকে অনেকটা দূরে তারা সুখের ঘর বেঁধেছিল।

বিজয়া ভাবছিল, বন্ধনমুক্ত হতে বেশি সময় লাগে না। আজকাল পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে বিচ্ছেদ যেন খুব তুচ্ছ বিষয়। খুব মনে পড়ছে ওই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সে অমিতকে বলেছিল— ‘চাঁদ চাই না। তুমি তো আমাকে আকাশের কাছাকাছি এনেছ।’ আকাশের দিকে তাকিয়ে অমিত বলেছিল, ‘তুমি… পাখি হয়ে উড়ে যাবে, তাই তো?’ কথাটা শুনে খুব হেসেছিল বিজয়া। অমিতের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘আমি তো পাখি হবই। তুমি প্রেম দিয়ে আটকে রেখো… এই খাঁচায়।’

ভাবতে ভাবতেই ব্যাগ থেকে ফোনটা হাতে নেয় বিজয়া। অন্তত পাঁচ মাস অমিতের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। এখন কেমন আছে অমিত? বিজয়ার কথা সে কি এখনও ভাবে? এতদিন পর ফোন করলে সে কী ভাববে?

শেষে ফোনটা করেই ফেলল বিজয়া। ডায়াল করেই চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। অমিতের ফোন বেজেই চলেছে। একবার নয়, দু’বার, তিনবার। কী মনে হল, ফের লিফটের সামনে হাজির হল বিজয়া। পাঁচতলায় নিজের ফ্ল্যাটের সামনে সে হাজির হল আবার। অমিতের নম্বরে ফের ডায়াল করল বিজয়া। এবার স্পষ্ট শুনতে পেল— ফোনের রিং টোন— বিপ বিপ বিপ…। ভেসে আসছে তালাবন্ধ দরজার ওপার থেকে! বিজয়া অনুভব করল, তার কপালে, গলায় ঘাম জমেছে। নিউ টাউনে ঝুপ করে আঁধার নেমে এল।

আগে যা ঘটেছে…

কলেজ মোড়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল বিজয়া। দুপুরের দিকে সেক্টর ফাইভের থেকে নিউ টাউনমুখী বাসগুলো কোথায় পালিয়ে যায় কে জানে। হঠাৎ পিছন থেকে ডাকল ঋতুপর্ণা। বিজয়া কয়েক মুহূর্ত বিস্ময় গোপন করতে পারেনি। ঋতুর বাবা, তরুণকাকু তার অংকের মাস্টারমশাই ছিলেন। ঋতু তখন অনেক ছোট। বিজয়া একদিন শুনেছিল তরুণকাকু আর নেই! বাবাকে প্রশ্ন করে কোনও সদুত্তর সেদিন পাওয়া যায়নি। বিজয়ার খুব মনে আছে, বাবা বলেছিলেন, ‘তরুণকাকুকে ভুলে যেয়ো না। ভুলে থেকো…।’

সেদিন ঋতু কিছুতেই ছাড়ল না। টানতে টানতে বিজয়াকে সেই ভরদুপুরেই কফিশপে নিয়ে গেল। তবে সেদিন কফিশপে বিজয়া জীবনের সেরা ‘সারপ্রাইজ’-টা পেয়েছিল। ঋতুর অমিতকে সরাসরি চেনার কথা নয়। কিন্তু অমিতের ছবি কেন তার মোবাইলে তা বুঝে উঠতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগেছিল তার। আধ ঘণ্টা খানেক পরে উঠে দাঁড়াল বিজয়া। ঋতু ততক্ষণে অমিতের ছবি দেখিয়ে বিজয়কে একাধিক বার বলেছে, এই ছেলেটি তার বিশেষ মানুষ। প্রেম-সম্পর্কের সবে শুভসূচনা হয়েছে।

Advertisement

সেদিন সন্ধ্যায় অমিত-বিজয়ার জীবন দুটি আলাদা রাস্তা বেছে নিয়েছিল। পেশায় আইনজীবী বিজয়ার পক্ষে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে ডিভোর্সে অমিতকে রাজি করানো কঠিন ছিল না। কারণ, বিজয়ার যুক্তির সামনে অমিতের সওয়াল-জবাব টেকেনি। অমিত বারবার বুঝিয়েও বিজয়কে বিশ্বাস করাতে পারেনি যে, ঋতু তার অধীনে একজন শিক্ষানবিশ কর্মচারী ছাড়া আর কিছু নয়। ঋতু তাকে প্রেমের চোখে দেখেছে। সে নয়।

এরপর নিউ টাউনের ফ্ল্যাট থেকে দু’জনেই দু’দিকের পথ নেয়। বিজয়া মানিকতলায় মা’র কাছে ফিরে যায়। অমিতের খোঁজ নিতে মন চায়নি তার।

জীবন হয়তো একই রাস্তায় চলতে থাকত, যদি না ফের ঋতুর সঙ্গে বিজয়ার সেই সেক্টর ফাইভের রাস্তাতেই দেখা হত।

অমিত চাকরি হারিয়েছে— একথা সেদিন ঋতুর থেকেই জানতে পারে বিজয়া। অমিতের ব্যাপারে সে ভুল ভাবত, বিজয়ার সামনে তাও মেনে নেয় ঋতু। বিজয়ার মনে আছে সেদিন ঋতু তাকে বলেছিল, ‘অমিতকে নিয়ে আমি একটু বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। আমার বোঝা উচিত ছিল যে, অমিতের চোখে আমি নিজের জন্য সেই ভালবাসা দেখিনি। ও একজন বিবাহিত মানুষ। ওর চোখে নিজের জন্য ভালবাসা খুঁজতে গিয়ে আমি অন্যায় করেছিলাম। আমি নিজের কাছেও অপরাধী, অমিতের কাছেও অপরাধী।’

আগমনী

‘কিছু বলোনি কেন?’ অমিতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল বিজয়া। এই হালিসহরের গঙ্গার পাড়ে প্রায় এক দশক আগে দু’জনের দেখা হয়েছিল। সদা বহমান গঙ্গা কি তা মনে রেখেছে?
আজ অমিতকে দেখে বিজয়ার মনে হল গঙ্গা যেন কয়েক মুহূর্ত থেমে গেছে। একবার পুরনো স্মৃতি খুঁজে নিতে চাইছে।
যদিও বিজয়ার সামনে যে যুবক দাঁড়িয়ে আছে, তাকে অমিত বলে চেনা সত্যি কঠিন। এ যুবক যেন খণ্ডে খণ্ডে ভেঙে গিয়েছে।
বিজয়া ভাবতে লাগল, সত্যি! কোনও এক যুবকের জীবনে তার এত বড় ভূমিকা? মক্কেলদের জন্য কেস লড়তে গিয়েও জীবনের সহজ সত্যটা কেন অনুভব করতে পারেনি বিজয়া?
‘বলে কী লাভ হত?’ প্রশ্ন করল অমিত।
‘কেন? স্ত্রী হিসাবে আমার এইটুকু জানার অধিকার নেই?’ অমিতের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারছিল না বিজয়া।
‘তোমার চোখে সেদিন অবিশ্বাসের ছবি দেখেছিলাম।’ একটু থেমে জবাব দিল অমিত।
‘সে ছবি মুছে দেওয়ার চেষ্টা করোনি কেন? তুমি চেষ্টা করলেই মুছে দিতে পারতে…।’
‘চেষ্টা করিনি…। কারণ জানতাম, তুমি একদিন আগমনী হয়ে ফিরে আসবে।’ বিজয়ার চোখে চোখ রেখে বলল অমিত।
‘বেশ তা হলে আমারও একটা শর্ত আছে।’
প্রশ্ন করতে পারল না অমিত। প্রশ্নগুলো কখন অভিমানে মিশে গঙ্গায় ভেসে গিয়েছে, টের পায়নি সে। শুধু বিজয়ার চোখে দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
‘আজ থেকে আমি বিজয়া নই। আমি তোমার আগমনী।’ অমিতের কাঁধে মাথা রাখল বিজয়া।

কাল মহালয়া। দেবী পক্ষের শুরু।

চিত্রণ: মুনির হোসেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

20 − 17 =

Recent Posts

দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আমার স্মৃতিতে ঋত্বিককুমার ঘটক

দুটো‌ জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম তাঁর।‌ এক, তিনি কথা বলার সময় আত্মমগ্ন‌ থাকতেন। কারও দিকে‌ তাকিয়ে‌ কথা বলতেন না। তাকাতেন‌ হয় সুদূরে, আর নয়তো‌ চোখ বুজে‌ কথা বলতেন। আর দ্বিতীয় যা, তা হল‌ ঋত্বিকের চোখ। এত উজ্জ্বল আর‌ মরমী, এক-ই সঙ্গে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আর লুব্ধক নক্ষত্রের মতো দীপ্ত, তা আর কারও মধ্যে দেখিনি। সত্যজিৎ-মৃণালের মধ্যেও না, যদিও ঘটনাচক্রে ওই দু’জনের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল অনেক বেশি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটক ও বাংলাদেশ

ঋত্বিক ঘটকের জীবনের প্রথম বাইশ বছর (১৯২৫-১৯৪৭) কেটেছে মূলত পূর্ব-বাংলায়, যা এখনকার বাংলাদেশ। তাঁর জন্ম ঢাকার ২,ঋষিকেশ দাস রোডের ঝুলন বাড়িতে। ১৯৪৭, অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি মূলত পূর্ব-বাংলায় কাটান। আমরা দেখব, পূর্ব-বাংলা যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে-দেশ, সে-ভূমির প্রভাব তদনুরূপ ঋত্বিকেরও পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে।

Read More »