Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও প্রসঙ্গত

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (২৬.০৯.১৮২০-২৯.০৭.১৮৯১) অন্তহীন অবদানের মধ্যে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবদানকে শীর্ষে রাখতে হবে, কেননা হাজার-দুই বছরের  নারীসমাজের পশ্চাৎপদতা দূর হয় তার ফলে। আজ আমরা বাঙালি-সমাজে নারীর যে বিস্ময়কর অগ্রগতি দেখি, তার প্রকৃত ভগীরথ নিঃসন্দেহে বিদ্যাসাগর। আর কেবল বাঙালির-ই নয়, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও যে তাঁর ভূমিকা ছিল, তার প্রমাণ, তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার বাইরেও সামাজিক আন্দোলন, স্ত্রী শিক্ষা বিস্তার, বিধবাবিবাহ অভিযান পরিচালিত হয়েছিল।

স্ত্রীশিক্ষা, বিধবাবিবাহ আর শিশু এবং নারীদের জন্য গ্রন্থরচনা (বর্ণপরিচয়,  শকুন্তলা) তাঁর ত্রিমুখী কর্মধারা। বিজ্ঞানমনস্কতা তা্ঁকে একদিকে ডাক্তার  মহেন্দ্রলাল সরকারের ‘Indian Association for the Cultivation of Science’-এর সঙ্গে যুক্ত করেছে অন্যদিকে বিজ্ঞান বিষয়ে লিখতে আগ্রহী করেছে।

তিনি তাঁর প্রগতিশীল ভাবধারা অর্জন করেন ১৮৩৮-এ ডিরোজিওর ‘সাধারণ  জ্ঞানোপার্জিকা সভা’-র সভ্যরূপে। এটি অবশ্য ডিরোজিওর মৃত্যুর পরে তাঁর শিষ্যদের দ্বারা পরিচালিত হত।

তিনি ছিলেন বাল্যবিবাহবিরোধী, যদিও তাঁর বিয়ে হয়েছিল চোদ্দ বছর বয়সে, ছ’বছরের কন্যার সঙ্গে। ১৮৭২-এ যে তৎকালীন সরকার তিন আইন পাশ করে, তার অন্তর্ভুক্ত ছিল ষোলো বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে না দেওয়া, বহুবিবাহ রোধ, এবং অসবর্ণ বিবাহের স্বীকৃতি। সেই স্বীকৃতির জোরে ১৮৮৩-তে প্রথম মহিলা বাঙালি চিকিৎসক কাদম্বিনী বসুর সঙ্গে বিয়ে হতে পেরেছিল দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের। আর বিদ্যাসাগর ১৮৫৬-তেই বিধবাবিবাহকে সরকারের মাধ্যমে আইনি স্বীকৃতি দেবার ভূমিকা পালন করেন। কেবল তা-ই নয়, নিজের উদ্যোগে শতাধিক বিয়ে দেন, সেই যুগে সর্বমোট বিরাশি হাজার টাকা ব্যয় করে (সূত্র: ইন্দ্র মিত্র, ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’)!

তবে ঐতিহাসিকভাবে দেখতে গেলে বিদ্যাসাগরের আগে ডিরোজিয়ানরাও বিধবাবিবাহে সোচ্চার ছিলেন। মুঘল আমলে স্বয়ং সম্রাট আকবর-ও চেষ্টিত ছিলেন। বিদ্যাসাগরের সমসাময়িককালে অনেকেই। যেমন ১৮৪২-এ ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’ বিধবাবিবাহের সপক্ষে প্রবন্ধ ছাপে। জনৈক লেখক প্রশ্ন তোলেন, ‘বিধবাদের শরীর কি শরীর নয়? তাহারা কি মহাবল ইন্দ্রিয়বলকে হাত বুলাইয়া শান্ত রাখিবে’?

Advertisement

তবু বিদ্যাসাগর আর বিধবাবিবাহ অচ্ছেদ্য। তাঁর ‘বিধবাবিবাহ প্রচারিত হওয়া উচিত কি না’ অকারণে পনেরো হাজার কপি ছাপতে হয়নি। অকারণে শান্তিপুরের তাঁতিরা কাপড়ে একথা বুনে দেননি ‘বেঁচে থাকুন বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে/ সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবাদের বিয়ে’! বিদ্যাসাগরের প্রথম বিধবাবিবাহের পাত্রী লক্ষ্মীমণি এই শান্তিপুরের-ই মেয়ে।

বিদ্যাসাগর নিঃসন্দেহে নারীমুক্তির অগ্রদূত। তবে আশ্চর্য লাগে ভাবতে, তাঁর সময়ে দাঁড়িয়ে নবাব ফয়েজউন্নিসাও (১৮৩৪-১৯০৩) যে নারীমুক্তির মশাল হাতে বিস্ময়কর কাজ করে গেছেন, তার খোঁজ তিনি পাননি! বিদ্যাসাগরের মতো তিনিও মেয়েদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন, নারীদের জন্য চিকিৎসালয় পর্যন্ত স্থাপন করেছেন। বিদ্যাসাগর জানলে খুশি হতেন, ১৮৮৯-তে ব্রিটেনের মহারানি  ভিক্টোরিয়ার কাছ থেকে ‘নবাব’ খেতাব পাওয়া ফয়েজউন্নেসা সংস্কৃত জানতেন। আর ১৮৬৫-তে যে বঙ্কিমের উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বেরোয়, তার মাত্র এগারো বছরের  মাথায় ১৮৭৬-এ আত্মপ্রকাশ করে বিদ্যাসাগরের ভূমিকার বাইরে সম্পূর্ণ নিজের অধ্যবসায়ে লেখাপড়া শেখা ফয়েজউন্নিসার। তাঁর ঔপন্যাসিকরূপে আবির্ভাব ‘রূপজালাল’ লিখে! বিদ্যাসাগর আছেন, কিন্তু তাঁর প্রভাব-বলয়ের বাইরে থেকেও রাসসুন্দরী দাসী, বিনোদিনী, ফয়েজউন্নিসা, বেগম রোকেয়া প্রমুখ যে কী কঠিন প্রতিকূলতা ভেদ করে উঠে এসেছেন, তার ইতিহাস লেখা হয়নি আজ-ও। বিদ্যাসাগর এবং এঁদের সমান্তরাল পাঠ জরুরি।

সংস্কৃত ভাষাকে সহজে অধিগত করতে পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীকে জলবৎ তরলং করে হাজির করলেন ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ লিখে, আর বিশ্বের দু-প্রান্তের দুই যুগন্ধর  নাট্যপ্রতিভাকে নিজস্ব অনুবাদরীতিতে কাছে এনে দিলেন,– কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ আর শেকসপিয়ারের ‘Comedy of Errors’ (অনুবাদে নাম দেন ‘ভ্রান্তিবিলাস’)। বাঙালি শিশুমাত্রকেই শেখালেন ‘বর্ণপরিচয়’। মধুসূদনকে ঘোর বিপদ থেকে উদ্ধারে প্রয়াসী তিনি বারবার। পঞ্চদশ শতকে ইওরোপের যে নবজাগরণ, তার-ই বার্তাবহ তিনি, তাই যুক্তিবাদ তাঁর আশ্রয়, বিজ্ঞান তাঁর সতত আরাধ্য, নারীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ তাঁর ইহলোকের ধ্যান।

সমসময় তাঁকে চেনেনি। বরং সর্বপ্রযত্নে বানচাল করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে তাঁর  প্রগতিশীল কাজকর্মকে। এই সময় ও বাঙালি সমাজ-ও কি চিনেছে তাঁকে? তাঁকে তাই শেষ জীবন কাটাতে হল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী থেকে দূরে সাঁওতাল পরগনায়। শেষ বয়সে উপলব্ধি করেছিলেন তিনি, যাদের জন্য তাঁর এই কাজ, সব অপাত্রে দান! তাই ক্ষোভের সঙ্গে লিখে গেছেন, ‘এদেশের উদ্ধার হইতে বহু বিলম্ব  আছে। পুরাতন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি বিশিষ্ট মানুষের চাষ উঠাইয়া দিয়া সাতপুরু মাটি তুলিয়া নতুন মানুষের চাষ করিতে পারিলে তবে এদেশের ভালো হয়।’ বাঙালি  সম্পর্কে এর চেয়ে মর্মান্তিক, চূড়ান্ত অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন উক্তি ও ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভবত আর হয় না।

4.7 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Sam
Sam
8 days ago

ভেতরকার অনেক সত্য জানা গেল।

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গা মাঈ কী! জয়!

ঢাকা বা সমগ্র বাংলাদেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজোর চাঁদা আদায়ের চল খুব একটা নেই। মণ্ডপে এসেই পাড়ার লোক চাঁদা দেন। জবরদস্তি করে চাঁদা আদায়ের যে বীভৎসতা কলকাতা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে আছে, তা অন্তত ঢাকা আর বরিশালে দেখিনি। পুজোর দিনেও অনেকে এসে প্যান্ডেলের পাশে চাঁদা আদায়কারীদের টেবিলের সামনে এসে চাঁদা দিয়ে যান। পাড়ার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। স্বেচ্ছায় এসে চাঁদা দিয়ে যান। এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও প্রসঙ্গত

সমসময় তাঁকে চেনেনি। বরং সর্বপ্রযত্নে বানচাল করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে তাঁর প্রগতিশীল কাজকর্মকে। এই সময় ও বাঙালি সমাজ-ও কি চিনেছে তাঁকে? তাঁকে তাই শেষ জীবন কাটাতে হল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী থেকে দূরে সাঁওতাল পরগনায়। শেষ বয়সে উপলব্ধি করেছিলেন তিনি, যাদের জন্য তাঁর এই কাজ, সব অপাত্রে দান!

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: দেড়শো বছরের সূচনায়

তাঁকে অনুবাদ করা হয় ভারতীয় নানা ভাষায় নানা সময়ে। তবুও কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ মূল্যায়িত হননি আজ-ও। বেশ কিছু অনুবাদ ছিল তাঁর, প্রথমজীবনে কলকাতা বাসকালে, হিন্দি থেকে ইংরেজিতে, যা হারিয়ে গেছে চিরতরে। বারো বছর রেঙ্গুন-পেরু পর্বে আগুন লেগে পুড়েছে তাঁর আঁকা ছবি, ‘চরিত্রহীন’-এর পাণ্ডুলিপি, পরে আবার যা লেখেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শতবর্ষে মহানায়ক উত্তমকুমার

‘মহা’ শব্দটি মহান আর বিশাল, এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘মহাকাব্য’ বা ‘মহারাজ’। কাব্য আর রাজার চেয়ে তার মাত্রা ভিন্ন, মহিমা অনেক বেশি তাৎপর্যময়। উত্তম বাংলা চলচ্চিত্রের সেই তাৎপর্যময়তার একমাত্র উদাহরণ। যাঁকে শ্রদ্ধাভরে আমরা ‘কিংবদন্তি’-ও বলে থাকি। তাই সত্যজিৎ রায়ের মতো আরেক কিংবদন্তি তাঁকে নিয়ে চিত্রনাট্য লেখেন, ছবি বানান, আর সে ছবির ‘নায়ক’ হন উত্তমকুমার।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কাজী নজরুল: ত্রস্ত ছায়াপথ

আমরা যদি তাঁর লেখা পড়ে তাঁকে অনুসরণ না করি, তাহলে বৃথাই তাঁকে স্মরণ। যেকোনও প্রতিভা আমাদের মানুষ হিসেবে আদর্শিক হয়ে উঠতে পারে তখনি, যখন আমরা তাঁর মানসিকতাকে অনুভব করে অন্তত চেষ্টা করব তাঁর পথকে ভালবাসতে। একদিকে পাঠ নিচ্ছি ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির কাবা নাই’ আর আচরণে ভিন্ন থাকছি, এ হল তাঁকে প্রকৃত অসম্মান। তাহলে তাঁর পাঠ না-ই বা নিলাম!

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সুকান্ত ভট্টাচার্য: ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার সহোদর এক কবি

‘–ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে’, সুকান্ত লিখেছেন নিজের সম্পর্কে। বলেছেন, ‘আমি এক অঙ্কুরিত বীজ’। এই বীজ মহীরুহে পরিণত হতে পারল না, বাংলা সাহিত্যের পরম দুর্ভাগ্য এটা। কিন্তু তাঁর একুশ বছরের জীবনে তিনি আভাস দিয়ে গেছেন, তাঁর সম্ভাবনা কতদূর প্রসারিত হতে পারত। সুকান্ত মানে একজন কবিমাত্র নন, তার চেয়েও আরও অধিক কিছু।

Read More »