Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

অশ্বেতর

১.
সারা দুপুর লিখে বিকেল প্রায় সন্ধ্যায় ঢলে গেছে। মার কাছে গিয়ে বললাম শুনবে?
বৃষ্টি আসছে দ্যাখ তো। পশ্চিমে মেঘ?
শুনবে কি?
তুই লিখেছিস?
না তো কী? ঝেড়ে এনেছি।
দু’ লাইন এগিয়েছি।
এই যে বার বার বলি কাগজটা চাপা দিয়ে রাখতে, যাঃ সব খাটের তলায় উড়ে গেল।
আমার পলতেয় আগুন লাগল এবার—
কী পেয়েছটা কী! আজ স্নান পর্যন্ত করিনি, সকাল থেকে মাথার ঘিলু নাড়িয়ে দিচ্ছে, চালকুমড়ো না গাজর কী খাচ্ছি বুঝিনি দুপুরে! কষ্ট হয় না? মাথাটা জলভরা গামছার মত নিংড়োতে হয় না? লেখাটা না নামা অবধি গা গুলোয় অস্বস্তি হয়।
ওমা এসব আবার কী কথা?
তুমি বুঝবে না—
চেঁচাচ্ছিস কেন? নীচে শেটবাবু অসুস্থ। বার বার বললাম এস.এস.সি-টা দে। কী হবে ছাইপাঁশ লিখে।
মা তুমিও…
অন্ধকার ঘন হয়ে আসে। পাখা ঘুরে চলে মাথার ওপর, চা খাওয়া হয় না আমাদের। একটা প্রায় পোষ্য কাক অনেকক্ষণ ডেকে ডেকে চলে গেছে। এই সময় সে বিস্কুটের জন্য আসে।

অফিসে একটা কথাও বলতে পারি না। মুখচোরা। ছ’ হাজার টাকা মাইনের কচুরি লেখক আমি। পাইস হোটেল লেখক।
সরবত লেখক। কুমড়ো দিয়ে পাঁচমেশালি ঘ্যাঁটের লেখক। মাঝেমধ্যে একটা বারশো শব্দের গল্প তাও যদি ফাঁক না ভরে তখন। নইলে সারাদিন ফোন।
পাহাড়ে ভ্রমণ সংখ্যা। কী কী ওষুধ নিতে হবে সাথে, তার জন্য ডাক্তারকে ফোন। আইনী পরামর্শ, তার জন্য উকিলকে ফোন। বিয়ের সংখ্যা, পার্লারে বিউটিশিয়ানের কনে সাজানোর টিপস। কভার স্টোরিতে সেলিব্রেটিদের মতামত, সারাদিন ধর্না ধরে বসে থাকো। কখনও তারা উদাসীন, কখনও বিরক্ত, কখনও দুর্ব্যবহার। শান্ত চিবোনো কাগুজে গলায় প্রশ্ন, কোন কাগজ?
বাংলার চোখ। ম্যাগাজিন।
ও। তা আমায় কী বলতে হবে?
ডায়াবেটিস অথচ মিষ্টি খাওয়ার প্রবণতা, এই নিয়ে একটা, দ্বিধা দ্বন্দ্ব।
আমার তো ডায়েবিটিস নেই?
মিষ্টি খাওয়া নিয়ে কোনও অভিজ্ঞতা বা মজার গল্প।
এখন তো সময় নেই, সন্ধে সাতটার পর। প্রতিক্রিয়া নিতে হয়। কোন একটা ইন্দ্রপতন ঘটলেই। এক প্রখ্যাত সুরকারকে প্রশ্ন করি, সুচিত্রা সেন চলে গেলেন আপনার প্রতিক্রিয়া?
দশ মিনিটে কী প্রতিক্রিয়া দেব? কেন দেব? কেউ একজন মারা গেল, আর আপনারা শকুনের পালের মতো বেরিয়ে পড়লেন? ওনার সম্পর্কে টেলিফোনে কিছু বলতে পারব না।
তা হলে বাড়ি যাই?
না-আ— বলে ফোন কেটে দিলেন।
আমাদের কান কাটা, লেগে থাকি। একটা জুলু প্রবাদ স্মরণ হয়, শকুনের চোখে পলক পড়ে না, শকুন ধৈর্যশীল প্রাণী।

২.
আমরা কভার করতে যাই। সম্পাদক অ্যাঙ্গেল ঠিক করে দেন। ‘মিষ্টি খাও ঘাম ঝরাও’— এটাই ক্যাপশন। ডায়াবিটিসটাকে হাল্কা করে দিতে হবে। বিক্রির ব্যাপার আছে। তমোনাশ ডাক্তারের পেছনে পড়ে থাকি। কী করে সুগার খেয়েও সুগার কম থাকে। ডায়াবিটিস এখন পপুলার ব্যবসা।
আজ সোমবার, এক-দু’দিনের মধ্যে শরবত শেষ করে মিষ্টি ধরতে হবে।
ঘেমেনেয়ে অফিসে ঢুকতে বিশুর সঙ্গে সিঁড়িতে দেখা।
হেনাদি তুমি নকুড় নন্দী, না গাঙ্গুরাম?
না না আমি তো মোয়া, জয়নগর।
সে কী, যাবে? না ফোনে?
দেখি যাব, এখন ক’টা বাজে রে?
প্রায় পাঁচটা।
ভীম নাগ, সেন মহাশয়, দুটোই আমার। নর্থের প্রায় সব। প্রসেনের ছিল, আমায় ভিড়িয়েছে।
ছানাবড়াটা কোথাকার যেন?
আরে আমায় বলেছিল।
কনট্যাক্ট নম্বর নেই? বিশু ফরসা ঠোঁটে মিচকে হেসে বলল।
তুই নদিয়ার নোলা, ক্যানিংয়ের লেডিকেনি, হুগলির সূর্য মোদক এগুলো প্রসেনকে রাজি করা। ছানাবড়ার নম্বর দিচ্ছি। বহরমপুর কে যাবে?
কোলকাতারগুলো চলো আমরা মেরে দি, নর্থটা তুমি, সাউথটা আমি। পাঁচ মিনিট করে দশটা মতো হয়ে যাবে।
সংস্কৃত মিষ্টি না ইতিহাসের মিষ্টি, কে লিখছে?
রিয়া আবার কে?
ফ্যানের হাওয়ায় বসে নেট ঘেঁটে চালাবে, আর আমায় গল্প আনতে জয়নগর যেতে হবে।
সুমিতদা করিডর পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে আসছে। ভুঁড়ির ওপর ক্যামেরার ব্যাগ ঝুলছে। আমাদের দেখে গতি কমিয়ে দিল, মুখে গান। ‘দিল অ্যায়সা কিসিনে তোড়ে, অমানুষ বানা দে মোরে’! ভুলভাল গান হচ্ছে মানেই সুমিতদা আসছে। এটা ওর পহেচান। বিশু বলল, ওই দেখো। বিশু হাসতে হাসতে বলল, তুমি কি মানুষ আছ?
কেন? আমি কী করলাম। দুপুর থেকে অমানুষের মতো ছবি তুলছি। কাল থেকে একটা দোকানেও মিষ্টি দিয়েছে? এত বড় বড় সব নামকরা দোকান।
কেন দেবে? ওরা তোমায় ডেকেছে? বিশু বলল।
আরে গাঙ্গুরাম বিখ্যাত দোকান, ওরা বিয়েবাড়ির অর্ডার নেয় না? আমি বিয়েবাড়ির ছবি তুলি না?
আমি আর বিশু হাসতে থাকি। সুমিতদার নিজস্ব লজিক আছে। সেখানে এই নশ্বর পৃথিবীর নিয়ম খাটে না।
আপনি আজ দুটো অন্তত সিঙাড়া খাওয়াবেন কিন্তু, আমার দিকে ঘুরে বলে। গত মাসে আপনার ভূতের ছবি তুলে দিলাম। রামদাসের কচুরি খেতে গিয়ে আপনার বাস এসে গেল। তবে ওই লোকটাকে ভুলিনি, ওই যে সুকিয়া স্ট্রিটে হ্যাপি গুন্ডা! কে বলবে মার্ডার-ফার্ডার করে, অমায়িক লোক। প্লেটভরে মিষ্টি, এগরোল। গুন্ডা-ফুন্ডাদের নিয়ে আরও দু’-চারটে স্টোরি করুন না।
খাইয়েছিল বটে।
কিন্তু ছবি তো তুলতে দেয়নি।
তাতে কী, এই যে সম্পর্কটা হল, কোনও বিয়েবাড়ি হলে, ডাকবে। নম্বরটা নিল তো।
হ্যাঁ, হ্যাপির বিয়ের বরযাত্রী যাবে তুমি। বিশু বলল।
তুমি নিজের মতো করে মিষ্টির দোকানগুলো তুলে নিয়ো সুমিতদা। চলো হেনাদি। আমি আর বিশু ওপরে উঠে গেলাম। সুমিতদা নিচে নেমে গেল ‘অমানুষ বানা দে মোরে’— গাইতে গাইতে।
অফিসে ঢুকে বাঁ দিকে কাচের দরজা খুলে চেয়ারে বসতেই, তাপসদা বললেন, তোমার জন্য কাজ আছে, পক্ষে-বিপক্ষে লিখে দিতে হবে দুটো। ঋষিকেশ বলে গেছে আমাকে।
বিষয় কী এবার?
‘শারদ সাহিত্যের মান নিম্ন গতি’।
তাপসদা আপনি লিখুন না। আমাকে বেরোতে হবে এখুনি। মাংসের বড়ার রেসিপি থেকে শিক্ষায় নিগ্রহ সবই কি আমায় লিখতে হবে?
আচ্ছা দিচ্ছি, প্রুফটা দেখেনি, লিখে দেবখন।
হল কী? মন বুঝি ভাল নেই।
মন ঠিক কেমন আছে, হেনা বুঝতে পারে না।
কী একটা অস্থির গুনগুনে পোকা খুঁড়ে চলেছে কিছু। মুখে বলল,
কী জানি তাপসদা, কেমন দম ধরে আছে। কী যেন একটা হবে। খররোদে শান্ত গাছের মতো তাপসদার গার্টার লাগানো ফোন টেবিলে ঘুমোচ্ছে। কাঁচাপাকা দাড়ি, সুতির পাঞ্জাবি, বহু দূর থেকে ট্রেনে আসেন। পাশে বসলেই, শান্ত মানুষটির কাছ থেকে সহনক্ষমতার তাপ এসে গায়ে লাগে। জ্বলন্ত হলুদ রোদে লাল পলাশ দেখলে যেমন চাপা রাগের মতো মনে হয়। সেই রকম একটা অশান্ত ক্রোধ টেবিলের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকে। একটু টোকা দিলেই খান খান হয়ে ভেঙে পড়বে।
তাপসদা?
উঁহু, কথা না।
আচ্ছা একটাই বলব। বলি?
বলো।
এপ্রিল মাস পেরিয়ে গেল। মে-র তেইশ। আর কবে হবে?
সেটাই তো প্রশ্ন। কবে? আমার তো মান্থলি আছে, শিয়ালদা থেকে রোজ হেঁটেই আসছি।
ঋষিকেশদা কিছু বলল? আপনারা একসাথে ফেরেন তো।
কাল একবার মালিকের আসার কথা, মিটিং হবে।
আচ্ছা তাপসদা, হেনা গলা আরও নামিয়ে আনে, বইগুলো বাথরুমের পাশে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে, এগুলো কি বিক্রি হয়নি? সার্কুলেশনের লোক আসতে দেখি না তো। ঘরে ঘরে বাতি জ্বলছে। এসি চলছে, ম্যানেজার না কে একটা ওই ঘরে বসে থাকে। টেবিল ক্যালেন্ডারে দাগ মারে। গম্ভীর হয়ে সিগারেট ধরায়। কেউ কেউ আসে আর চলে যায়। এরা কারা?
এরা সব ম্যানেজমেন্টের লোক। কোম্পানির অন্য সব বিজনেস আছে। এটা, দেখনদারি।
মানে?
কোথাও দেখতে পাও বই? কোন পত্রিকার স্টলে? ছাপতে বলছে, এখনও রান করছে, তাই আছে।
কিন্তু অনেকে ভাল বলছে, এটার ভবিষ্যৎ আছে বলছে।
এরা অনেক কিছুর সঙ্গে এটাও দেখিয়ে রেখেছে, ইনভেস্টমেন্ট। ভবিষ্যৎ তো তোমার-আমার। ওদের ভবিষ্যৎ অনেক উঁচুতে। জানো তো, অশোকব্রতবাবু লিখছেন না আর এ সংখ্যা থেকে।
এমা! ‘বঙ্গলোক’ বন্ধ হয়ে যাবে। ইস, কী ভীষণ ভক্ত ছিলাম আমি ওঁর লেখার।
স্বল্পভাষী ধীর তাপসদা হঠাৎ করে কথা থামিয়ে আত্মগোপন করে নেন অন্ধকারে। গুটোনো শামুককে আর খোলা থেকে বের করে আনা যায় না।
ভারী গুমোট মনখারাপ পাতলা ধুলোর মতো বিছিয়ে থাকে। টেবিলে, চেয়ারে, কাচের দরজায় অনিশ্চয়তার জলবিন্দু মলিন দেখায়। কম্পিউটার চলছে, চা আসছে। হাঁকডাক চলছে। পাতার ডিজাইন হচ্ছে।
তরুণদা পেজ ডিজাইনার সোল্লাসে সিগারেট ধরাচ্ছে, চিফ এডিটর বিমল আইচ হা হা করে হাসছে। মনেই হয় না দু’মাস পেরিয়ে গেছে স্যালারি পায় না তারা।

৩.
হেনা বিশুদের ঘরের দিকে যায়। দেখে সৌনক এসেছে। লম্বা দোহারা চেহারা গৌরবর্ণ। একটুকু মেদ নেই বলে লম্বা ডাঁটির আগায় হাওয়া দোলা ফুলের মতো দেখতে লাগে। ছেলেটা একটু অদ্ভুত। কারও দিকে তাকায় না। অফিস পিকনিক বা দেওয়ালি, পুজোয় আসে না। কারও বাড়ি নিমন্ত্রণ করলে যায় না। মিটিংয়ে কোনও মজার কথায় সবাই হাসলে ছেলেটা চারদিকে চায়। সবার হাসি ফুরিয়ে গেলে নিজে মৃদু মৃদু হাসে। ওকে ঘিরে জটলা।
প্রসেন বলল, হেনাদি সৌনক বড় কাগজে পেয়ে গেছে। ডিজিটাল ডেস্কে। চলে যাচ্ছে।
হেনা থেমে অভিনন্দন জানায়। সৌনক চোখ মিটমিট করে।
রিয়া ওকে ইন্টারভিউ করে ফেলেছে প্রায়।
কী করে পেলে? রিটন পরীক্ষায় কী কী এসেছিল?
ভাইভাতে কী কী জিগেস করেছিল?
অপর্না সেনকে দেখেতে পেয়েছ?
শীর্ষেন্দুবাবু কোথায় বসেন?
অ্যাঁ, আবুল বাশার, জয় গোস্বামী পাশাপাশি বসে?
জয় গোস্বামী নাকি পাউরুটি আলুসেদ্ধ খায় শুধু।
রিয়ার ঘন ভুরু আর অজিতেশের মতো গভীর চোখ মারকারি লাইটের মতো সৌনককে ফোকাস করে রেখেছে। হেনা বিশুকে ঈশারা করল, বিশু ব্যাগ গুছিয়ে উঠে এল।
রাস্তায় যেতে যেতে বিশু বলল, আর একটা দাঁড় খালি হল। হেনাদি তুমি ক’মাসের স্যালারি পাওনি?
দু’মাস, আর এ মাস তো শেষ হতে চলল। কেন? তুই?
আমিও একই। তবে শুনে রাখো, অনেকে কিন্তু পেয়েছে।
বিমলদা, ঋষিকেশদা, তরুণদা, স্বপনবাবু— দেখছ না সিগারেট চপ মুড়ি খাওয়াচ্ছে সবাইকে। গিল্ট।
বই বিক্রির কথাটা বলবে কী বলবে না ভেবে চেপে গেল হেনা।
শোনো, তোমায় একটা ভাল খবর দি, আমার দশটা গল্প এক প্রকাশক নিয়েছে, মনে হয় হয়ে যাবে। দুশো ছাপবে, দেড়শোটা আমায় দেবে। পঞ্চাশটা ওরা নেবে। এতগুলো বই নিয়ে কী করব বলো তো?
ছাতা যখন ফুটেই গেছে তখন বৃষ্টি নিয়ে ভাবিস না। বিমলদাকে বলিস, একটা বুক রিভিউ করে দেবে আমাদেরটায়।
ওই দেখো ৭৮/১, শ্যামবাজার যাবে তো?
এ তো আমার বাড়ির বাস। ইস, বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছে। আগে প্রায়ই অচেনা নম্বর বাসে উঠে যে জায়গাটা পছন্দ হত সেখানে নেমে পড়তাম।
সারাদিন ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম একা একা। একবার মধুসূদনপুর নামে একটা জায়গায় নেমেছি। বিশাল মাঠের শেষে সূর্য নামছে। চারপাশে যেন মিহি মশারি নেমে গেল। নীল নীল আলোকণা উড়ে এল। আলের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। বেগুনের খেতে সরসর করে জল যাচ্ছে নালি দিয়ে। কেমন বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে গেলাম।
মনে হল কে আমি? কোথা থেকে এসেছি? এখানে কী করছি? নামটাও মনে করতে পারছি না। হাত পা অসাড়, কোনও রোমান্টিক ব্যাপারট্যাপার নয়। কেমন একটা আত্মবিস্মৃত ভাব। হঠাৎ কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘হেই রে, খায়ে নিল, হ্যাট হ্যাট যা যা’। চটকা ভেঙে পেছন ফিরে দেখি একটা ছাগল আমার স্কাট চিবোচ্ছে। অনেকটা খেয়ে নিয়েছে। ক’টা বাচ্চা খুব হাসছে, একটা লোক ছাগল তাড়াচ্ছে।
বিশু হেসে ফেলল। সে কী গো, এসব তো সাধকদের হয়। কতবার হয়েছে এরম।
ছোটবেলায় অনেকবার হয়েছে, খেলতে খেলতে দৌড়ে বাড়ি চলে আসতাম। অনেক দূরে কী যেন একটা অস্পষ্টভাবে আছে। মাথার ভেতর শূন্য হয়ে যেত। ভারী একটা ওজনদার শেকল যেন এইমাত্র ছিঁড়ে গেল।
ডাক্তার দেখিয়েছিলে? খুব তীব্র রোমান্টিক মন হলে এইরকম হয়।
হেনাদি তোমার বাস! চলে গেল।
ওঃ ছেড়ে দে পরেরটায় যাব।
তা হলে চলো চা খাই। আমার মনে হয় তোমার কিছু কিছু লেখা উচিত, মানে নিজস্ব লেখা।
হেনা লজ্জায় বলতে পারল না। একটা গোপন খাতা আছে তার। সেখানে ধীরে পল-অনুপল, বিপল, দণ্ড, মুহূর্ত ছাপা হয়ে চলেছে। একটা কম্পনমালা, একটা দোলনা একবার আলো থেকে অন্ধকারে, আবার আলোয় সঞ্চরণ করে চলেছে।

৪.
ঝড়ের উত্তাল বাতাস বইতে লাগল দশদিন কাচের ঘেরাটোপে থাকা চার খুপরির এই জায়গাটায়। কখন বিকেল হল কেউ জানল না। কাচঢাকা জানলার বাইরে কার্নিসের পায়রাগুলো গম্ভীর মুখে এ দিকের দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করে, পায়চারি করে, নিজেদের মধ্যে দুলে দুলে হেঁটে হেঁটে সন্ধের দিকে কোথায় চলে যায়। মিষ্টি সংখ্যাও বের হয়ে গেল। প্রচ্ছদে রসগোল্লার বাটির ওপর ঈষৎ কোনাচে একটা চামচে, একটা রসগোল্লা একটু উঠে আছে। এমনভাবে আলো পড়েছে মায়াময় সাদা গোল্লার ওপর ভেতর থেকে একটা তাড়না উঠে আসবে টপ করে তুলে নেবার। ‘সুগার হলেও মিষ্টি খাওয়া যায়’? এই লাখ টাকার প্রশ্নটাই রেখে ঢেকে কৌশলে প্রেজেন্ট করা হয়েছে। বিক্রি হলে হিট হত নাকি হিট হলে বিক্রি হত, জুনিয়রদের ঘরে এইসব আপ্তবাক্য উড়ন্ত পালকের মতো হাল্কা হাওয়ায় ওড়াউড়ি করে ধীরে টেবিলের নিচে, মেঝের কোনায় অন্ধকারে থিতিয়ে পড়ে।
জুন মাসের শেষ, রোদ নরম হয়েছে একটু।
সাতাশ টাকা, চৌত্রিশ টাকা,পঞ্চান্ন টাকা এইসব ট্রেন-বাসের ভাড়ার হিসেব ছোট ছোট স্লিপে খুদি খুদি অক্ষরে লিখে বড় ঘরটায় দিয়ে আসি। ভদ্রলোক পত্রিকার সূচিপত্রে কর্মধ্যক্ষ নামে আছেন। তবে তাঁর কর্মটা অদৃশ্য কিছু একটা। কর্মপদ্ধতিটা জবর জাঁকালো। লম্বা লম্বা দামি সিগারেট, ডিওর গন্ধ। অনন্ত জিজ্ঞাসা বাসনা-মাখা লম্বাটে মুখ। চুলগুলো টেনে পরিপাটি করে পেছনে তোলা। যাতায়াত ভাড়া সংক্রান্ত ক্ষুদ্র স্লিপ দিয়ে দাঁড়ালে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। চোখ দিয়ে জুমিং করেন তারপর ক্যাপচার করেন। প্রশ্ন করেন।
ধর্মতলার মোড় অবধি এখান থেকে কতটা?
অ্যাঁ? অন্যমনস্ক হেনা।
রিক্সায় যেতে হল? হেঁটেই তো যাওয়া যায়।
তাড়া ছিল, ভদ্রলোক বেরিয়ে যাবেন বলেছিলেন।
ও আচ্ছা।
রমানাথ কবিরাজ লেন। এটা কোথায়?
বউবাজার।
সোনার দোকানে নাকি?
না না, শঙ্করবাবুর ইন্টারভিউ।
হাঁটবেন, শরীর ভাল থাকে।
হাঁটতে আমারও ভাল লাগে। গোটা একটা দিন শুধু হাঁটব। তারপর বাসে উঠে যেখানে খুশি চলে যাব। আইসক্রিম খাব। কলেজ স্ট্রিটে ফলপট্টির তরমুজের গাদার ওপর বসে গামছা ঘুরিয়ে হাওয়া খাব।
কোথায় বাড়ি আপনার?
সারদা মঠ যোগদা মঠের মাঝখানে।
ভদ্রলোক চোখ কুঁচকে বাসের টিকিটের চেয়ে একটু বড় ফালি কাগজটায় তাকিয়ে আছেন। বিড়বিড় করলেন, বাঁটুলদার খিস্তি! খালাসি কখনও পেছন চুলকায় না। মুখ না তুলে বললেন, এগুলো কী?
ওঃ সরি, ওগুলো আমার পার্সোনাল নোট।
ঠিক আছে যান, বিকেলে নিয়ে নেবেন।
চল্লিশ থেকে একশো টাকা বড়জোর ব্যাগ ঝেড়ে পাওয়া যাবে। দশ টাকার চাউমিন, তিরিশ টাকায় চিলি চিকেন এসব এখন অতীত। চওড়া গোঁফ ঝাঁকড়া চুল ওড়িয়া চাওলা জয়রথো চা দিয়ে যায়। আগে কোম্পানি দাম দিত, এখন দেয় না। হেনা চিনি খায় না বলে ‘দিদি আপনার বিনা চিনি’ বলে আলাদা করে টেবিলে রাখে। হেনা ঘরে ঢুকে দেখল টেবিলে চা। হেনা চেঁচিয়ে বলল, চা লাগবে না। নিয়ে যাও। সুমিতদা পেছনে বসে ঝিমোচ্ছে। মাঝে মাঝে চটকা ভেঙে উঠে লাল চোখে তাকায়।
আরে বিশু, তুই আমায় ভূতের সিনেমা দিলি না। আমার বউ খুব ভালবাসে দেখতে। একটু বেশি ভয়ের কোনটা হবে?
কী রকম চাইছ? বিশু বলল।
ইংলিশ ভূত না, খালি বাড়ির মধ্যে ঘোরে। অত্যাচারের দৃশ্য থাকবে, ভূত অত্যচার করছে।
তুমি ক্রিপ দেখেছ? ভূত-ফুত কিছু লাগবে না পরিষ্কার দিনের আলোতে ভয় পেয়ে যাবে।
দে না ভাই, দে না। ইংলিশ না বাংলা?
নাম শুনে তোমার বাংলা মনে হল? দূর হাতের কাছে ক্রিয়েচার আছে ওটা নাও।
না না ওই ক্লিপ না কি বললি ওটাই ওটাই।
জয়দীপ হঠাৎ বিশুকে জড়িয়ে ধরল, ভাই তুই কী ফরসা!
গোল গোল চোখ চওড়া জুলফি প্রসেন টিনটিনের রাস্তাপপুলাসের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল জয়দীপের দিকে।
সুমিতদা কিছু মন্তব্য করবে না তা হয় না, অ্যাঃ তোদের কি জোটে না নাকি? তারপর চেয়ারে আধশোয়া হয়ে গান ধরল। ‘হে আমার গুরু দক্ষিণা। তার শুভ আমার শুভ, শ্যামা মা কি আমার কালো”।
তারপর হেনার দিকে ঘুরে বলল, আপনার কোন সালে যেন মাধ্যমিক?
হেনা হাঁ করেছিল, হঠাৎ কর্মধ্যক্ষ ঘরে ঢুকল। এ ঘরে সাধারণত তিনি আসেন না। সবাই যে যার কম্পিউটারের সামনে বসে ছিল। ঝপাঝপ ফেসবুক বন্ধ হয়ে গেল। জয়দীপ টাইপ করতে লাগল। রিফ্লেক্সানে অ্যাকশান শুরু হয়ে গেল। সুমিতদা পেছন ফিরে দেখতে পায়নি। গান গাইছে।
আপনার কিছু কাজ নেই?
ক্লাশে যেন হেড স্যার ঢুকেছে। সুমিতদা উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।
বসুন বসুন।
ভদ্রলোক সুমিতের কম্পিউটারের দিকে এগিয়ে গেল। দেখি কী করছেন।
এই ডিজাইন করছি। শিখছি তরুণদার কাছে।
সুমিতদার স্ক্রিনে এক সার ঝকঝকে কঠিন দাঁতের সারি দেখা যাচ্ছে। একটি মেয়ের ঘাড়ের ওপর নিবদ্ধ।
বাবা! নররাক্ষস নাকি?
রেপ রেপ। রেপ সংখ্যা। স্যার আমি ডিজাইনটা ভাবছি।
কে একটা খুঁক করে হাসি চাপল। সুমিতদা উৎসাহে আরও ক’টা ছবি দেখাতে লাগল।
বাঃ আপনার অপূর্ব আইডিয়া। মনে হচ্ছে আন্দামানের অসভ্য আদিবাসী নরমাংস খাচ্ছে। ম্যাগাজিন উঠে যাবে।
উঠেই তো গেছে। তিন মাস মাইনে নেই। সুমিতদা টপ করে বলে বসল।
সবাই শূন্য দেওয়ালে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কী যেন দেখতে লাগল। যেন কিছু কেউ শোনেনি।
এসব অফিসিয়াল কথাবার্তা আজ দুটোর পর মিটিংয়ে হবে। আপনার যেটা কাজ, যে জন্য আপনাকে রাখা হয়েছে, সেটা করুন। ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন।
বিশু বলল, আরও ভুলভাল গান গাও জোরে জোরে।
আমি কী করব? কত ছবি তুলব? দেখলি কেমন বলে দিলাম, তোদের তো সাহস নেই।
চেয়ার ঘুরিয়ে প্রসেন বাঁ দিকে ঘুরল। বাঁ দিক থেকে গোল চোখ জুলফির ওপর টিউবের আলো পড়েছে। টিনটিনের ক্রিমিনাল রাস্তাপপুলাস। মুখে শুধু চুরুটটা নেই। ঝুঁকে বলল, সেদিন বিমলদা তোমায় গান গাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের করে দিল, তুমি দরজা দিয়ে উঁকি মারছিলে, তখন চুপ করে অপমান গিললে কেন? রাস্তাপপুলাস মাপতে লাগল সুমিতদাকে।
ছাড় তো ফালতু লোক। একটা রুমাল নেই, ছেঁড়া জাঙিয়া দিয়ে মুখ মুছছে।
চুপ রাস্তাপপুলাস মুখে আঙুল ঠেকাল। বউদি কোচবিহারে পোস্টিং, কিছু খুঁজে পায় না ভদ্রলোক। তোমার মতো?
বউ চিংড়ির চচ্চড়ি রেঁধে দিচ্ছে।
বউ যদি জানে তিন মাস মাইনে নেই, চুল ছিঁড়বে। সিরিয়ালের মেয়েগুলোর জন্য বেঁচে যাচ্ছি। এই বিশু ক্লিপটা দে না, ভাল ভয়ের হবে তো। আর কিছু তো নিয়ে যেতে পারি না, এটা দে অন্তত।
ক্লিপ না ক্রিপ। সাইকোলজিক্যাল ট্রমায় মরে যাবে।
‘ক্রিপ ক্রিপ’ করে দু’বার আওড়ে সুমিত বলল মানে কী রে?
উম, বলতে পারো সবার অলক্ষ্যে হামাগুড়ি দেওয়া, গোপনে প্রবেশ করা।
হামাগুড়ি দিয়ে মারবে? দে না এখনই মোবাইলে দেখি।
না না, দুটো বাজতে দশ। এখুনি বড় ঘর থেকে ডাকবে।

Advertisement

৫.
কেউ অবশ্য ডাকল না, শুধু বিমলদা আর ঋষিকেশদাকে নিচের অফিসে ডেকে পাঠাল। সন্ধে অবধি বসে বসে কেউ কিছু জানল না। দুটো হাফপ্যান্ট পরা লোক এসে বাথরুমের পাশে প্যাসেজ থেকে বইগুলো তুলে নিয়ে চলে গেল। জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল, গুমসো সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে দু-চারটে আরশোলা ছুটে পালাল।
তাপসদা ঘর থেকে বেরিয়ে ঈশারায় ডাকল। হেনা উঠে ও-ঘরে গেল।
একটা লেখা লিখবে? নতুন পত্রিকা। পয়সা দেবে। ছোটবেলায় যে-সব খেলা হারিয়ে গেছে, সেই নিয়ে।
কত দেবে?
দেড়শো-দুশো। এখনও একটা গোটা কাতলা হয় এই টাকায় আমাদের ওদিকে। চোখ বুজে হাসল।
বউদি বুঝি খুব কাতলা রাঁধে? বউদির কোন রান্নাটা ফেভারিট তাপসদা?
মূলো চচ্চড়ি, পুঁটির ঝাল আমার তো আলাদা কিছু লাগে না। সবই ভাল। আমাদের তো খেত ছিল। টাটকা সব্জি নুন-তেল দিয়ে ফোটালেও সুবাস হত। মাথায় করে ভোরবেলা বড় রাস্তায় বেগুনের ঝুড়ি কত পৌঁছে দিয়েছি ভ্যানে। লিখে ফেলো না কোনার দিকে বসে।
যদি ওরা ডাকে নিচে।
দূর তুমিও। সার্কুলেশানের লোকের সঙ্গে নাকি বসা হবে, বইগুলো ছাড়বে বাজারে। আমাদের কেন ডাকবে।
অ্যাঁ, এই ছাতা-পড়া পুরনো বইগুলো?
নারে বাবা! এটা একটা মানি মেকিং কোম্পানি। গলা খাটো করে বলল। লোকের কাছ থেকে টাকা তুলে অনেক সুদসমেত ফেরত দেবার আশ্বাস। গ্রামেগঞ্জে খুব চলে। তার জন্য অনেক ব্যবসা দেখাতে হয় ওদের। না না, ইনভেস্টমেন্টের বাহার না থাকলে লোকে টাকা রাখবে কেন। বিশুও তো টাকা রেখেছিল, ওদের এজেন্ট এসে নিয়ে যেত। দেখো ফেরত পায় কি না। এজেন্টরা কুড়ি-পঁচিশ পারসেন্ট করে কমিশন পায়। তাই তো চারপাশে এত এজেন্ট।
তার মানে ম্যাগাজিনটা কিছু না। এটা দাঁড় করানোর কোনও উদ্যোগ ছিল না ওদের? একটা টিম তৈরি করে অফিস খুলে বসে গেছে?
তাই বলতে পারো।
আপনি জানতেন?
নাঃ! লেখার কাজ, তাই লোভে এসেছিলাম, আর কিছু তো পারি না।
ধর্মতলার দিকে ঢ্যাঙা তালগাছের পত্রপূর্ণ মাথার দিকে তাকিয়ে থাকে হেনা।
নিজের টেবিলে এসে লিখতে বসে। শৈশবের খেলা-ফেলা কিছুই মাথায় আসে না। কত মধ্যাহ্ন সে কাটিয়েছে এই জানলার দিকে চেয়ে। কত খরদীপ্ত, উত্তপ্ত, উদভ্রান্ত, ক্ষুধার্ত হাঁটা কোলকাতার গলিতে, রাস্তায়। যানস্তব্ধ কোলকাতার ধোঁয়াভরা ঝাপসা আকাশ, শীত-সন্ধ্যার বিষণ্ণ অস্বচ্ছ ভেপার ল্যাম্পের আলো, কখনও ঝমঝমে শ্রাবণের মনখারাপ বিকেল। কত মানুষের নড়াচড়া, কথা বলা, ঘাড় নাড়া, তাদের অকারণ বসে থাকার মধ্যে কোনও একটা বিদ্যুৎ চমক খুঁজেছে। সেইটুকুই তার নিজের লেখা। কোনও সংখ্যা কোথাও বেরোয়নি। কেউ পড়েনি, বাথরুমের পাশে ডাঁই হয়ে ছিল। নিয়মিত দক্ষতায় পাতার পর পাতা, সাজানো, ছোটাছুটি, অ্যাঙ্গেল তৈরি, ম্যাটার, প্রুফ চেকিং হয়, শব্দ বসে, শব্দ উঠে যায়, শব্দ তীক্ষ্ণ বাঁক নেয়।
দড়ির গাঁটে বাঁধা প্যাসেজে পড়ে থাকা ওই স্তূপে তার লেখা নেই।
সে দূর অনিশ্চয় কোনও গর্ভে আছে। মাঝে মাঝে হাত খুলে গাঢ রং দেখে নেওয়া, সে কতটা ফিকে হল। কত শ্যাওলা পুরনো হল তার শরীরে।

৬.
প্রসেন দরজা ঠেলে ঢুকল।
হেনাদি তাপসদা নিচে ডাকছে প্যাকিং করতে হবে।
সেটা কী? কোন বাঁদর নাচ?
মৃদু হাসি শান্ত চোখ টেবিলে বন্ধ কলম রেখে তাপসদা উঠল।
প্রসেন বলল, কী জানি আমিও বুঝিনি।
সুমিতদা পাশ থেকে হাত তুলল। আমি জানি। ম্যানেজারের সঙ্গে যে লোকটা থাকে অসীম নস্কর, ও বলছিল, মালিকের এলাকায় কাঁথি, ভগবানপুর ওসব জায়গায় বই বিক্রি হবে।
সুমিতদা ঘোড়ার মুখের খবর দিয়েছে, সুমিতদা আগে আমরা সার বেঁধে পেছনে চললাম। ওড়িয়া চাওলা জয়রথো ঢুকতে যাচ্ছিল।
দিদি বিনা চিনি…
এখন না।
দু’দিনের দশ টাকা বাকি।
দিয়ে দেব।
নিচে একটা ঘর খালি করে বইয়ের গাঁটরিগুলো টেবিলজোড়া দিয়ে তুলে দিয়েছে। প্যাকেট করতে হবে এক প্যাকেটে পাঁচটা করে পত্রিকা। দশ টাকা দাম হলে পাঁচটা পঞ্চাশ টাকা কিন্তু পাওয়া যাবে হাফ দামে। পঁচিশ টাকা। সিঁড়ি দিয়ে উৎসাহে নামতে লাগল সবাই, বই বিক্রি হবে বকেয়া টাকা দিয়ে দেবে।
আমরা হাত ধুয়ে নেমে পড়লাম। হালখাতার মিষ্টি প্যাকেট হচ্ছে যেন।
একটা গজা, একটা ক্ষীরকদম, একটা দানাদার, চমচম, সিঙাড়া একটা করে। কর্মধ্যক্ষ ভদ্রলোক প্রথম দিকে তত্ত্বাবধান করছিলেন।
ওসব ‘বাংলা সাহিত্যে চোর’-ফোর নয়, আমি বেছে দিচ্ছি। ‘জাপানি তেল’-টা দিন, রসগোল্লার ছবিওলা ওটা দিন। আর একটা ফুটবল, আর ধর্ষণ দিয়ে দিন একটা করে। প্রত্যেক প্যাকেটে যেন সমান থাকে। গুনে নেবেন।
সম্পাদক, সহ-সম্পাদক মাথা নিচু করে বসে আছে। কেমন কালো হয়ে গেছে ঋষিকেশদার মুখ। বিমলদা হঠাৎ বলে উঠল, ‘দেখতে খারাপ মাখতে ভাল’।
সবাই তাকাল। বিশু ফিসফিস করে বলল, মার্গো সাবানের বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন না? এখনও ক্যাচলাইন ভাঁজছে!
সুমিতদা চেয়ারে, অবশ্যই গা এলিয়ে।
সবাই মনোযোগ দিয়ে প্যাকেট করছে। এডিটর দু’জনকে কি পাহারায় রেখেছে? হেনা ভাবছিল কোম্পানির কী সব পটারি-ফটারি আছে। বড় বড় বাক্সে খড় দিয়ে প্যাকিং হয় দেখেছে, কাল থেকে সে-সবও করাবে নাকি?
ভরো, মাঙ মুঝে ভরো, করো পেয়ায় মুঝে করো। চেয়ারে এলিয়ে সুমিতদা সেক্সি গলায় হঠাৎ গেয়ে উঠল।
বিমলদা একেবারে খেপে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। চশমা খুলে হাতে।
কী হচ্ছে কী? উদগান্ডুর মতো গান গাইছ কেন তুমি? তোমার কোনও সেন্স নেই? বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো কী করছে দেখছ না, তুমি কেন বসে আছ?
সুমিত ভড়কে গিয়ে গান থামাল।
আমি কি লিখেছি নাকি?
মানে? তুমি টিমের লোক নয়? কোনও স্পিরিট নেই?
বাচ্ছা ছেলেমেয়ে বলবেন না। আমি কি বুড়ো নাকি? আপনার কত সালে মাধ্যমিক? হেনার দিকে ঝুঁকে বলল সুমিত।
হেনা গম্ভীর হয়ে বলল, আমি এইট পাশ।
বিমলদা উত্তেজিত। স্কাউন্ড্রেল ইররিলেভেন কথা। তুমি বেরোও। কাল থেকে তুমি আর আসবে না। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে নেব।
হে হে, সুমিতদা ভুঁড়িতে হাত দিয়ে হাসতে লাগল। আসব, কিন্তু আপনাদের ঘরে না। আমি অন্য ফিটিং করে নিয়েছি। আপনি তো মাইনে পান। গলায় জোর আছে। আমি তিন মাস ধরে বাড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে চলছি। রাত করে বাড়ি ঢুকি। দিন না একটা অন্নপ্রাশন কী বিয়েবাড়ি। নয়তো ফোটো শুট করিয়ে নিন। ভাল অ্যাঙ্গেলে তুলে দেব। আপনি ম্যাগাজিনের মধ্যে বসে চুরুট খাচ্ছেন।
ফাজলামি কোরো না। বিমলদা একটু নরম। সবাই সেই সুযোগে হাসতে লাগল।
সুমিত দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, কাল থেকে আসব না। চার টাকার চা খেয়েছিলাম, ধাঁইকিড়ি কিড়িটাকে দিয়ে দেবেন।
গটগট করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আবার ফিরে এসে মুখ বাড়িয়ে বলল, ও দুটো সন্দেশ বিস্কুট, ওটাও দিয়ে দেবেন।
উফ! কী ধুলো বলে রিয়া হাঁচতে লাগল।

৭.
এরপর একদিন দুপুরের পর একটু অলস যাচ্ছে সময়টা, গুলতানিই চলছে মূলত। হিন্দি সিনেমার রেড করার দৃশ্যের মতো তিনজন পুলিশ ঢুকল। হুটহাট ঘরগুলো ঢুকে একবার দেখে নিল।
বিমলদা এগিয়ে এল।
নোটিস কোথায়?
কীসের নোটিস?
এই স্পেসটা বিক্রি হয়ে গেছে, পার্টি পোজিশান নিতে পারছে না। আপনাদের ছেড়ে দিতে হবে জায়গা।
বিমলদা বিস্ময় গোপন করে দারুণ ভদ্র ইংরেজিতে বলল, আমরা কোনও নোটিস পাইনি।
তিন দিনের মধ্যে ব্যবস্থা করবেন, নইলে সব ক’টাকে থানায় নিয়ে যাব।
কেন আমরা কি ক্রিমিনাল? ফুটন্ত খইয়ের মতো ইংরেজির মুখে ঢ্যাঙা পুলিশটা থতিয়ে গেল।
তার বদলে ভাঙা বাংলা মেশানো হিন্দিভাষী একজন গোঁফওলা চিমসে এগিয়ে এল।
কী করবেন করে নিন, বলে বিমলদাকে শার্টের হাতা গোটাতে দেখে আমাদের গোপন আনন্দ হচ্ছিল। তারকাটা, ঈষৎ ইলম্যানার্ড ব্যক্তিটি যে কলেজি রুস্তম জানা ছিল না! শেষ পর্যন্ত চশমা হাতে নিয়ে ঠান্ডা গলায় যা বললেন, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, আপনার অণ্ডকোষ আপনার পকেটে পুরে রাখুন আমাদের কিছু ছেঁড়ার নেই।
শেক্সপিয়ার, কাফকা, প্যারাডাইস লস্ট কিচ্ছু না দিয়ে ভদ্রলোক যে ঠেকের ভাষা দিয়েছেন, তাতে আমরা আপ্লুত। তরুণদা চোখ টিপে আমাদের বলল, ভুলিস না, আমরা বারদুয়ারির মাল।
বিশুকে বলল, তুই কাল ক্লক ওয়ার্ক অরেঞ্জ দেখেছিস বললি, তাই একটা সিগারেট পাওনা হয়। নে।
বিশু মাথা চুলকে বলল, খাই না।
আমরা বইপত্র, চেয়ার-টেবিল সমেত বিক্রি হয়ে গেছি জেনে হাসাহাসি করলাম।
প্রসেন একটা কবিতা লিখে ফেলল। ভোঁতা অনুভূতি থেকে ধুলো ঝেড়ে আমরা বললাম, সাধু! সাধু!
এক মাস আমরা আশায় রইলাম। বইয়ের প্যাকেট বিক্রি হল কি না জানা যায় না। দু’দিন তিন দিন পর অফিসে আসি, খবর নিতে। মা বলে, রোজ বেরোচ্ছিস না যে? উঠে গেল নাকি? সেই কইখালিরটার মতো?
ওটা ক্লোজডোর ট্র‍্যায়াল ছিল মা। চালুই হয়নি।
ওই হল, একই তো। বললাম এসএসসি-টা দে। এখনও সময় আছে।
বিশু একদিন সিঁড়ির তলায় ডেকে নিয়ে বলল, আমি একটা কাগজে পেয়েছি। ডেলির রোববারে। এই মাসেই জয়েনিং। জানো তো বিয়ে করেছি, চাকরি ছাড়া আমার চলবে না। তুমি কোথাও চেষ্টা করছ? রিয়া তো এসএসসি-তে বসছে।
আমি? হেনা বিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বিশু বলল, আমি শুনলাম ছ’মাসের টাকা এক বারে দিয়ে দেবে। দিলে খবর পাব, নিতে আসব। কেমন দৈববাণীর মতো শোনাল বিশুর কথা। কোথা থেকে শুনতে পায়, কোন টেলিকমিউনিকেশনে ধরা পড়ে এইসব সাংকেতিক খবর।
জয়দীপ চলে গেছে, রিয়া আসে না। রাস্তাপপুলাস চেয়ারে বসে কবিতা লেখে আপনমনে। বিশু চলে যাবার দিন সবাই মিলে ছবি তোলা হল। সুমিতদা উঁকি মারছিল দরজা দিয়ে ওকেই ডাকা হল। তুলে দিল।
‘স্বামী স্ত্রী আর ময়না টিয়া অগাধ সম্পত্তি আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম’ গাইতে গাইতে চলে গেল।
একটু একটু করে দেখলাম কেমন মন্থর গতিতে এক আশ্চর্য সাবলীলতায় উঠে গেলাম আমরা। এই তো দুদিন বাদেই শুরু হবে। প্রেসের বকেয়া, টাকা মিটিয়ে দেবে মালিক পক্ষ। রোজ এসে বসি। কী অদ্ভুত এই অনন্ত বসে থাকা। যেন পড়তে এসেছি কোচিং ক্লাসে, মাস্টারমশাই
আসেনি। হাতে হাতে বই ধরা। এত অখণ্ড মনোযোগ! এত অখণ্ড অবসর! আহা কী সুগভীর আনন্দ বিষাদের ঊর্ধ্বে এই তন্ময় বসে থাকা। আমাদের নাকি ভাঙা ম্যাগাজিন আবার হবে। কানা ছেলেকে আবার পদ্মলোচন বলবে সবাই। চাওলা জয়রথো বিনা চিনির চা দিতে ভুলে যায়। বিস্কুট সাধে না আর। আগে দিনে দশবার আসত। এখন উঁকি মেরে দেখে যায়।
‘ওঃ আপনারা এখনও বইসে আছেন!’
কর্মধ্যক্ষবাবুর ঘর ফাঁকা, ফ্রিলান্স লেখকদের ভিড় লেগে থাকত। বাতাসে ধোঁয়ার ঘূর্ণি উঠত। এসিটা ঘ্যার ঘ্যার শব্দে কিছুক্ষণ কঁকিয়ে বন্ধ হয়ে গেল একদিন। পাখা ঘোরে না। লাইট একটা একটা করে নিভতে লাগল। মরা আরশোলার ছ্যাতরানো ডানা পড়ে থাকে টেবিলে। বই পড়ি, ভাল লেখা পেলে পরস্পরকে এগিয়ে দিই সিগারেটের কাউন্টারের মতো। কাগজ টেনে নিয়ে লিখি হাবিজাবি। আর বলি, আমার হবে। বন্ধ কম্পিউটারগুলো অন্ধকার বোবা দৃষ্টিতে ভোঁতা ছুরির ফলার মতো তাকিয়ে থাকে। সম্পাদকের কম্পিউটারটা এখনও চলে। তবে মাঝে মাঝে রহস্যময়ভাবে নেট চলে যায়। মেন অফিস থেকে চা আসত, দুধ চা, শীতে কফি, দামি বিস্কুট। ক্রমশ শুধু লিকার, তারপর গুনে দেখে যায় ক’টা কাক এখনো বসে আছে।
চালাকরা আঁচ বুঝে দাঁড় ছেড়ে উড়ে গেছে আগেই। অনেক পরে শেষবেলায় যখন কাচের জানালা দিয়ে এক বিষণ্ণ বিকেল উঁকি মারে। চিল ওড়ে দূর আকাশে। ধর্মতলার দিক থেকে আযান আরম্ভ হয়। দুপুরের নিঝুম কেটে নীচ থেকে ভেসে আসে গোধূলির হকারের গুঞ্জন। চাঁদনি বাজারে সার সার জ্বলে ওঠে টুনি, রাইস চেন, লাল নীল, সবুজ কায়দার আলো। দেওয়ালির ফলস মোমবাতি। অসীম দাক্ষিণ্যে তখন তিনটে কষা লিকার রেখে যায় ওরা। মধ্য দুপুরে সম্পাদক বলে, ‘গরিবের ছেলের আবার খিদে কী এত! যাও দশ টাকার মুড়ি আনো।’
প্রসেন ইতস্তত করে বলে, দশ টাকার চাউমিন আনব?
নাঃ হে, গার্টারের ওপর কুমড়োর জল আমদানি করো না।
জয়রথো আসে মাঝে মাঝে, বলে, ‘দেশ থেকে পিঠা এনেছিলাম, গুলগুলা, খাবেন? এঃ হে হে এমনি, পয়সা লাগবে না।’
ঋষিকেশদা বলে, দাও হে তোমার চুলবুলাই দাও দেখি।
তরুণদা তখন বার করে একশো টাকার একটা গোটা নোট। সবাই শ্বাস ছাড়ে। স্যালারি ঘরের পাশ দিয়ে যাই। সিঁড়িটা ব্যাঁকাচোরা অসমতল মনে হয়। ঘরে ঝুল ওড়ে। ম্যাটার রেডি রাখো, যেকোনও দিন বেরোতে পারে, এ ক’জনেই করব। চোখ সচল রেখেছি। মাথা ঠান্ডা রেখেছি। কোনও অবজারভেশন দৃষ্টি এড়ায় না। কোনও গন্ধ, সামান্য শব্দও র‍্যাডারে ধরা পড়ে। জানোয়ারের মতো ওত পেতে থাকি। ম্যাটার রেডি রেখেছি… বেরোবে। বন্দুক থেকে ছিটকে বেরনো গুলি থেঁতলে দেবে সব। ম্যানি মেকিং, চিটফান্ড খুব শোনা যেতে লাগল খবরে, ধরাও পড়ল পাণ্ডারা। সুমিতদা উঁকি মারে, ইশারায় ডাকে, জিগেস করে— পেলেন কিছু?
তার ফিটিংয়ের কী হল, কে জানে?
সবাই অন্য জায়গায় চেষ্টা গোপন রাখে, যার হয় সে টপ করে খসে যায়। প্রুফরিডার তাপসদা কোনায় বসে লিখে চলেন।
উপন্যাস? কোথায় দেবেন দাদা? পয়সা দেবে? বাঁশে পেরেক মারে যে সেও পয়সা পায়।
একটা লেখায় দেড়শো টাকাও তো দিতে পারে। একটা গোটা রুই মাছ হয় তাতে, না না কাতলা। মাথাটা জলভরা গামছার মতো নিংড়োতে হয়। তাপসদার কথাই তাপসদাকে বলি। হাসে। পাশে গার্টার লাগানো মোবাইল, বিবর্ণ ম্যানিব্যাগে বউয়ের ছবি। শান্ত স্থির নীরব হাসিতে ঘরের অন্ধকার কাটে না। ঘরে তালা পড়ে যায়। নিচের অফিসের বাইরে বেঞ্চে বসে তাপসদার টুকটাক কারেকশন দেখি।
উপন্যাস কতদূর?
বলে সব পাতা রেখে দাও, ওদের সবার ঠিকানা আছে। এরাই তোমাকে একদিন মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাবে।
প্রসেন এসে সাইডে ডাকে। মুখটা কালো কেন রে? রোদে ঘুরছিস নাকি?
তুমি শোনোনি?
কী? আবার ভুয়ো মিটিং? টাকা দেবে? হা হা!
সুমিতদা সুইসাইড করেছে। ওর ঘরে ফ্যানের সঙ্গে…
প্রসেন আমায় ধরে আমি ওর হাত ধরি। মনে হয় আমার ফুসফুস নেই। বিশাল সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো ঠান্ডা রক্তের মাছ। পেটের ভেতর চূড়ান্ত হিম বরফের কুণ্ড। ওই যে দূরে তাপসদা বেঞ্চে বসে আছে, ঝড়ে পড়া জাহাজের নাবিকের মতো।
দীর্ঘ সময় ওই রকম বসে থাকা দেখলে আতঙ্ক হয়। ৭৮/১ চলে যায়, ধুলো মাখা কুকুর ল্যাং ল্যাং করে রাস্তা পেরোয়। আমারই চেতনার অংশ কাটাকুটি হয়ে পড়ে থাকে রাস্তায়।
সব খাঁটি শোকই অবর্ণনীয়।

চিত্রণ: মনিকা সাহা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 + 16 =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »