বই থেকে বই: সপ্তপদী
সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র বাংলা ছবির ইতিহাসে বহুবার হয়েছে এবং যতবার হয়েছে বলতে গেলে ততবারই সেসব ছবি অন্য মাত্রা পেয়েছে, ভাল ছবি হিসেবে দর্শকদের মনে থেকে গিয়েছে চিরতরে। তাই হয়তো ‘বই দেখব’, ‘কী বই বেরিয়েছে’– এই ধরনের কথার প্রচলন সে সময় খুব ছিল। বইয়ের পাতা থেকে রুপোলি পর্দায় দেখাও তাই বই হয়েই ছিল তখন মানুষের কাছে। আজ এমনই একটি বই থেকে বইয়ের আলোচনা করব এই লেখার মধ্য দিয়ে। এমন একটি অসামান্য উপন্যাস এবং তা থেকে নির্মিত কালজয়ী একটি চলচ্চিত্র এই লেখার বিষয়বস্তু, যা বাঙালি পাঠক এবং চলচ্চিত্রপ্রেমী বাঙালি দর্শকদের সকলের কাছেই পরমপ্রিয় একথা আমি হলফ করেই বলতে পারি।
বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে নানাবিধ মণিমানিক্যের মধ্যে অন্যতম মূল্যবান রত্নটি হল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সপ্তপদী’ উপন্যাসটি। এই উপন্যাসটির রচয়িতা তারাশঙ্কর তাঁর সোনার কলম থেকে নিঃসৃত লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন এক নির্মম বাস্তবকে, সমাজে ধর্মের যে প্রকট আধিপত্য কিংবা ধর্মের নামে অধর্মের যে লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে ছারখার করে দেয় সবকিছু, সেই আগুনের উত্তাপে অঙ্গারে পরিণত হন উপন্যাসের নায়ক কৃষ্ণেন্দু আর নায়িকা রিনা ব্রাউন। দুটি হৃদয়ের নিষ্পাপ ভালবাসার মাঝে শক্ত প্রাচীর হয়ে বাধার সৃষ্টি করে ধর্ম, সে প্রাচীর ডিঙানোর সাধ্য কার? অনেকগুলি প্রশ্ন জাগে তাই মনে এই উপন্যাসটি পড়লে। ভালবাসার মানুষকে কি সহজেই ভোলা যায়? ভালবাসা কি ধর্মের চেয়েও বড়? বা বইয়ের নাম সপ্তপদী কেন? শেষ পৃষ্ঠায় লেখক এর জবাব দিয়েছেন। ‘একসঙ্গে সাত পা হাঁটলে মিত্রতা হয়। আমাদের বিবাহে স্বামী-স্ত্রীতে অগ্নি সাক্ষী করে, সাত পা একসঙ্গে পা ফেলে হাঁটে। কিন্তু যখন ভগবানকে খোঁজে মানু্ষ, তখন সে একা। সে পথে বিচিত্রভাবে আসে আশীর্বাদ, অভিশাপ! এবং–! সাত পা একসঙ্গে না হাঁটলে সংসারের আনন্দে ফেরা যায় না।’ বাদবাকি প্রশ্নের উত্তরগুলিও খুঁজে দেখব আমরা অবশ্যই।
‘সপ্তপদী’ উপন্যাসটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকার পূজাবার্ষিকী সংখ্যায়। তখন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেই সময়ে উপন্যাসটি। এই জনপ্রিয় উপন্যাসটির কাহিনি অবলম্বনে আলোছায়ার জাদুকর পরিচালক অজয় কর তৈরি করলেন উত্তম-সুচিত্রা সোনার জুটিকে নিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি সপ্তপদী। যা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬১ সালের ২০ অক্টোবর রূপবাণী, অরুণা, ভারতী চেইনে প্রেক্ষাগৃহে। ছবিটির প্রযোজক ছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার। রুপোলি পর্দায় দর্শকরা কৃষ্ণেন্দু-বেশে মহানায়ক উত্তমকুমার এবং রীনা ব্রাউনের বেশে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তার সাথে আপামর দর্শক-শ্রোতা উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে, হেমন্ত-সন্ধ্যার কণ্ঠের সেই বিখ্যাত গানে– ‘এই পথ যদি না শেষ হয়…’। চিরপ্রেমের আইকনিক নিদর্শন হয়ে অমর হয়ে গেল উত্তম-সুচিত্রার সপ্তপদী ছবির বাইকে চড়ে প্রেমের জোয়ারে ভেসে যাওয়ার সেই গানের দৃশ্যটি। দুরন্ত লিপ সিংঙ্ক সোনার জুটির ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানটির দৃশ্যে অমর হয়ে থেকে গেল চিরতরেই। পথচলা সত্যিই শেষ হয়নি আজও।
এইবার পাঠকদের কাছে যেটি এই লেখায় আমি আলোচনা করতে চাই তা হল, তারাশঙ্করের উপন্যাস সপ্তপদীর সাথে কোথায় কোথায় কতখানি মিল বা অমিল রয়েছে অজয় করের, উত্তম-সুচিত্রার সপ্তপদী ছবিটির সেই প্রসঙ্গে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘সপ্তপদী’ উপন্যাস থেকে চিত্রনাট্য তৈরি করা হয়েছিল সিনেমার উপযুক্ত করেই। এই চিত্রনাট্য তৈরির দায়িত্ব গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ঘুরেছিল। নানান কারণে তাঁরা কাজটি করতে অসমর্থ হলে শেষমেশ কাজটি করেছিলেন বিনয় চ্যাটার্জি। উপন্যাসটির সাতটি অধ্যায় থেকে চলচ্চিত্রের উপযুক্ত চিত্রনাট্য তৈরি বড় সহজ কথা ছিল না। কারণ বই পড়া আর রুপোলি পর্দায় বই দেখা এই দুইয়ের মধ্যে অবশ্যই বেশ কিছু পার্থক্য থাকেই। একটা গোটা উপন্যাসকে সিনেমার পর্দায় আড়াই থেকে বড়জোর তিনঘণ্টা সময়ের মধ্যেই দর্শকদের কাছে তুলে ধরা বিরাট বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় বৈকী। তাছাড়াও সাহিত্যের মান অক্ষুন্ন রেখেও চিত্রনাট্যতে অনেক সময়েই বেশ কিছু পরিবর্তন করতেই হয় ছবির বাণিজ্যিক স্বার্থের কথা ভেবে। বলা ভাল, দর্শকদের কাছে চলচ্চিত্র হিসেবে গ্রহণযোগ্যতার কথা ভেবে। সপ্তপদী ছবিটিও এই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল না। ছবির স্বার্থে এবং দর্শকদের আকাঙ্ক্ষা যাতে বড়সড় ধাক্কা না পায়, তার জন্য ছবির শেষটায় একটা বড় পরিবর্তন ঘটাতে হয়। সে প্রসঙ্গে আলোচনায় আসব পরে। তার আগে ‘সপ্তপদী’ উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রের সাদৃশ্য নিয়ে আলোচনা করে নেওয়া যাক।
সপ্তপদী মূল উপন্যাসটি একটানা কাহিনি শুরু হয়ে পরিণতি পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হয় না, তার পরিবর্তে ফ্ল্যাশব্যাক পদ্ধতিতে কাহিনিটির পরিণতি দিয়ে শুরু হয়ে তার মাঝে মাঝে পুরনো ঘটনায় ফিরে গিয়ে নানান বিষয় সামনে এনে তবেই চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছেছে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও কিন্তু আমরা দর্শকরা সেটাই দেখেছি। অজয় করের ‘সপ্তপদী’ ছবিটি যারা দেখেছি তারা ঠিকই বিষয়টি বুঝে নিতে পারব। ছবিটি শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পরবর্তী পশ্চিমবাংলার একটি মিলিটারি ঘাঁটি সংলগ্ন এলাকায়, সেই সাঁওতাল পরগনার রাস্তায় ছবির নায়ক এক তরুণ পাদরি ডাক্তার কৃষ্ণেন্দু (মহানায়ক উত্তমকুমার) সাইকেলে চালিয়ে মাঠ, বাড়িঘর, জঙ্গল, মিলিটারি ক্যাম্প, অস্থায়ী রাস্তা এইসব অতিক্রম করে কখনও পৌঁছে যায় রেলের লাইন্সম্যান বংশীবদনের ছেলের চিকিৎসার খোঁজখবর নিতে, কখনও যায় গ্রামের হাসপাতালে। তখনই সেখানে অন্য রোগীদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেওয়ার সময়, নিত্যদিনের কাজকর্মের মাঝে হঠাৎ একটি জিপ এসে পড়ে। তাতে সুরায় অচেতন রীনা ব্রাউন (মহানায়িকা সুচিত্রা সেন), তাঁর জ্ঞান ফেরানোর জন্য, চিকিৎসার জন্য কৃষ্ণেন্দু যখন জলের ঝাপটা দেয় রীনার চোখেমুখে, তখনই বুঝতে পারে এই খ্রিস্টান তরুণী, নেশায় বেহুঁশ মানুষটি তাঁরই ভালবাসার জন, প্রেয়সী রীনা ব্রাউন। তখনই পরিচালক অজয় কর ফ্ল্যাশব্যাকে সোজা দর্শকদের নিয়ে চলে যান ছবিতে খেলার মাঠের সেই জমজমাট দৃশ্যে যেখানে সুন্দরী রীনা ব্রাউন তাঁর বিশেষ বন্ধু ক্লেটনের সমর্থনে চিৎকার করছেন। ক্লেটন এবং কৃষ্ণেন্দুর ফুটবল ম্যাচ চলছে। অর্থাৎ মূল উপন্যাসটি অবলম্বন করেই ফ্ল্যাশব্যাক সাজানো হয়েছে এই ছবিতে।
আবার বই থেকে বই যখন হল অর্থাৎ সপ্তপদী উপন্যাসটি যখন বইয়ের পাতা থেকে রুপোলি পর্দায় দর্শকদের জন্য এল তখন কিন্তু বেশ কিছু অদলবদল ঘটিয়েই এল মূল কাহিনিতে। একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝিয়ে বলা যাক। মূল উপন্যাসে কৃষ্ণেন্দু এবং রীনা ব্রাউনের মধ্যে বেশ অসহযোগিতা, বিরোধিতা ছিল, সে-সব কিন্তু মিটিয়ে দিয়েছিল রীনার পছন্দের বিশেষ বন্ধু ক্লেটন সাহেবই বিশেষ সচেষ্ট হয়ে। এইটি কিন্তু চলচ্চিত্রে অনুপস্থিত। ক্লেটনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে জেনে কৃষ্ণেন্দু বুঝে যায় রীনা ব্রাউন আর ক্লেটনের সম্পর্ক শুধুই নিছক বন্ধুত্বের ছিল। মনে মনে খুশি হয়– এটাই শুধু দেখানো হয়েছিল ছবিতে। মূল সপ্তপদী উপন্যাসে ক্লেটন-রীনার প্রণয়ভঙ্গের ঈঙ্গিত লেখক দিয়েছিলেন স্বল্প কথায় একটু অন্যভাবে– ক্লেটনের বাবা চার্লস রীনার বাবা ব্রাউনকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল– ‘ভগবানকে ধন্যবাদ যে রীনার সাথে মেলামেশার স্বরূপকে সে অল্পদিনেই বুঝতে পেরেছে। বন্ধুত্বকেই সে প্রেম বলে ভুল করেছিল। জন এখানে এসে চাকরি নিয়ে বৃহত্তর সমাজে প্রবেশ করে তার প্রকৃত ভালোবাসার সন্ধান পেয়েছে।’ অর্থাৎ এমিলিকে বিয়ে করতে চলেছে ক্লেটন, এটার ঈঙ্গিতই দিয়েছেন লেখক তাঁর উপন্যাসে।
যাইহোক, এবারে বলি কৃষ্ণেন্দু, রীনা ব্রাউনের কথা। তাঁদের মধ্যে ভাল লাগা এবং মিল বা পারস্পরিক দুর্বলতা তৈরির সূত্রপাত কলেজে ওথেলো নাট্যাংশে অভিনয় করতে গিয়েই এটাই দেখানো হয়েছে ছবিতে, আমরা সবাই জানি। কিন্তু যারা উপন্যাসটি পড়েননি বিশেষ করে তাদেরকে জানিয়ে রাখি, মূল উপন্যাসে কিন্তু ক্লেটনের উদ্যোগেই ওথেলোর ওই দৃশ্যটি অভিনীত হয়েছিল এবং ক্লেটনের প্রস্তাবেই কৃষ্ণেন্দু ওথেলো এবং ডেসডিমোনার চরিত্রে অভিনয় করে রীনা ব্রাউন। যদিও চিত্রনাট্য বদলে গিয়ে দেখানো হয়েছিল ক্লেটন চম্পট দেবে মানে অনুপস্থিত হবে, চিঠি লিখে জানাবে যে, খুব অসুস্থ তাই আসতে পারছি না! আসলে, ভয়ে পেয়েছিল ক্লেটন সাহেব ওথেলো চরিত্রে অভিনয় করতে। তখন বন্ধু (তরুণকুমার) ধরেবেঁধে রাজি করাবে ওথেলো হিসেবে অভিনয় করতে কৃষ্ণেন্দুকে। কারণ বেশ ভাল তৈরি ছিল কৃষ্ণেন্দুর ওথেলোর সব পার্টটিই। এবং মুখে কালি মেখে মানে মেকআপ করে মহানায়কের সেই এক্সপ্রেশন এবং রীনা ব্রাউন-রূপী সুচিত্রা ডেসডিমোনার মেকআপ নিয়ে যখন জানল তাঁর ভয়ানক অপছন্দের কৃষ্ণেন্দুই আজকে ওথেলো হয়ে অভিনয় করবে তার সাথে, ভীষণ রেগে গিয়ে সেই বলা সংলাপটি– ‘কনসিডার করতে পারি, ওয়ান কন্ডিশন– অভিনয় করার সময় ও আমাকে টাচ্ করবে না!’ বাঙালি কোনওদিনই ভুলতে পারবে না। কালজয়ী ছবির কালজয়ী দৃশ্য এটি। মহানায়কের সেই প্রত্যুত্তর, ‘যাহ না ছুঁলে পার্ট করব কী করে?’ জমজমাট সে এক মজার দৃশ্য বটে। সাধারণ দর্শকের দৃষ্টিতে বলতে পারি, উপন্যাস থেকে এই যে খানিকটা বদল তাতে ছবি হিসেবে সপ্তপদী দর্শকদের মন জয় করেই নিয়েছিল।
ছবি এবং উপন্যাসের মূল সুরটি কিন্তু এক এবং অভিন্ন। যে সুর রীনা-কৃষ্ণেন্দুর মধ্যেকার অপার প্রেম। যার অন্তরায় বা আধার ধর্ম নয়, হিংসা নয়, শুধুমাত্র দৈহিক কামনাবাসনা নয়। শুধুমাত্র গভীর ভালবাসা, একে অন্যের ভালর জন্য যেকোনও কিছুই ত্যাগ করতে পারা, তা ধর্মই হোক বা নিজের ভালবাসাই হোক কোনও কিছুতেই পিছপা না হওয়া, তা কিন্তু অক্ষুণ্নই রাখা হয়েছে ছবিতেও। কৃষ্ণেন্দুর বাবার চরিত্রে ছবি বিশ্বাসের অভিনয় ভোলার নয়। কঠিন, রক্ষণশীল পিতা যার কাছে নিজের ধর্ম হয়তো সন্তানের চেয়েও বড়। সেই পিতার নিষেধকে অগ্রাহ্য করে রীনাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য কৃষ্ণেন্দু ধর্ম পরিবর্তন করতেও পিছপা হয় না। আরেকদিকে কৃষ্ণেন্দুর বাবা কলকাতায় রীনার কাছে গিয়ে আদায় করে নিয়েছে সেই কঠিন প্রতিশ্রুতি, যা কৃষ্ণেন্দু এবং রীনাকে একে অপরের থেকে বহুদূরে নিয়ে চলে যাবে। বড় মর্মস্পর্শী অভিনয় করেছেন মহানায়িকা এই দৃশ্যে। সন্তানের মঙ্গলের জন্য ভিক্ষা চাইতে আসা বাবাকে রীনা ফেরায় না। পরবর্তী ছবির অংশে আমরা দেখেছি, ঘর বাঁধবার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে কথা রাখবার জন্য সে তার প্রেমিক কৃষ্ণেন্দুকে কথার কঠিন আঘাতে ফিরিয়ে দিচ্ছে, দূরে সরিয়ে দিচ্ছে নিজের জীবন থেকে। মহানায়িকার সেই অভিনয় এবং মহানায়কের তাতে যোগ্য সঙ্গত– চোখের জলে ভেসে যাই আজও যতবার দেখি এই দৃশ্যগুলি। রীনা ব্রাউন ফিরিয়ে দেবার সময় কৃষ্ণেন্দুকে বলেছিল, ‘তুমি একজন নারীর জন্য ঈশ্বরকে ছেড়েছ, তুমি অতি ভয়ংকর কৃষ্ণেন্দু। আমার চেয়েও সুন্দর কাউকে পেলে তুমি আমাকেও ছেড়ে দেবে, ছুড়ে ফেলে দেবে তুচ্ছ বস্তুর মতোই। তুমি চলে যাও। তোমাকে বিয়ে আমি করতে পারব না।’ সংলাপ হুবহু এক হয়তো নয় কিন্তু মূল বক্তব্য এটাই ছিল। সপ্তপদী ছবির মতনই মূল উপন্যাসেও লেখক কিন্তু রীনা ব্রাউনের কৃষ্ণেন্দুকে প্রত্যাখ্যানের ভাষা এরকমই রেখেছিলেন।
অজয় কর পরিচালিত ‘সপ্তপদী’ ছবিতে একটার পর একটা ফ্ল্যাশব্যাকের ভিতর দিয়ে অনেক পুরনো প্রসঙ্গ ফিরে ফিরে এসেছে। বিশেষ করে রীনার জীবনের কথা। উপন্যাসে যেমন রীনাই বলছে কৃষ্ণেন্দুকে, ‘আমার ক্রস, বাইবেল আমি ফেলে দিয়েছি। কোনদিন আমি ব্যাপটাইজড হইনি। দীক্ষা আমার বাবা নিতে দেয়নি। কোনো ধর্মই আমার নেই। বাবা জেমস ব্রাউন ইংরেজ, ধর্মে ক্রিশ্চান, অত্যাচারী জমিদার। আমার মা হিদেন, হিন্দুদের মধ্যেও বন্য অস্পৃশ্য জাতের মেয়ে। লালসা চরিতার্থ করবার জন্য বাবা তাকে উপপত্নী হিসেবে রেখেছিল, তাকে কিনেছিল। আমি তার জারজ সন্তান। কৃষ্ণেন্দু সেই কুন্তী, সেই আয়া আমার মা।’
এরপরেই কৃষ্ণেন্দুকে তাই সে বলে, সে যেন তার জীবন নষ্ট না করে চলে যায়। সপ্তপদী ছবির দৃশ্যেও যখন রীনার হুঁশ ফিরে আসবে সেই হাসপাতালে টলতে টলতে রীনা ব্রাউন রূপী সুচিত্রার মুখে সেই সংলাপগুলো আমরা শুনি, দেখি– ‘আশ্চর্য হচ্ছ না? আমিও কম আশ্চর্য হইনি। তোমাকে প্রত্যাখ্যান করে বাবার কাছে পালিয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম সন্ন্যাসিনী হব, সন্ন্যাসিনী হয়ে সারা জীবনটা কাটিয়ে দেব। তখন জানতাম না বাবা তাঁর জীবনের এতবড় কলঙ্কটা তোমার উপর চাপিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আমার সব কথা শুনে তিনি কী বললেন জানো? বললেন– তুমি কৃষ্ণেন্দুকে প্রত্যাখ্যান করেছ কেন? বললাম– সন্ন্যাসিনী হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেব ঠিক করেছি। শুনে তিনি ভীষণ রেগে উঠলেন বললেন– “সন্ন্যাসিনী হবি? জানিস তোর কোনো ধর্মই নেই? যেদিন তুই জন্মেছিলি, সেদিনই ভেবেছিলাম তোকে মেরে ফেলব, কিন্তু মুহূর্তের দুর্বলতায় পারিনি। জানিস, কে তোর মা? ওই যে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, যারা সাত পুরুষ ধরে জানে না তাদের বাপের পরিচয় ওই আয়া…”। ক্যামেরায় তখন রীনার মা ছায়াদেবীকে দেখা যাচ্ছে। সে দৃশ্য মনে দাগ কেটে যেতে বাধ্য করে দর্শকদের।
এই আলোচনার মাধ্যমে এটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না সাহিত্যের পাতার কাহিনি যখন রুপোলি পর্দার জন্য চলচ্চিত্রায়িত হয়, তখন মূল ভাব অক্ষুন্ন রেখেও কিছু কিছু পরিবর্তন করতেই হয়। তাতে উপন্যাসের মর্যাদাহানি মোটেও হয় না এবং চলচ্চিত্র দেখতে বসে দর্শকরা তার সাথে একাত্ম হতে পারেন, চরিত্রগুলির দুঃখ, আনন্দ, যন্ত্রণাকে সঠিকভাবে অনুভব করতেও সক্ষম হন।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুগ্ধতায় ভেসে গিয়েছে উত্তম-সুচিত্রা সোনার জুটির সপ্তপদী ছবিটি দেখতে দেখতে। কিন্তু যারা মূল উপন্যাসটি পড়েননি তারা জেনে চমৎকৃত হবেন যে, তারাশঙ্করের সপ্তপদী কিন্তু বিয়োগান্ত কাহিনি আসলে। কৃষ্ণেন্দু এবং রীনা ব্রাউনের মিল হবে না আসল গল্পে। ছবিতে আমরা দেখি কৃষ্ণেন্দুর বাবার ভুল ভাঙবে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে– যে প্রকৃত ভালবাসা বড়, যা রীনা ব্রাউন নামক খ্রিস্টান তরুণীর সততা এবং গভীর ভালবাসা থেকেই বুঝতে পেরেছে, সেকথা জানিয়ে চিঠি লেখে তার পুত্রকে। সেই চিঠিই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রীনাকে দেখায় কৃষ্ণেন্দু। রীনা অঝোরে কেঁদে ফেলে এবং অন্তে মিল হয় এই দুই ভালবাসার হৃদয়ের। রীনাকে কোলে নিয়ে কৃষ্ণেন্দু ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় চার্চের দিকে। এইভাবেই পরিচালক অজয় কর ছবিটির শেষ দৃশ্য দেখিয়েছেন।
এইবার আসি মূল উপন্যাসটির কথায়। যেখানে চলচ্চিত্রের সমাপ্তির চেয়ে একেবারেই ভিন্ন এক জগতের সামনে পাঠককে দাঁড় করিয়েছেন লেখক। উপন্যাসের সপ্তম অধ্যায়ে মদাসাক্ত অবস্থায় ক্রমাগত ধ্বংসের চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে যেতে উপন্যাসের নায়িকা রীনা ব্রাউন তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত। কৃষ্ণেন্দুর নিষ্পাপ, পবিত্র ভালবাসার কাছে সে নিজেকে পাপী মনে করছে। সরাসরি বলছে রীনা, কৃষ্ণেন্দুকে– ‘তুমি সন্ন্যাসী, তুমি সেইন্ট, তোমার পাশে আমি দাঁড়িয়ে কলুষিত করতে পারি তোমাকে?’ কৃষ্ণেন্দু ততদিনে মাদ্রাজের কুম্ভকোণম কুষ্ঠাশ্রমে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। মনে রাখতে হবে, যে সময়ের প্রেক্ষাপটে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সপ্তপদী রচনা করেছিলেন, সেই সময়ের নিরিখে কুষ্ঠ একটি প্রাণঘাতক রোগ, যার সঠিক চিকিৎসা তখনও সঠিকভাবে আবিষ্কৃত বা প্রচলিত হয়নি। যাইহোক, কৃষ্ণেন্দু চিকিৎসক হিসেবে সেই কুষ্ঠাশ্রমে যুক্ত হলেও তখন তার চিকিৎসা চলছে। এসবের মধ্যে তার মনে এক আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটে– ‘রীনা জীবনে পাপ বড় নয় প্রায়শ্চিত্ত বড়…’।
রীনা-ক্লেটনের বিবাহ হয় সপ্তপদী উপন্যাসে। ক্লেটনের সাথে তার প্রথম স্ত্রী এমিলির বিচ্ছেদ ঘটবার পর যুদ্ধবন্দি অবস্থায় দীর্ঘদিন বন্দি শিবিরে কাটায় ক্লেটন। কাশ্মীরে রীনাকে ক্লেটন আবার ফিরে পায় এবং প্রাণপণ চিকিৎসা করে অসুস্থ, বিধ্বস্ত রীনাকে সে সুস্থ করে তোলে। জন ক্লেটন, রীনা ব্রাউনের সাথে দেখা হয় ওই কুম্ভকোণম কুষ্ঠাশ্রমে কৃষ্ণেন্দুর সাথে। এক অনাথা মেয়ে ঝুমকি এবং আশ্রমের দায়ভার সঁপে দিয়ে কৃষ্ণেন্দু একাকী পা বাড়ায় ঈশ্বরের খোঁজে, এক অজানা পথের দিকে। যাওয়ার আগে এই সপ্তপদী উপন্যাসের সার্থকতা বজায় রেখে কৃষ্ণেন্দু তার উপলব্ধির কথা শুনিয়েছে, বলেছে– ‘দেখো একসঙ্গে সাত পা হাঁটলে মিত্রতা হয়। আমাদের বিবাহে স্বামী-স্ত্রীতে অগ্নি সাক্ষী করে, সাত পা একসঙ্গে পা ফেলে হাঁটে। কিন্তু যখন ভগবানকে খোঁজে মানু্ষ, তখন সে একা। সে পথে বিচিত্রভাবে আসে আশীর্বাদ, অভিশাপ! এবং–! সাত পা একসঙ্গে না হাঁটলে সংসারের আনন্দে ফেরা যায় না। তোমরা হেঁটেছ, দোর খুলেছে। সুখে তোমাদের সংসার ভরে থাক। আমার যাত্রা– অ্যালোন,আমি সুখী।’
এই বিচ্ছেদ হয়তো উত্তম, সুচিত্রার বিচ্ছেদ হিসেবে ধরতেন দর্শক, মেনে নিতে পারতেন না তাঁরা। তাই হয়তো ছবির স্বার্থে এই পরিবর্তন করা হয়, মিল দেখানো হয় ছবিতে শেষে। শোনা যায়, এই বিষয়ে তরুণকুমারের এবং স্বয়ং সুচিত্রা সেনের মত ছিল অন্তে মিল দেখানোতেই। মহানায়িকার বক্তব্য ছিল, পর্দায় মিল দেখলে একটা ভাল মেসেজ যাবে সাধারণ দর্শকদের কাছে, যে, ধর্ম কখনও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি কৃষ্ণেন্দু-রীনা ব্রাউনের প্রেমের সফল পরিণতি এক হয়ে যাওয়ার কাছে। আবার তরুণকুমারের লেখা থেকে জানা যায়, তরুণকুমার তাঁর দাদা উত্তমকুমারের সাথে তারাশঙ্করের পাইকপাড়ার বাড়িতে গিয়ে বুঝিয়ে বলেছিলেন লেখককে যে, কৃষ্ণেন্দু সপ্তপদীতে রীনা ব্রাউনকে ভালবেসে ঘরসংসার ছেড়ে পথে নামল, এমনকি নিজের ধর্মের পথ থেকেও সে সরে দাঁড়াল। সেই কৃষ্ণেন্দু শেষে অন্য পরিবেশে দেখা পেলে রীনার। কৃষ্ণেন্দুর হল কুষ্ঠ, দুজনের মিল হল না, এসব দেখলে লোকে কি তবে বিশ্বাস করবে না, ভালবাসা পাপ? ভালবাসার ওপর সাধারণ মানুষ যে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে।
এভাবে বোঝানোয়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় শেষমেশ রাজি হয়ে যান এবং অনুমতি দিয়ে দেন ছবিতে সপ্তপদীর মিলন দেখানোর জন্য। তবে এ নিয়ে মৃদু অসন্তোষ ছিল স্রষ্টার মনে। চিত্রনাট্য এবং উপন্যাস পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারে বসলে মিলের চেয়ে অমিলটাই বেশি চোখে পড়বে, একথা সত্য হলেও বই থেকে বই করতে গিয়ে ‘সপ্তপদী’ চলচ্চিত্র কিন্তু বাংলা ছবির ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবেই কালজয়ী হয়ে আছে এবং আগামীতেও থাকবে একথাও অনস্বীকার্য। আর অনস্বীকার্য, সপ্তপদী ছবিতে চির অমর হয়ে থাকবে উত্তম-সুচিত্রা জুটির অভিনয় এবং এই পথ কোনওদিনই শেষ হবে না, এও সত্য।
চিত্র: গুগল







Alakananda