Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বিধানচন্দ্র রায়: জন্মদিন মৃত্যুদিন

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস প্রয়াত হয়েছেন। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় এলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে, চিত্তরঞ্জনের প্রয়াণে শোকবার্তা প্রার্থনা করতে। স্বভাবরসিক রবীন্দ্রনাথ সেই নাজুক মুহূর্তেও খানিক রসিকতা না করে পারলেন না। ‘একটু অপেক্ষা করো বিধান। শোকবার্তা লেখা তো তোমার প্রেসক্রিপশন লেখা নয় যে ঝটিতি হয়ে যাবে।’ পরে তিনি যা লিখলেন দেশবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধায়, তা আমাদের সকলেরই জানা, ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ,/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান’!

এই বিধানচন্দ্রকেই রবীন্দ্রনাথ আরও একবার অপেক্ষা করতে বলেছিলেন, জীবনের একেবারে অন্তিমপর্বে। তখন কবি মৃত্যুশয্যায়। বিধানচন্দ্র কবির বাড়িতেই অপারেশনের সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত। এখনি শুরু হবে শল্যপর্ব। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করো বিধান। আমার বউমা (রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমাদেবী) শান্তিনিকেতন থেকে চিঠি দিয়েছে আমাকে, আমি তার উত্তরটা দিয়ে নিই।’ অপেক্ষা করেছিলেন বিধানচন্দ্র, যে-কারণে রবীন্দ্রজীবনের অন্তিম চিঠিটি লেখা সম্ভব হয়েছিল। সে-চিঠি অবশ্য নিজহাতে লিখতে পারেননি কবি। কেবল কম্পিত হাতে নামস‌ই করেছিলেন। কবি মুখে মুখে বলে গেছেন, লিখে নিয়েছিলেন রাণী চন্দ। রসিক রবীন্দ্রনাথ নয়, সেদিন আমরা পেলাম কর্তব্যসচেতন কবিকে, যিনি উপনিষদের এই বাণী শিরোধার্য করে নিয়েছিলেন, ‘কাজ করতে করতেই শতবছরের আয়ু প্রার্থনা করবে’, ‘কুর্বেন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিশেচ্ছতম্ সমা:’!

বিধানচন্দ্র রায়। ডাক্তার (MRCP/ FRCS), শিক্ষাবিদ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনীতিবিদ, পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, যিনি ছিলেন ‘পশ্চিমবঙ্গের রূপকার’, জন্মেছিলেন পয়লা জুলাই, ১৮৮২-তে। তিনি প্রয়াতও হন এ একই তারিখে, অর্থাৎ পয়লা জুলাই, ১৯৬২-র। উল্লেখ্য, শেরে বাংলা ফজলুল হক, অখণ্ড বাংলার একদা প্রধানমন্ত্রী ও পরে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী-ও সেই একই বছর মারা যান।

অঘোরকামিনী-প্রকাশচন্দ্রের ছয় সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ বিধানচন্দ্রের জীবনের কোন পর্ব দিয়ে তাঁর জীবনী অনুসরণ করা যায়? কেশবচন্দ্র সেনের নববিধান ব্রাহ্মসমাজের ‘বিধান’ অনুসৃত হয়েছে তাঁর নামকরণের ক্ষেত্রে। তাঁর পিতা ছিলেন এই সম্প্রদায়ের। বিস্ময়কর কম সময়ের মধ্যে তিনি FRCS এবং MRCP হন, অর্থাৎ শল্যচিকিৎসক ও ঔষধবিশেষজ্ঞ।

বিলেত থেকে ডাক্তারি পাশ করে এসেও কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চাকরি পাননি তিনি। তাই মেইল নার্সের চাকরি নিতে হয়েছিল তাঁকে, চালাতে হয়েছিল ট্যাকসিও!

বিহারের পাটনা জেলার বাকিপুরে জন্ম। ১৯৯৭-তে ম্যাট্রিক পাশ করার আগেই মাতৃবিয়োগ হয়। এফ‌ এ পড়েন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ফের পাটনা কলেজ, অঙ্কে অনার্স পাশ করেন সেখান থেকে। শেরে বাংলা-ও, মজার ব্যাপার, অঙ্কে মাস্টার্স!

এরপর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলেন তিনি। ১৯০১। এঞ্জিনিয়ার হ‌ওয়ার ইচ্ছেও কিন্তু ছিল। ১৯০৯-এ বিলেত গেলেন ডাক্তারিতে উচ্চশিক্ষা নিতে।

এসময়ে তার জীবনে অত্যাশ্চর্য একটি ঘটনা ঘটে। ডাক্তারিতে তিনি ভর্তি হতে পারছিলেন না ভর্তির তারিখ পার হয়ে যাওয়ায়। তিনি যেখানে ভর্তি হবেন, সেসময়ে সেখানে একজন রোগীকে নিয়ে এলেন রোগীর পরিবারের লোকজন। রোগীকে দেখেই বিধানচন্দ্র বলে দিলেন, রোগীর চিকেন পক্স হয়েছে। অথচ রোগীর গায়ে কিন্তু গুটি বেরোয়নি তখনও। ওখানকার কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, কীভাবে বিধানচন্দ্র রোগ শনাক্ত করলেন? তিনি বললেন, রোগীর শরীরের গন্ধ থেকে। দুদিন পর তাঁর কথাই সত্য প্রমাণিত হয়েছিল, গায়ে বসন্তের গুটি বেরিয়ে। অত‌এব ভর্তি হতে আর আর বাধা র‌ইল না।

পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ-গান্ধী-জ‌ওহরলালদের‌ চিকিৎসার ভার থাকত তাঁরই ওপর। ১৯৩০-এ রাজনীতি করার কারণে যখন তিনি কারাদণ্ড ভোগ করেন, সাধারণ কয়েদিদের চিকিৎসা করবেন বলে তিনি প্রথম শ্রেণির বন্দির সুবিধাদি ছেড়ে সশ্রম কারাদণ্ডের প্রার্থনা জানান জেল কর্তৃপক্ষকে। নিয়মবহির্ভূত হলেও তাঁর আবেদন মঞ্জুর হয়েছিল। ১৯১৩-৪৮ পর্বে গান্ধীজি যতবার অনশন করেছেন, বিধানচন্দ্র গান্ধীজির শয্যাপার্শ্বে। তাঁর সম্পর্কে গান্ধীর উক্তি, ‘Bidhan, the safety hand of India’!

Advertisement

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের হাত ধরে বিধানচন্দ্র রাজনীতিতে এলেন ১৯২৩-এ। পরে তিনি গান্ধীবাদী হন। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো দেশবরেণ্য নেতাকে হারিয়ে বিধানচন্দ্র আইনসভার নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৩১-৩৩ পর্যন্ত তিনি কলিকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি হন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, যে-পদে তিনি আমৃত্যু বহাল ছিলেন।

একদিকে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর আগমন, অন্যদিকে তীব্র বেকারসমস্যা, এই দুই বিশাল চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে তিনি দুটোরই সুষ্ঠু সমাধান করে গেছেন। রাজ্যের রাজধানী কলকাতার জনভার কমাতে তিনি রাজ্যের অন্যত্র শহর গড়ে তোলেন, সল্টলেক, কল্যাণী, দুর্গাপুর, অশোকনগর-কল্যাণগড়, হাবরা।

ছিলেন মেডিক্যাল কলেজ ও পরে নীলরতন হাসপাতালের ডাক্তার। তাছাড়া বাড়িতে প্রতিদিন বিনামূল্যে রোগী দেখতেন বারোমাস।

শিক্ষাক্ষেত্রেও তাঁর অবদান কম নয়। প্রাথমিক শিক্ষাকে তিনি অবৈতনিক করেন। শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি ঘটান। প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। স্থাপন করেন রোগনির্ণয় গবেষণাকেন্দ্র। শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি সাহায্যদানের মাধ্যমে। ঢেলে সাজিয়েছেন কলিকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণকে, হরিণঘাটা দুগ্ধ প্রকল্প চালু করে মিটিয়েছেন রাজ্যের দুগ্ধ-সংকট। দুর্গাপুর-বার্নপুর-আসানসোলে একের পর এক শিল্পকারখানা গড়ে তুলে যেমন বহু মানুষের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা করেছেন, তেমনই রাজ্যে এনেছেন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। বহু পতিত জমি উদ্ধারের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রেও বাড়িয়েছেন ফলন। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী পাটচাষের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন রাজ্যে।

তিনি নিজে স্বনামধন্য শিক্ষক। তাই চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকায়ন, কলকাতায় হার্ট সার্জারির সূচনা সহ বহু হাসপাতাল নির্মাণ ছিল তাঁর কাজের অন্তর্গত।

২৩. ০১. ১৯৪৮ থেকে আমৃত্যু, অর্থাৎ ০১. ০৭. ১৯৬২ পর্যন্ত ছিল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কার্যকাল। বহু সমস্যাকণ্টকিত রাজ্যটিকে তিনি যে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে গেছেন, সেজন্য দেশে ও বিদেশে নন্দিত তিনি আজও। তাঁর জন্মদিনটি ভারতে জাতীয় চিকিৎসক দিবসরূপে পালিত হয়। ১৯৬১-তে তিনি দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’-তে ভূষিত হন।

তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ এক হ‌ওয়ায় দেশবন্ধুজায়া বাসন্তীদেবীর মন্তব্য, ‘বিধান পুণ্যাত্মা। তাই জন্মদিনেই চলে গেল’!

চিত্র: গুগল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × 5 =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »