Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

জেমস ওয়াট: যিনি শিল্পবিপ্লবের জনক

বাড়ির বৈদ্যুতিক আলোর বাল্ব ফিউজ হয়ে যাওয়া এবং বাল্ব পাল্টানোর সঙ্গে ‘ওয়াট’ (Watt) শব্দটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। তাই ‘ওয়াট’ শব্দটির সঙ্গে কম-বেশি সকলেরই পরিচয় আছে। ‘ওয়াট’ আসলে শক্তির (Power) একটি একক। মেকানিক্যাল বা ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার বা শক্তি বোঝাতে বা ইলেকট্রিক-লাইটের বাল্ব বা মেশিন-পত্তরের শক্তি বা ক্ষমতা-র (Power) পরিমাপ বোঝাতে ব্যবহার করা হয় এই একক। কিন্তু কোত্থেকে এসেছে এই ওয়াট শব্দটি? অনেকেই হয়তো জানি, ‘জেমস ওয়াট’ (James Watt) নামের উদ্ভাবক, ইঞ্জিনিয়ার এবং বিজ্ঞানীর সম্মানেই বৈদ্যুতিক শক্তি এবং তাপের একক হিসেবে ‘ওয়াট’ শব্দটি এসেছে।

কে ছিলেন এই জেমস ওয়াট? এই লেখায় অতি সংক্ষেপে সেই জেমস ওয়াটের কথা জানব আজ।

১৭৩৬ সালে স্কটল্যান্ডের একটি জায়গায় এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ পরিবারে জন্ম হয় জেমসের। তাঁর বাবা-র নামও ছিল জেমস ওয়াট। বাবা ছিলেন একজন সুদক্ষ কারপেন্টার। জাহাজ তৈরি করার একজন মেকানিক ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন কন্ট্রাক্টরও। তাঁর নিজেরও একটি জাহাজ ছিল। বাড়িতে যন্ত্রপাতি তৈরি করা এবং সারানোর জন্যে একটি ছোটখাটো ওয়ার্কশপের মতও ছিল তাঁর। সেই ওয়ার্কশপে থাকত প্রয়োজনীয় মেশিন টুলস। এমনকি সেখানে মেটাল-ফর্জিং করার ব্যবস্থাও ছিল। সেই ওয়ার্কশপের প্রতি বালক জেমসের ছিল দারুণ আকর্ষণ। বাবার কাছে এখানেই বালক জেমসের প্রথম ক্রাফটিং-এর হাতেখড়ি হয়।

জেমসের মা-ও পড়াশোনা জানতেন। ছোটবেলায় মায়ের কাছে অন্যান্য বিষয় এবং বাবার কাছে নিয়মিত অংক শিখেছেন জেমস। প্রাইমারি এবং পরে হাইস্কুলে পড়াশোনা করলেও জেমস বেশি পছন্দ করতেন বাড়িতে বসেই পড়াশোনা করতে। নৌকো নিয়ে জেলেদের মাছ ধরে ফিরে আসা দেখতে পেতেন বাড়ির দাওয়ায় বসে। মাঝে মাঝে অদূরে বন্দরে জাহাজের ফিরে আসা দেখতেন বালক জেমস। সেই পালতোলা জাহাজ যে একদিন স্টিম-ইঞ্জিনেও চলতে সক্ষম হবে, তখন এমন কোনও স্বপ্ন জেমসের মাথায় এসেছিল কি না, আজ আর তা জানার কোনও উপায় নেই।

তবে তদানীন্তন পুরোনো মডেলের স্টিম ইঞ্জিনের সঙ্গে জেমসের পরিচয় হয়েছে আরও অনেক পরে। জেমসের যখন মাত্র আঠারো বছর বয়স, মা মারা যান। তারপর থেকে বাবারও শরীর খারাপ হওয়া শুরু হয়। খারাপ সময় যখন আসে, সব কিছু যেন এক সঙ্গেই আসে। সেসময় থেকে বাবার ব্যবসাতেও নেমে এল চরম মন্দা।

তারপর এক বছরের জন্যে লন্ডনে গিয়ে নানান ধরনের ইন্সট্রুমেন্ট তৈরির কাজ শিখে ফিরে এলেন জেমস। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাস্ট্রোনমি ডিপার্টমেন্টে যন্ত্রপাতি সারানোর একটি অস্থায়ী কাজ পেলেন জেমস। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ধরনের নানান ইন্সট্রুমেন্টের সঙ্গে পরিচয় হল তাঁর। যন্ত্রপাতি সারানো এবং নির্মাণের ক্ষেত্রে জেমসের জ্ঞান, দক্ষতা এবং মেধা দেখে, তাঁর ইউনিভার্সিটির চাকরিটি স্থায়ী হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, সেখানকার কর্তৃপক্ষ জেমস-কে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ওয়ার্কশপ নির্মাণেরও দায়িত্ব দিলেন। ফিজিক্স এবং গণিতে জেমসের পড়াশোনা এবং জ্ঞানের গভীরতা সেখানকার অধ্যাপকদের মুগ্ধ করে তুলেছিল। যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে জেমসের বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান আর ব্যুৎপত্তি দেখে অধ্যাপকরা ক্লাসে যন্ত্রপাতি সম্পর্কে কিছু পড়ানোর সময় মাঝে মাঝেই জেমস-কে ডেকে পাঠাতেন।

গ্লাসগো সিটি-সেন্টারের জর্জ স্কোয়ারে জেমস ওয়াটের মূর্তি।

তখন কতই বা বয়স জেমসের। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর। এর আগে জেমস শুনেছিলেন ‘নিউকমেন’ (Thomas Newcomen) নামের একজন প্রায় বছর পঞ্চাশেক আগে, স্টিম–এ চলতে সক্ষম সে ধরনের একটি ইঞ্জিন তৈরি করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে একজন অধ্যাপক ছাত্রদের দেখাতেন সেই ‘নিউকমেন ইঞ্জিন’। একদিন সেই ক্লাসে ডাক পড়ল জেমসের। ইঞ্জিনটি বিকল হওয়ায় তা সারানোর দরকার পড়েছে। তখন-ই আশ্চর্য হয়ে জেমস লক্ষ্য করেছিলেন, কত সামান্য শক্তি নিউকমেন মডেলের সেই ইঞ্জিনের! যাইহোক, বিকল ইঞ্জিনটি সারিয়ে তুললেন জেমস। কিন্তু তারপর থেকেই শুরু হল তাঁর নতুন সিস্টেম-এ আমূল পরিবর্তন করে উচ্চ ক্ষমতার ইঞ্জিন তৈরির চেষ্টা। সেই কাজেও বছর দুয়েকের মধ্যে সফল হলেন জেমস ওয়াট। আশি শতাংশ কম জ্বালানি ব্যবহার করে জেমস ওয়াটের এই স্টিম ইঞ্জিন (বাষ্পীয় শক্তিতে চালিত)। জেমস ওয়াটের স্টিম ইঞ্জিনের এই উদ্ভাবনার সময়কেই অনেকে মনে করেন শিল্পবিপ্লবের সূচনাকাল।

তাঁর সম্বন্ধে বিশ্ববন্দিত রসায়ন বিজ্ঞানী হামফ্রি ডেভি যা বলেছেন সেই কথাগুলি পড়ি— ‘James Watt was equally distinguished as a natural philosopher and chemist; his inventions demonstrate his profound knowledge of those sciences, and the peculiar characteristic of genius— the union of them for practical application.’

জেমস ওয়াটের মৃত্যুর দুশো বছর পেরিয়ে এসেছি। এই ব্রিটিশ ‘ম্যাথেমেটিক্যাল-ইন্সট্রুমেন্ট-মেকার’ ও ইঞ্জিনিয়ারকে আজ অন্তত একবার মনে করা দরকার। আরও একাধিক মেশিনারি উদ্ভাবনের সঙ্গে স্টিম ইঞ্জিনের আমূল পরিবর্তন করে নতুন রূপ দিয়েছেন তিনি। ‘লেটেন্ট-হিট’-এর (লীন তাপ) ধারণা দিয়েছেন উদ্ভাবনকারী ও ইঞ্জিনিয়ার জেমস ওয়াট। তাঁর উদ্ভাবনার সময়কাল থেকেই শিল্পবিপ্লবের শুরু হিসেবে ধরা হয় এবং ‘Father of the industrial revolution’ হিসেবে তাঁকে মান্যতা দেওয়া হয়। গ্লাসগো সিটি-সেন্টারের জর্জ স্কোয়ারে জেমস ওয়াটের একটি মূর্তি স্থাপিত হয়েছে।

আজ ১৯ জানুয়ারি। জেমস ওয়াটের (১৭৩৬-১৮১৯) জন্মদিন। এই মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার, উদ্ভাবক, রাসায়নিক ও দার্শনিককে আমাদের শ্রদ্ধা জানাই।

চিত্র: গুগল
5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শতবর্ষে মহানায়ক উত্তমকুমার

‘মহা’ শব্দটি মহান আর বিশাল, এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘মহাকাব্য’ বা ‘মহারাজ’। কাব্য আর রাজার চেয়ে তার মাত্রা ভিন্ন, মহিমা অনেক বেশি তাৎপর্যময়। উত্তম বাংলা চলচ্চিত্রের সেই তাৎপর্যময়তার একমাত্র উদাহরণ। যাঁকে শ্রদ্ধাভরে আমরা ‘কিংবদন্তি’-ও বলে থাকি। তাই সত্যজিৎ রায়ের মতো আরেক কিংবদন্তি তাঁকে নিয়ে চিত্রনাট্য লেখেন, ছবি বানান, আর সে ছবির ‘নায়ক’ হন উত্তমকুমার।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সুকান্ত ভট্টাচার্য: ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার সহোদর এক কবি

‘–ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে’, সুকান্ত লিখেছেন নিজের সম্পর্কে। বলেছেন, ‘আমি এক অঙ্কুরিত বীজ’। এই বীজ মহীরুহে পরিণত হতে পারল না, বাংলা সাহিত্যের পরম দুর্ভাগ্য এটা। কিন্তু তাঁর একুশ বছরের জীবনে তিনি আভাস দিয়ে গেছেন, তাঁর সম্ভাবনা কতদূর প্রসারিত হতে পারত। সুকান্ত মানে একজন কবিমাত্র নন, তার চেয়েও আরও অধিক কিছু।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও প্রসঙ্গত

প্রয়াণের আগে, সব হিসেব বাদ দিয়ে যদি তাঁর জীবনের শেষ পাঁচ বছরের কথা-ই ধরি, দেখব, কত প্রিয়জনের মৃত্যুশোক বহন করতে হয়েছে তাঁকে। যেহেতু তিনি ছিলেন মানুষের সান্নিধ্যপ্রিয়, তাই অন্যের চেয়ে ঢের ঢের বেশি মৃত্যুবেদনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। এসব মৃত্যু তাঁকে বেদনার্ত করলেও নিজের মনোবলের জোরে সে-অরুন্তুদ বিষাদকে কাটিয়েও উঠেছেন। পাশাপাশি মৃত্যু নিয়ে তাঁর দর্শন গড়ে উঠতেও তা ভূমিকা রেখেছে। তাই তিনি বলতে পারেন, তিনি-ই বলতে পারেন, ‘দুদিন দিয়ে ঘেরা ঘরে/ তাইতে যদি এতই ধরে/ চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়?’ কেন পারেন?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার: অন্য ও অনন্য

তাঁর জন্মদিনের চেয়েও মৃত্যুদিনটিকে অধিকভাবে স্মরণ করা হয়, এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। তাছাড়া বাংলা চলচ্চিত্র-জগতে তো কম খ্যাতিমান ব্যক্তির আবির্ভাব হয়নি, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল, ছবি বিশ্বাস-কানন দেবী-সুচিত্রা-সৌমিত্র, তবু তাঁর মতো, ঠিক তাঁর মতো স্মরণযোগ্য হয়ে রইলেন না কেউ। শ্রাবণের অনুষঙ্গে নয়, উত্তমকুমারের প্রয়াণদিবসটি চিহ্নিত চব্বিশে জুলাই তারিখটির বিধুরতায়। ১৯৮০-র এই দিনটিতে বাংলা চলচ্চিত্র-জগতের এই দিকপাল প্রতিভার জীবনাবসান ঘটে। আজ তাঁর মৃত্যুর পঁয়তাল্লিশ বছর পূর্তিতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করে উত্তম সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্যের ডালি।

Read More »
শৌনক দত্ত

রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী

নাটকটির নাম প্রথমে রেখেছিলেন যক্ষপুরী, তারপর নন্দিনী এবং পরিশেষে রক্তকরবী নামে থিতু হয়। শিলং-এ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে যে নাটক লেখা শুরু হয়েছিল তার দশম খসড়া প্রকাশিত হয় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রায় দেড় বছর পর আশ্বিন ১৩৩১ বঙ্গাব্দে—১৯২৪ সালে। প্রকাশিত হবার পরেও, একাদশতম খসড়া প্রস্তুত করার কথা ভাবেন নাট্যকার। অনেকেই বলেছেন, এটি নাট্যকারের হৃদয়ে লালন করা কোনও স্বপ্ন। কেউ কেউ এই নাটকের মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম চেতনার ছায়া খুঁজেছেন। নানা প্রশ্ন, নানা যুক্তি নিয়ে নাটকটি রচনার পর থেকে সমসাময়িক সময় পর্যন্ত দারুণ আলোচিত ও জনপ্রিয়। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত নাটকটি নিয়ে বহু আলোচনা। শতবর্ষে এসে দাঁড়ানো সেই রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নানামাত্রায় বিবেচনাযোগ্য একটি নাটক; বহুমাত্রিক এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।

Read More »
নুশান জান্নাত চৌধুরী

নুশান জান্নাত চৌধুরীর কবিতাগুচ্ছ

কিছুকাল ঘুমিয়ে, কিছুকাল লুকিয়ে,/ কিছু শহর, কিছু মানুষের ভিড়ে হারিয়ে/ আমি দেখি—// কোনও এক/ পথহারা দেবদূতের বিষণ্ণ ডানার পাশে/ আমি বুক পেতে দিয়েছি// চুলের ভেতর জন্ম নিয়েছে/ ঘাসফুল থোকা থোকা, বুকের মাঝখানে একটা প্রাচীন পেরেক,// ঝরাপাতার রাজ্যপাটে/ আমার বাম হাঁটুতে গেঁথে আছে—/ আগামী বছরের প্রথম সন্ধ্যা;

Read More »