ভূষণকে নিয়ে আমার শেষ লেখাটা
ভূষণকে নিয়ে অনেক লিখেছি। ভূষণ বুক্কার অসমবয়সী বন্ধু। বয়স বলতে পারব না। আমার থেকে অনেক বড় তা জানি। ওর একমাথা চুল আর দুটো বড় বড় বিস্ময়ে ভরা চোখ দেখে আমি মুগ্ধ হই। আর সবার মতো ওকে পাগল বলতে পারি না। তবে এও ঠিক ও আর সকলের মতো স্বাভাবিক নয়। সারাদিন কেউ ভাঙা নৌকোয় বসে থাকে? ও থাকে। আমাদের গঙ্গার ধারে ভাঙা ঘাটে ওর নৌকো বাঁধা থাকে। মালোপাড়ায় ওর ঘরদোর আছে বটে তবে সে ঘরে ও মোটে যায় না। শিবুর চায়ের দোকান, ভাঙা ঘাট, কালি মন্দির, শ্মশানঘাট, এই হল ওর চৌহদ্দি। তা এইটুকু যার সীমানা তাকে নিয়ে আর কত লেখা যায়!
মনে হচ্ছে এটাই ওকে নিয়ে শেষ লেখা। সকলেই ভাববেন এরকম একটা পাগলাটে জেলেকে নিয়ে লেখার আছেটাই বা কী? আছে। আসলে আমার পুত্র বুক্কা সেই ছোট থেকে ভূষণের কাছে যায়। ঘাটটা তখনও এত ভাঙেনি। তখনও ফ্যাক্টরি বেসরকারি কর্পোরেটের হাতে যায়নি। তখনও ফ্যাক্টরির সারভেন্ট কোয়ার্টারের মানুষগুলো উচ্ছিন্ন হয়নি। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়েছে। ভূষণের গল্পের অথৈ জল আর মানুষ, দুইই হারিয়ে গেছে। অনেকদিন পর হস্টেল-বাস শেষে বুক্কা এসেছে। আমাদের ঘরে আলো এসেছে। বুক্কার মা বড় স্বপ্ন ভালবাসে। ওই ভূষণের মতোই খানিক অস্বাভাবিক। পুত্র মায়ের কিছু গুণ পেয়েছে।
ভূষণ এখনও খুব ভাবের কথা বলে। সবচেয়ে বড় কথা, সেই সব ভাবের কথা ওর নৌকোয় বসলে তবে শুনতে পাওয়া যায়। ঘাটে নিশ্চিন্তে নিরাপদে বসে ওর কথা শোনাই যাবে না! ও মুখ বাড়িয়ে বলবে, শুনতি হলি লৌকোয় পা দু’খান দাও দিকিনি। আমার ছাইপাঁশ শুনতি হলি এখেনে এসে বোসো। বলব। ঘাটে পা রেখি কী শুনবে? থল থেকি জলে এসো।
বলা বাহুল্য, কেউ যায় না। ছোকরার দল হাসে। বলে, ওসব যত গাঁজা নিজের কাছে রাখো কাকা। ভূষণ ওকথা শুনতেও পায় না, উত্তরও দেয় না। আমার ইচ্ছে করে ওদের বেশ করে দু’কথা বলি। কিন্তু দিনকাল খারাপ। কেউ কাউকে রেয়াত করে না।
একটা নৃশংস ঘটনার ধাক্কা শহর ছাড়িয়ে গঙ্গা বেয়ে আমাদের ঘাটেও এসে লেগেছিল। আমরা প্রতিবাদ করেছি। তারপর ভুলতেও চেয়েছি। যা ক্রমেই ভবিতব্য হচ্ছে তাকে ভোলা ছাড়া উপায় কী? সিস্টেমের বিরুদ্ধে যেতে আমরা ভয় পাই। ঘটনার পর পর প্রতিবাদ মিছিল বেরিয়েছিল। মাস খানেক পর লোকাল পুলিশ মাঝেসাঝেই খোঁজ নিচ্ছিল। সব ঠিক আছে তো? পাড়ার নেতারাও তাদের সঙ্গে ছিল। স্বভাবতই আমি ভিতু বাঙালি, ঘরে কন্যাসন্তান না থাকলেও স্ত্রী আছে, বেশি জড়াইনি। বাইশে শ্রাবণ রবি ঠাকুরের দুঃখের গান সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে দায় সেরেছি। বুদ্ধিমান লোক আমার অক্ষমতা বুঝবেন, আবার প্রতিবাদটুকুও বুঝবেন, এই আশা।
সেই হতভাগিনী কন্যার কথা বলব না। জোর করে তাকে আমি মাথার পেছনে পাঠিয়েছি। আজ বরং বুক্কার কথা বলি।
ভরা বর্ষা এবার। গঙ্গার জল ক্রমেই লাল হয়ে উঠছে। কুল ভাসানো জলে কত পুকুর কত দিঘি কত নালার জল যে এসেছে! তার মাঝেই ইলিশের জন্য বাবুরা বড় আকুল হয়ে উঠেছে। পদু জেলে খবর দিয়েছে সকালে। ইলিশের নৌকো ফিরছে। রাত থাকতে নদীতে গিয়েছিল। ভরা জাল নিয়ে ফিরছে। পদু বলল, বাবু একবারটি ঘাটে আসুন। নিজে দেখে নিয়ে যাবেন। আধঘণ্টা পর আসুন, তা হলেই হবে।
আমি বুক্কার দিকে তাকালাম। সে এখন লায়েক ছেলে হয়েছে। বাপের বুদ্ধির ওপর ভরসা করবে কি? বললাম, হ্যাঁ রে, ইলিশ দেখতে যাবি নাকি? বুক্কা একটা শক্ত সমস্যার সমাধান করছিল। অন্যমনস্ক ছিল। আমার কথা শুনে ফিরে তাকাল। বলল, ঘাটে নৌকো ভিড়েছে? চলো যাই। ইলিশের আমি চিনি কী, তবে আমি যাব ভূষণ কাকার কাছে। আমি একটু অস্বস্তি বোধ করলাম। ছোটবেলা যেত, ভূষণের আজগুবি গল্প শুনে আসত, আমরা ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। কিন্তু এখন ও বড় হয়েছে। পড়াশুনো শিখেছে। এখন ওসব শোনা কেন। ছোটবেলায় বুক্কা এসব শুনে আসত আর আমাদের মাথা খারাপ করে দিত। ওর মা এসবে প্রশ্রয় দিয়েছে। আমি নয়। ওর মায়ের কথা হচ্ছে, এমন রূপকথা বা আজগুবি গল্প শোনা ভাল। মনে কল্পনার বিস্তার হয়। মন যদি সরলরেখায় চলে তবে মানুষ ভীষণ দুঃখ পায়। আমি বুঝতে পারি, ওর মায়ের মন এমন বলেই বুক্কা এত কল্পনাপ্রবণ। কিন্তু ও এখন টাটা রিসার্চ ইন্সটিটিউটে রিসার্চ করে। ওকে কি এখন এভাবে আবার ওই কল্পনার জগতে ঠেলে দেওয়া উচিত?
যাই হোক। বুক্কা আমার সঙ্গে বেরোল। আমাদের বাড়ির সামনে ঘাট নেই। রাস্তা ধরে হাঁটলে বাঁ দিকে পাঁচ মিনিটেই বড়দের ঘাট পড়বে। সেখানেই নৌকো এসেছে। আরও এগিয়ে কালীমন্দিরের ঘাট, তারপর শ্মশানঘাট, তারপর ভাঙা ঘাট। বুক্কা বড়দের ঘাটে দাঁড়ালই না। আমার দিকে তাকিয়ে বলে গেল, বাবা, যাই ভূষণ কাকাকে দেখে আসি। ওকে অনেকদিন দেখিনি। একটু গল্প করে আসি। আমার মুখে ভয় দেখতে পেয়ে ও হেসে বলল, আমি বেশিক্ষণ থাকব না। তুমি মাকে বোলো আমার জন্য যেন দুটো মাছ রাখে, ভাজা ছাড়া।
অগত্যা হাতে মাছ ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। পেছনে পদু আর কার্তিক বলাবলি করছে, বাবুদের বাড়ির ছেলে হলে কী হবে, এ একেবারে অন্যরকম। ভূষণকাকার পাগলামির গল্প নইলে কে শোনে!
কেউ যেন তেতো গলায় বলল, ভুসনা বড় বেড়েছে। গত সপ্তা থিকে নৌকোয় মোমবাতি জ্বালছে। হ্যারিকেন কোথায় জিগালে বলছে, তোরে বলব কেন? মোমবাতির আলো জলে থলে অন্তরীক্ষে পড়ে। হ্যারিকেনের আলো কাচে আটকে যায়। বড্ড চালাক। মোমবাতি কেন জ্বালছে কেউ জানে না? পাগল বলে সব মাপ?
২.
ভূষণের নৌকো খুব দুলছে। ভাঙা ঘাট একেবারে অচল। কী করে যে ভূষণ ঘাট থেকে ওপরে ওঠে! বুক্কা ডাকল, ভূষণ কাকা। নৌকোর ভাঙা ছই থেকে দাড়ি-গোঁফে ভরা মুখটা বেরিয়ে এল।
ও! বুক্কাবাবু? এদ্দিন পর এসিচ? যেতি লৌকো ভেসি যেত? আজ ক’দিন ধরি খুপ টান। দেখতিছ কেমন টান? এসো এখেনে এসো।
বুক্কা খুব সাবধানে প্রায় বসে বসে শেষ ধাপে এল। এরপর এক লাফে নৌকোয়। বুক্কার ভারে নৌকো টালমাটাল দুলে উঠল। ভূষণ অনেক জোরে হেসে উঠল। বলল, প্রলয় হলি এমন হয়। জল কাঁপে থল কাঁপে, লৌকো এই ডোবে তো সেই ডোবে। তা এখন তো তেমনই সময়, কী বলো?
বুক্কা এ কথার উত্তর না দিয়ে বলল, দেখো কাকা, আমি তোমার কথা শুনতে এসেছি। তুমি যেসব বলো আর কেউ বিশ্বাস না করলেও আমি করি। তোমার গল্পগুলো আমি স্যারকে বলেছি। উনি আরও শুনতে চান।
অবাক চোখ মেলে ভূষণ বলল, মাস্টারমশাই? তারে তুমি আমার কতা বলেছ? বিশ্বেস করেছেন? বলো কী!
বুক্কা ততক্ষণে পাটাতনে বসে পড়েছে। পাদুটো ভেতরে গলাতেই গঙ্গার জল পায়ে লাগল। আর তখনই বুক্কার মনে হল, সে দরিয়ায় ভেসে গেছে। পেছনে সব ঝাপসা। সে বলল, বিশ্বাস না করার কিছু নেই। এই যেমন ধরো, তুমি এখানেও আছ আবার আরও অনেক জায়গায় আছ। তেমনই তোমার গল্পে যা বলেছ, সেসব আছেই। আমরা দেখতে পাচ্ছি না, এই আর কী।
ভূষণ হাসল, তুমি বেশ হেঁয়ালি শিকেছ দেখি। একটু খোলসা করো দিকি।
বুক্কা মাথা নাড়ল, না না। আগে তুমি গল্প বলো। এতদিন আসিনি। কী কী হল বলো।
আচ্চা, তবে বলি। ভূষণ দোক্তা ঘষতে ঘষতে মুখে ফেলল। কায়দা করে জিভের তলায় দাঁতের আগায় ঠুসে পাটাতনের ওপরে উঠে এল।
বুক্কাবাবু, সত্যি করে বলো তো, দরিয়া দেকতি পাচ্চ তো? তবে শোনো। আজ ক’দিন হল দরিয়া থেকি শব্দ এসেচে। কান্নার শব্দ ছিল আর বছরে। কিছুদিন যেতেই সে শব্দ রাগ করতি লাগল। কেরমে সে দুঃখ হল। এখন সে কেমন বিচ্ছিরি হাসচে শুনতি পাচ্চ?
বুক্কা বলল, দরিয়া কেন কাকা? সে তো দূর।
ভূষণ বলল, যখন বিষ্টি পড়ে, চারদিক ঝাপসা হয়ে নীচে ওপরে গাং হয়ে যায় তখন এইখানেই দরিয়া হাজির। বুঝলে? তখন দূর দরিয়া থেকে ভেসে ভেসে শব্দ আসে। আমি কি ছাই কোথাও যাই? দুনিয়ার শব্দ দরিয়ায় ভেসে পৌঁছে যায়।
বুক্কা বলল, তোমার কথা আমি মোটেই বুঝতে পারছি না কাকা। তবে সকলে বলছে, তুমি শ্রাবণ মাসে মোম জ্বেলে আকাশদীপ জ্বালছ। কেন কাকা? ও তো কার্তিকে জ্বালে।
ভূষণ থম মেরে গেল,– ওই যে বললুম, বিচ্ছিরি হাসির শব্দ! কত হই হই হল! তবু এক দেশ ভর্তি লোক কিচ্চু করতি পারল না। মেয়েটার হাসি ভাসছে কি না, তাই মোম দিচ্চি। ও দেখতি পাবে। আরাম পাবে মনে। একটা কেউ ওরে ভেবে আকাশে আলো দিচ্চে। তুমি তো বলছ আরও অনেক দুনিয়া আছে! তারই কোথাও ও থাকতি পারে। আমারে মেরি ফেললে আমিও সেথায় যাব। অনেকগুলো দুনিয়া আছে তো! কী বলো।
বুক্কা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ভূষণের হাত ধরল। বলল, কাকা আবার কাল আসব। তোমার জন্য অনেক মোম আনব। বাড়িতে আছে। জ্বালানো হয় না।
৩.
আমি বুক্কার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ভীষণ চুপচাপ গোছের ছেলে। ফিরে আসলে জানব ভূষণ কী বলল।
বুক্কা কেমন থমথমে মুখে ঘরে ফিরল। জিজ্ঞেস করলাম, কীরে? ভূষণ কি ভয়ের গল্প বলল নাকি! ও উত্তর দিল না। ভেতর থেকে ইলিশের গন্ধ আসছে। ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা, মাকে বলো আমি ইলিশ খাব না।
কেন রে? এই তো টাটকা ইলিশ খেতে চাইলি! আমি উৎকণ্ঠিত।
ও মাছে রক্তের আঁশটে গন্ধ। খেতে পারব না।
তা তো হবেই রে!
না বাবা। আমি আঁশটে গন্ধ সইতে পারছি না। ভূষণ কাকার নৌকো যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে গঙ্গার জলও আঁশটে গন্ধে ভরা। কে জানে ইলিশ না মানুষের থেকে ছড়িয়েছে! তুমি বরং আমাদের আর বছরের কেনা মোমগুলো ভূষণ কাকাকে দিয়ে দাও। আমি কাল আবার যাব, নিয়ে যাব। আমরা তো জ্বালব না, ওই জ্বালুক। ওর প্রাণের ভয় নেই বাবা।
আমি ভীষণ ভয় পেলাম। প্রায় দৌড়ে ভেতরে গিয়ে বুক্কার মাকে সব বললাম। অদ্ভুত মহিলা! বলল, আমি ভাবছিলাম। অন্তত ভূষণ জেলে ওকে সত্যিটা বলুক। আমরা যেন ভুলে না যাই। খুব রাগ হল। বললাম, তোমার এসব নীতিকথাগুলো প্যাঁটরায় তুলে রাখো। নিজেকে তো বাইরে বেরোতে হয় না, আমাকে বেরোতে হয়।
পরের দিন সকালে বুক্কাকে বললাম, দেখ বাবা, তুই হোস্টেলে ফিরে যা। তোর যা কাজ, সারাদিন মুখ নীচু করে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছিস। সেখানে বরং দরকারে তুই কারুকে পাবি। এখানে কেউ নেই। কী করবি এখানে!
বুক্কা চুপ করে আমার দিকে চেয়েছিল। অনেকক্ষণ। তারপর খুব ধীরে বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ বাবা? আমি চলে গেলে তুমি ভয় পাবে না আর?
আমি চুপ করে গেলাম। বুক্কা ঠিক বলছে। কাল ভূষণের কাছে যাব একবার। ওকেও সাবধান করে আসব। দিনকাল ভাল নয়। নিজের বুঝ পাগলেও বোঝে।
চিত্র: বিজন সাহা








One Response
অনুভবী গল্প এক। পড়ে নিজের দিকে তাকাতে লজ্জা হয়। ভূষণের মত পাগলেরা আমাদের নির্লজ্জতা দেখতে পায়, আমরা পাই না। সময় ঠিক চাবুক মারে। সেই চাবুকের মার আড়াল করে আমরা কী চমৎকার স্বাভাবিক থাকার অভিনয়ে নিজেদের পটু করে তুলেছি, এ গল্প সেই দিকটায় তর্জনী তুলে দেখাচ্ছে যেন !