Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বাইশে শ্রাবণ ও প্রসঙ্গত

পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ বাঙালিমাত্রের কাছে যথাক্রমে আনন্দ আর বিধুরতা নিয়ে আসে। কলকাতার জোড়াসাঁকোতে এক-ই বাড়িতে জন্ম ও মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের। আশি বছর তিনমাস বয়সে, মূলত বার্ধক্যজনিত কারণে, যদিও গৌণত অস্ত্রোপচারে ব্যর্থতার দরুন।

জন্মিলে মরিতে হবে, চিরসত্য এটা। তবু ‘আমৃত্যুর তপস্যা এ জীবন’, বলেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তাঁর জীবনের শেষ বছরটির দিকেই যদি তাকাই, তাহলে দেখব, সমগ্র জীবন নয়, জীবনের অন্তিম বর্ষটি ঘিরেই তাঁর জীবন সুখে দুঃখে আনন্দে বিষাদে ঘটনার ঘনঘটায় কী বিচিত্রভাবেই না আবর্তিত হয়েছিল।

শরীর অসুস্থ থাকত প্রায়শ। কিন্তু না ছিল লেখায় ছেদ, না আনুষ্ঠানিকতায় যুক্ত থাকায় বিরতি। আত্মচিন্তার পাশাপাশি তিনি ভাবছেন দেশের কথা, ভাবছেন সে-সময় চলতে থাকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে। দেশ তাঁর অন্তরে চিরস্থায়ী আসন পেতেছিল বলেই তো কী জমিদারির কাজে, কী সমবায়নীতির প্রয়োগে, কী শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠায়, পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কৃষিবিদ্যা পড়াতে আমেরিকাতে পাঠানো। কৃষকের দুর্দশা তাঁকে সর্বদা কীরকম বিচলিত করে, তার প্রমাণ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের ২রা শ্রাবণ মৈত্রেয়ী দেবীকে লেখা তাঁর পত্র, ‘শ্রাবণ এসে পড়লো অথচ বৃষ্টি নেই। চাষীরা হতাশ্বাস হয়ে পড়ছে। এই জাগতিক নিষ্ঠুরতার জন্য কাকে দোষ দেব ভেবে পাই নে।– যে দেশে চাষের উৎকর্ষের জন্য বৈজ্ঞানিক প্রয়াস সর্বদা উদ্যত তারা সৌভাগ্যবান। কিন্তু মানুষের মূল্য এদেশের অধিনায়কদের কাছে যৎসামান্য। তাই আকাশের দিকে তাকানো মিথ্যে মানুষের দিকে তাকিয়েও কোনো ফল পাইনে। মাঝের থেকে মনের মধ্যে কিছুতেই স্বস্তি পাই নে।’ দেশকে কী গভীর ভালবাসলে জীবনের অন্তিমে এসে এভাবে কৃষকের দুঃখে সমব্যথী হওয়া সম্ভব?

অসুস্থতার মধ্যেও লেখায় ক্ষান্তি নেই। ‘ছেলেবেলা’ লেখা চলছে, ‘সানাই’ বেরিয়ে গেছে, বেরোবে ‘সেঁজুতি’, পুজো সংখ্যার জন্য লেখা হল ‘ল্যাবরেটরি’। তাছাড়া চিঠির পর চিঠি লেখা তো রয়েছেই।

প্রসঙ্গত, তিনি জীবনের শেষ চিঠিটি লেখেন পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীকে, অপারেশনের প্রাক্-মুহূর্তে। কর্তব্যনিষ্ঠা! তবে সে চিঠি তিনি নিজহাতে লেখেননি, রাণী চন্দকে ডিকটেট করেন, নিজে কেবল সই করেন। নিজহাতে শেষ চিঠি পান মৈত্রেয়ী দেবী। ‘মিত্রা’ সম্বোধন করে তাঁকে লেখেন, ‘কিছু কল বিগড়ে গেছে কিন্তু ব্যস্ত হবার দরকার করে না। এটা নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে। যাত্রাপথের শেষ অংশে রথ ঝড় ঝড় চাকা ঘড় ঘড় করে। ক্ষণে ক্ষণে এই ঝাঁকানি অভ্যস্ত হয়ে এসেছে।’

মৃত্যুবর্ষে তাঁর ‘সভ্যতার সঙ্কট’ লেখা, অক্সফোর্ড থেকে ডক্টরেট পাওয়া, আর রাথবোর্নের প্রবল সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে লেখনীধারণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। এর কিছু আগে তিনি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টকে বিশ্বযুদ্ধ থামানোর আকুল আবেদন জানিয়েছিলেন। আবার যখন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের কাছে শুনলেন সোভিয়েতের হাতে হিটলার পর্যুদস্ত, কবির প্রতিক্রিয়া, ‘এ আমি জানতুম, শেষ পর্যন্ত ওরা জিতবেই।’

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট দেয় ১৯৪০-এর ৭-ই আগস্ট, পরের বছর ঠিক যে দিনটিতেই তাঁর প্রয়াণ ঘটবে। অনুষ্ঠান হয়েছিল শান্তিনিকেতনে, উদয়নগৃহে। যেদিন স্যার মরিস গয়ারের হাত দিয়ে তিনি এই সম্মাননাটি গ্রহণ করেন। এসেছিলেন সস্ত্রীক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। অনুষ্ঠান-উপলক্ষ্যে রাণী চন্দ, মীরা দেবী, প্রতিমা দেবী মিলে অতিথিসেবা, উৎসবের পরিবেশ। গয়ার উত্তরায়নের বাড়িগুলি,– পুনশ্চ, শ্যামলী, কোনার্ক ইত্যাদি দেখে চমৎকার মন্তব্য করেন, ‘There is thought in every corner’. রাতে সিংহসদনে হল নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’। এ-নৃত্যনাট্যের গান ‘হায়! এ কী সমাপন’ যে কী নিষ্ঠুরতা এনে দেবে ঠিক একবছর পর এই দিনটিকে, তা কি কেউ কল্পনা করেছিলেন?

প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের মৃত্যুশোক সহ্য করতে হল তাঁকে জীবনের অন্তিম বছরে। মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের ছেলে সুরেন্দ্রনাথ মারা গেলেন ১৯৪০-এর ৩-রা মে। তাঁর মা জ্ঞানদানন্দিনী ঘোর অসুস্থ, কবি গেলে চিনতে পারেন না (‘স্বর্গের কাছাকাছি’,– মৈত্রেয়ী দেবী)। জ্ঞানদানন্দিনী-ই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি রবীন্দ্রনাথকে জন্মাতে ও মরতে দেখেছিলেন।

নিজের আসন্ন মৃত্যুর কথা মাঝেমাঝেই ব্যক্ত হয়ে ওঠে কবিতা ও চিঠিতে। ২৮.০৫.১৯৪০-এ লিখছেন মৈত্রেয়ী দেবীকে, ‘আমি তো এসেছি আয়ুর শেষ তটসীমার উপরে। একটা সামান্য ধাক্কায় অতলে অকস্মাৎ পড়ে যাব–।’ আবার এই মৈত্রেয়ীর কাছেই আব্দার, ‘দুটো গরম জামা ও লুঙ্গি শীতবস্ত্ররূপে আমাকে দান করলে পুণ্যভাগিনী হবে’। তাহলে তিনি লুঙ্গিও পরতেন?

জীবনের শেষ বছরটা বেশ ভুগেছেন। কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি, এলোপ্যাথি, করিয়েছেন সব ধরনের চিকিৎসা। আবার রোগমুক্ত-ও হয়েছেন। অন্তরঙ্গদের কাছে স্মৃতিচারণ করছেন, যশোরে গেলে শাশুড়ি চৈ (একরকম ঝাঁঝাঁলো লতা) দিয়ে কৈমাছ রান্না করে অপূর্ব খাওয়াতেন। মংপু থেকে মৈত্রেয়ীদেবী কমলালেবু পাঠিয়েছিলেন কয়েক বাক্স। তা পেয়ে কাব্যরস নির্গত হল কবির, ‘নগাধিরাজের দূর নেবুনিকুঞ্জের/ রসপাত্রগুলি/ আনিল এ শয্যাতলে/ জনহীন প্রভাতের রবির মিত্রতা।’ সুখে দুঃখে কবিতা তাঁর সঙ্গী।

এর-ই মধ্যে শান্তিনিকেতনে এলেন চীনদেশের রাষ্ট্রদূত H.E. Tai-Chi-Tao. এঁদের আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি না ঘটে, রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে সেসবের-ও তদারক করতে হয় কবিকে। বিশ্বভ্রামণিক কবি কেবল মংপুতেই গিয়েছিলেন চারবার। ইচ্ছে ছিল আরও একবার যাবেন। সেজন্য বেশ কিছু পোশাক রেখে আসা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর এই ইচ্ছে কখনও পূরণ হয়নি। মংপু নিয়ে মৃত্যুর ছ’মাস আগেও কবিতা লিখেছেন, ‘–নির্জন বনের/ গূঢ় আনন্দের যত ভাষাহীন বিচিত্র সংকেতে? লভিতাম হৃদয়েতে/ যে বিস্ময় ধরণীর আদিম প্রাণের সূচনায়/ সহসা নাম না জানা পাখিদের চকিত পাখায়/ চিন্তা মোর যেত ভেসে–‘।

দীর্ঘ, সুদীর্ঘ আশি বছরের জীবন তাঁর, নিতান্ত কম নয়। বিশেষ করে যখন প্রতিতুলনা করে দেখি কীটস, শেলি, মায়াকোভস্কি, বা বাংলাভাষার সুকুমার রায়, সত্যেন্দ্রনাথ, সুকান্ত ভট্টাচার্যের সঙ্গে, তখন তাঁর আয়ুকে ঈর্ষণীয়ই মনে হয়। আবার দীর্ঘায়ু ওয়ার্ডসওয়ার্থ, টলস্টয় বা হুইটম্যান, কিংবা আধুনিক হিন্দি সাহিত্যের ‘মীরাবাঈ’ বলে কথিত মহাদেবী বর্মা রবীন্দ্রনাথের মতো আশি বছরের বেশি বাঁচলেও তাঁর মতো এত বিপুল, প্রায় হিমালয়তুল্য, বা অসীম কর্মকাণ্ড নিয়ে বাঁচেননি।

তিনি তাঁর একটি কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আমি পৃথিবীর কবি,/ যেথা তার যত উঠে ধ্বনি,/ আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি’। সে সাড়া যে কী বিপুল, কতখানি ব্যাপ্ত ও বহুবিস্তৃত, তাঁর সমগ্র জীবন নয়, জীবনের শেষ পাঁচ বছরের কয়েকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে দেখব আমরা। কয়েকটি, সব নয়।

Advertisement

জীবন-মৃত্যুর মধ্যখানের যে পরিসর, তাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয়, তার চূড়ান্ত উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ। তিনি স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে একজায়গায় বলেছিলেন, স্বামীজী সবসময় ইতিবাচক, কখনও হতাশ বা নিরুৎসাহিত হতেন না তিনি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হতেন। দুঃখসুখের দোলদোলানে পৌষফাগুনের পালার মধ্যে দিয়ে আজীবন গিয়েছেন তিনি, আর কাজী নজরুল যা বলেছেন, সেই ‘পুষ্পের হাসি’ হেসে গেছেন। বাঙালি তিনি, যাঁর চেতনায় আবহমানকালের বাংলা। ভারতীয় তিনি, লাহোর থেকে এলাহাবাদ নৃত্যনাট্যের দল নিয়ে পরিক্রমা করেন, অসংখ্যবার ভারতের দৈর্ঘ্য প্রস্থ বেধ টহল দেন। বৈশ্বিক তিনি, তাই একজন বিশ্বনাগরিকরূপে শুধুই বিশ্বভ্রমণ করেই বেড়ান না, পৃথিবীর এক প্রান্তের ওকাকুরা, অন্য প্রান্তের আইনস্টাইনের সঙ্গে মতবিনিময় হয় তাঁর। আলাপচারিতা হয় হেলেন কেলার, চলচ্চিত্রনির্মাতা আইজেনস্টাইনের স্ত্রী, ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, পদার্থবিজ্ঞানী হাইজেনবার্গ প্রমুখ বহু বহু বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে। এককথায় সংখ্যাগণনার বাইরে। আবার এই এক-ই ব্যক্তি তাঁর জমিদারির সাধারণ কৃষকের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হন, নিজের চাকরবাকরদের সঙ্গে ঠাট্টামশকরায় মাতেন, শিশুদের সঙ্গে শিশু হয়ে মেশেন। রোমের কলোসিয়ামে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেন, দেন অক্সফোর্ডে, বার্লিন প্যারিস বুদাপেস্টে। চীনকে ভালবাসেন, জাপানকেও। কিন্তু জাপান চীন আক্রমণ করলে তাকে সমালেচনা করতেও কুণ্ঠিত হন না। খ্রিস্টজন্ম পালিত হয় শান্তিনিকেতনে, আবার কামাল আতাতুর্কের মৃত্যুতে তাঁর অবদান নিয়ে শোকার্ত হন মন্দিরের ভাষণে। পৃথিবীর কোন কবি করেছেন এমনটা?

কবি তাঁর সমগ্র জীবনে অগণিত সাধারণ মানুষের সঙ্গে যেমন যুক্ত ছিলেন, তেমনই দেশবিদেশের কত না বিখ্যাত লোকদের সঙ্গে! শান্তিনিকেতন, যাকে তিনি বিশ্বের একটি নীড় বানাতে চেয়েছিলেন, দাক্ষিণ্য পেয়েছে দীনবন্ধু এন্ড্রুজ, সিলভাঁ লেভি, ভিন্টারনিৎস, তুচ্চি, তান উন শান, এলমহার্স্ট, পিয়ারসন, তাকাগাকি (যুযুৎসু শেখাতেন), এমন কত কত বিদ্বজ্জনের! কবির আহ্বানে এঁরা সাড়া দিয়েছিলেন তাঁর আদর্শকে মান্যতা দিয়ে। সামান্য বেতনে অসামান্য বিদ্যাদান করে গিয়েছেন, প্রদীপিত করে গেছেন কত না শিক্ষার্থীকে!

কবি বরাবর-ই অভিনব ভাবনায় ভাবিত। তাঁর এই ভাবনার ফলশ্রুতিতে শান্তিনিকেতনে আমরা পাই বৃক্ষরোপণ উৎসব, বর্ষামঙ্গল, হলকর্ষণ, খ্রিস্টোৎসব, মাঘোৎসব ইত্যাদি। পৌষমেলা তো তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ-ই শুরু করে গিয়েছিলেন। কবি তাকে আরও বর্ণময় করে তোলেন। কর্মময় জীবনের পাশাপাশি এই উৎসব-বিরতিগুলো শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাদাতাদের মধ্যে যে কী অপার জীবনীশক্তি এনে দেয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বাঁধ ভেঙে দিতে এসেছিলেন কবি। কত রকমের সংস্কারকেই না সংশোধনের প্রয়াস ছিল তাঁর, তা সে কালীঘাটে পশুবলির বিরুদ্ধতা করাই হোক, আর জন্মনিয়ন্ত্রণের সপক্ষে কথা বলাতেই হোক। ১৯৩৪-এর বিহার-ভূমিকম্পের কারণকে গান্ধী যখন ব্যাখ্যা দেন যে, অস্পৃশ্যতা দূর করতে ভারতীয়দের ব্যর্থতার দৈবী প্রতিশোধ এটা, রবীন্দ্রনাথ একে অবৈজ্ঞানিক বলতে কুণ্ঠিত হননি। গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা কিন্তু কবিকে চরকার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারেনি, কেননা তাঁর মনে হয়েছিল, চরকা অর্থনীতিকে পেছনে ঠেলে। আবার এই রবীন্দ্রনাথ-ই কিন্তু ১৯৩৭-এ সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার স্বার্থে যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে গিয়ে শান্তিনিকেতনে হস্তশিল্প স্লয়েডের প্রচলন করেন, সুদূর সুইডেন থেকে শিক্ষক আনান। ১৯৩৭-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রধান অতিথির ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন বাংলায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এই প্রথম। দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এমনই আরও অনেক কিছুর পথিকৃৎ তিনি। যেমন এদেশে ট্রাক্টর আনয়নের।

বাইশে শ্রাবণের অনুষঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবনে মৃত্যুশোকের কাহিনি জানলে আমরা বিহ্বল না হয়ে পারি না। জীবনে কত মৃত্যুই না দেখতে হয়েছে তাঁর! মা বাবা বা বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রয়াণ তো দেখতেই হয়। তবু বৌদি কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু কী তীব্র অভিভব-ই না এনে দিয়েছিল তাঁকে! এছাড়া তাঁর চেয়ে বয়ঃকনিষ্ঠ যারা,– স্ত্রী মৃণালিনী, ছেলে শমীন্দ্রনাথ, দুই মেয়ে, রেণুকা ও মাধুরীলতা, এমনকি নিজ দৌহিত্র নীতীন্দ্রর মৃত্যুও দেখতে হয়েছে তাঁকে। ‘নির্মম কঠোরতা মেরেছে ঢেউ/ আমার নৌকার ডাইনে বাঁয়ে’, কথাটা আদৌ কবিত্ব করে বলা নয়, ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের মতো বিপর্যয়ে একজন শোকাভিভূতের মরমী উচ্চারণ।

এছাড়াও আছে কত স্বজনবিয়োগের ব্যথা, যাঁদের মধ্যে অনেকেই কবির মতোই কারুবাসনার কাণ্ডারী। কত মানুষের মৃত্যুশয্যায় এসে দাঁড়িয়ে সহমর্মী হতে হয়েছে তাঁকে,– রজনীকান্ত সেন, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সুকুমার রায়। মৃত্যুযাত্রীর কাছে বসে গান শোনাতে হয়েছে তাঁদের! অথচ কবি তো জহ্লাদ বা পাষাণ নন, বরং প্রখর অনুভূতিসম্পন্ন, সূক্ষ্মতম চেতনার একজন মানুষ।

প্রয়াণের আগে, সব হিসেব বাদ দিয়ে যদি তাঁর জীবনের শেষ পাঁচ বছরের কথা-ই ধরি, দেখব, কত প্রিয়জনের মৃত্যুশোক বহন করতে হয়েছে তাঁকে। যেহেতু তিনি ছিলেন মানুষের সান্নিধ্যপ্রিয়, তাই অন্যের চেয়ে ঢের ঢের বেশি মৃত্যুবেদনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। এসব মৃত্যু তাঁকে বেদনার্ত করলেও নিজের মনোবলের জোরে সে-অরুন্তুদ বিষাদকে কাটিয়েও উঠেছেন। পাশাপাশি মৃত্যু নিয়ে তাঁর দর্শন গড়ে উঠতেও তা ভূমিকা রেখেছে। তাই তিনি বলতে পারেন, তিনি-ই বলতে পারেন, ‘দুদিন দিয়ে ঘেরা ঘরে/ তাইতে যদি এতই ধরে/ চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়?’ কেন পারেন?

ধরা যাক এন্ড্রুজের মৃত্যু। কবির মৃত্যুর মাত্র একবছরের কিছু আগে ৫. ৪. ১৯৪০-এ মারা যান এন্ড্রুজ। রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করেন তাঁর অবদানকে, ১৯১২ থেকে তাঁর সান্নিধ্যের কথা, যে এন্ড্রুজ কবি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘My whole heart was given to the poet.’ আর কবি? তিনি তাঁর প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, ‘তাঁর মধ্যে যথার্থ ইংরেজকে, যথার্থ খৃষ্টানকে, যথার্থ মানবকে বন্ধুভাবে অত্যন্ত নিকটে দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল’। অতএব শোক নয়, তর্পণ, বিষাদ নয়, মূল্যায়ন, বেদনা নয়, শ্রদ্ধা, এই ছিল কবির কারও প্রতি মৃত্যুকৃত্য।

তিন-তিন জন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মৃত্যু হল তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর আগে। তাঁদের মধ্যে একজন ভ্রাতুষ্পুত্র গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮. ৯. ১৮৬৭-৪. ২. ১৯৩৮)। এই শোক যে তাঁকে অভিভূত করে একেবারে ধরাশায়ী করে ফেলেনি, তাঁর যে আরও গুরুতর কর্তব্য রয়ে গেছে জাপানের চীন আক্রমণকে জাপানি কবি নোগুচির সমর্থনকে সমালোচনার! কবি নোগুচিকে লেখা তাঁর চিঠিতে জাপানের রণতরীগুলিকে তৈমুর লঙের সঙ্গে তুলনা করতে ছাড়েননি। পাশাপাশি বর্ষামঙ্গলের অনুষ্ঠান-ও চলছে, ‘জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা’!

ভাগ্নে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুতে লিখছেন, ‘রাহুর মতন মৃত্যু/ শুধু ফেলে ছায়া,/ পারে না করিতে গ্রাস জীবনের স্বর্গীয় অমৃত’। আর এর কিছুদিন পর তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে তার পাঠালেন ১৫-ই জুন, ১৯৪০, বিশ্বযুদ্ধ থামানোতে পদক্ষেপ নিতে বলে। ‘আমি পৃথিবীর কবি’, বলতে পারেন তিনি-ই। ১২-ই মে আরও এক অন্তরঙ্গ মানুষের মৃত্যু ঘটে গেছে, কালীমোহন ঘোষ, সেই বেদনা বুকে নিয়ে লেখা এ তারবার্তা। (৩. ৫. ১৯৪০)। পৌত্র দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৬. ১২. ১৮৮২-২১. ৬. ১৯৩৫)। কেবল আত্মীয় বলে নয়, কবির অত্যন্ত নিকটজন। তাঁর গানের ভাণ্ডারী ছিলেন দিনেন্দ্রনাথ। তাঁকে শ্রদ্ধা জানালেন কবি শান্তিনিকেতন মন্দিরে। হ্যাঁ, পৌত্রকে শ্রদ্ধা। শ্রাবণের গোড়ায় দিনেন্দ্রনাথের মৃত্যু। বর্ষামঙ্গল আসন্ন। কবি কাণ্ডারীহীন, তবু গান তো লিখতেই হবে! লিখলেন, ‘আজি বরিষণমুখরিত শ্রাবণ রাতি’। এ গানে ‘স্মৃতিবিরহের মালা একেলা গাঁথি’-র মধ্যে কি একটুখানি ছায়াপাত আছে দিনেন্দ্রনাথের? রবীন্দ্রনাথের জীবনী যারা জানেন, কবির সঙ্গে এঁদের সুসম্পর্ক, লিপ্ততা আর স্নেহের পরিমাণ কী ছিল, তারা তা জানেন সবাই। আর এ-ও জানেন বলেই বিস্ময় ফুরোতে চায় না, এত ঘনিষ্ঠদের প্রয়াণশোক কী দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন তিনি, একথা ভেবে। উপরন্তু বর্ষামঙ্গল শেষ হতেই কিছুদিনের মধ্যে ‘ভরসা-মঙ্গল’ লিখে দিলেন তিনি আশ্রমবাসী ‘সুরকানা’-দের অভিনয়ের জন্য, আর সেজন্য এমন গান-ও তাঁর হাত দিয়ে বেরোয়, ‘কাঁটাবনবিহারিণী সুরকানা দেবী/ তারি পদ সেবি/ করি তাহারি ভজনা/ বদ্ ক্ণ্ঠলোকবাসী আমরা কজনা’!

মৃত্যুত্তীর্ণ এই হলেন রবীন্দ্রনাথ!

5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
সুতপন চট্টোপাধ্যায়
সুতপন চট্টোপাধ্যায়
3 months ago

আজ একটি অসাধারণ লেখা পড়লাম। অনেক দিন মনে থাকবে। রবীন্দ্রনাথ ভালো ভাবে না পড়লে এমন প্রবন্ধ লেখা যায় না।

Last edited 3 months ago by সুতপন চট্টোপাধ্যায়
Anindita Mandal
Anindita Mandal
2 months ago

এই লেখাটি না পড়লে অনেক কিছুই জানা হতো না। মরমী লেখাটি। কবির জন‍্য বেদনা অনুভব করলাম। অনন্তকালের সেই ঘরে কবি নিত‍্য আনন্দে থাকুন।

শুভ্র মুখোপাধ্যায়
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
2 months ago

সমৃদ্ধ হলাম। অসাধারণ এই লেখাটি ছাপা অক্ষরে কাছে থাকলে ভালো লাগতো।

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটক ও বাংলাদেশ

ঋত্বিক ঘটকের জীবনের প্রথম বাইশ বছর (১৯২৫-১৯৪৭) কেটেছে মূলত পূর্ব-বাংলায়, যা এখনকার বাংলাদেশ। তাঁর জন্ম ঢাকার ২,ঋষিকেশ দাস রোডের ঝুলন বাড়িতে। ১৯৪৭, অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি মূলত পূর্ব-বাংলায় কাটান। আমরা দেখব, পূর্ব-বাংলা যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে-দেশ, সে-ভূমির প্রভাব তদনুরূপ ঋত্বিকেরও পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে।

Read More »
মণিকর্ণিকা রায়

অনুগল্প: অর্জন

অসহায় বৃদ্ধের খাওয়া হয়ে গেলে মাঝেমাঝে গল্পও করত ওঁর সাথে। আদিত্য লক্ষ্য করেছিল এই ব্যাপারটা যেন তার মনে একটা বদল আনছে— যেন রোজ তার শরীর-মন জুড়ে সঞ্চালিত হচ্ছে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি। যেন সে সত্যিই মানুষ হয়ে উঠছে।

Read More »
মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গা মাঈ কী! জয়!

ঢাকা বা সমগ্র বাংলাদেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজোর চাঁদা আদায়ের চল খুব একটা নেই। মণ্ডপে এসেই পাড়ার লোক চাঁদা দেন। জবরদস্তি করে চাঁদা আদায়ের যে বীভৎসতা কলকাতা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে আছে, তা অন্তত ঢাকা আর বরিশালে দেখিনি। পুজোর দিনেও অনেকে এসে প্যান্ডেলের পাশে চাঁদা আদায়কারীদের টেবিলের সামনে এসে চাঁদা দিয়ে যান। পাড়ার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। স্বেচ্ছায় এসে চাঁদা দিয়ে যান। এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

Read More »