Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

কিংবদন্তি যদুভট্ট-কে গান শিখিয়েছেন গোবরডাঙ্গার গঙ্গানারায়ণ

উনিশ শতকের কলকাতা তথা বাংলার আদি ধ্রুপদাচার্য গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। খাণ্ডারবাণী ঘরানার সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে গঙ্গানারায়ণ তখন সঙ্গীতমহলে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন। শুধু তাই নয়, গঙ্গানারায়ণ ছিলেন ‘বাংলার তানসেন’; স্বনামধন্য যদুভট্টের সঙ্গীতগুরুও। তৎকালীন নদীয়ার কুশদহ পরগনা তথা বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙ্গায় থাকতেন ওস্তাদের ওস্তাদ গঙ্গানারায়ণ। এবং গোবরডাঙ্গার জমিদার মুখোপাধ্যায় পরিবারও তাঁর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অবশ্য তাঁকে ‘গোবরডাঙ্গার গঙ্গানারায়ণ ভট্ট’ বলে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে গঙ্গানারায়ণ থাকতেন কলকাতার জোড়াসাঁকোর অঞ্চলে, বর্তমান বলরাম দে স্ট্রিটে। সেখানেই সন্তানসম যদুভট্টকে মানুষ করেন গঙ্গানারায়ণ।

ধূর্জটীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কথা ও সুর’ গ্রন্থে সঙ্গীতসাধক গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়কে গোবরডাঙ্গার লোক বলেই বর্ণনা করেছেন। সেই বইতে তিনি লিখছেন, ‘‘…গোবরডাঙ্গার গঙ্গানারায়ণবাবুই সর্বপ্রথম পশ্চিমাঞ্চল থেকে মুসলমান ওস্তাদের নিকট ধ্রুপদ ও খেয়াল শিক্ষা করে দেশে ফেরেন।’’ এছাড়াও ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’-তে ঠাঁই পেয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ ও ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পত্রালাপ’। সেখানেও ধূর্জটিপ্রসাদ চিঠিতে কবিগুরুকে লিখছেন, ‘‘…ওয়াজিদ আলি শাহের দরবারে তো সকলেই যেতেন। গোবরডাঙ্গার গঙ্গানারায়ণ ভট্ট, হালিসহরের জামাই নবীনবাবু, পেনেটির মহেশবাবু, শ্রীরামপুরের মধুবাবু, বিষ্ণুপুরের যদুভট্ট, কোলকাতার নুলোগোপাল প্রভৃতি ওস্তাদরা তো সকলেই হিন্দুস্থানী চালে গাইতেন।’’

গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে। তাঁদের বাস ছিল তৎকালীন নদীয়ার কুশদহ পরগনার গোবরডাঙ্গায়। নদীয়ারই মুড়াগাছার বিল্বপুষ্করিণী গ্রামে গঙ্গানারায়ণের জন্ম বলে মত গবেষক দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়ের। সেখানে তাঁর মাতুলালয়। জানা যায়, মাত্র ১৬-১৭ বছর বয়সেই গঙ্গানারায়ণ সঙ্গীত শিক্ষালাভের জন্য ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এবং প্রায় ১০-১২ বছর ধরে কাশী, দিল্লি প্রভৃতি জায়গায় থেকে সঙ্গীতের তালিম নিয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়। ত্রিপুরার মহারাজা, মুর্শিদাবাদের নবাব, ‘কলিকাতা’-র হরকুমার ঠাকুর, শ্যামাচরণ মল্লিক, পোস্তার রায় পরিবার এবং গোবরডাঙ্গার মুখোপাধ্যায় পরিবার প্রভৃতি সঙ্গীতানুরাগীদের বিশেষ সমাদর লাভ করেন গঙ্গানারায়ণ এবং তাঁদের দরবারি সঙ্গীতসভায় নিয়মিত গঙ্গানারায়ণের গানের আসর বসানো হত।

তৎকালীন বঙ্গদেশে ‘ধ্রুপদিয়া’ হিসেবে গঙ্গানারায়ণের বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল। মুর্শিদাবাদের তৎকালীন নবাব গঙ্গানারায়ণের ধ্রুপদী গানে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ‘ধ্রুপদ বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ শিষ্য ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যুগান্তকারী পুরুষ যদুভট্ট বা যদুনাথ ভট্টাচার্য্য। কলকাতায় গুরু গঙ্গানারায়ণের আশ্রয়ে থেকে এবং গভীরভাবে তাঁর কাছে নানা সঙ্গীতরীতি রপ্ত করেন যদুভট্ট। যদুভট্ট ছাড়াও গঙ্গানারায়ণের অন্যতম শিষ্যদের মধ্যে পাথুরিয়াঘাটার হরপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। গঙ্গানারায়ণ ভৈরব রাগে সিদ্ধ ছিলেন বলে প্রসিদ্ধি আছে। তিনি সঙ্গীতের একটি ঘরানারও প্রবর্তন করেন। কলকাতার খ্যাতনামা বেহালাবাদক ও গায়ক তুলসীদাস চট্টোপাধ্যায় ছিলেন গঙ্গানারায়ণের পুতি অর্থাৎ নাতির ছেলে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্ৰন্থ ৪ খণ্ডের ‘সরল স্বরলিপি শিক্ষা’। তুলসীদাস সঙ্গীতের তালিম নেন প্ৰসিদ্ধ খেয়াল ও টপ্পাগায়ক রামকুমার মিশ্রের পুত্ৰ কেশবলালের কাছে।

অন্যদিকে, বিষ্ণুপুর ঘরানার কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ যদুভট্টের জন্ম বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে, ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে। পিতা মধুসূদন ভট্টাচার্য তাঁর প্রথম সঙ্গীতশিক্ষাগুরু। এরপর সঙ্গীতাচার্য রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের কাছে তালিম নিতে থাকেন। কিন্তু রামশঙ্কর প্রয়াত হলে পনেরো বছর বয়সী যদুভট্ট গান শেখার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে কোলকাতায় চলে আসেন। শোনা যায়, জীবনধারণের জন্যে এক ধনীগৃহে পাচকের কাজ নেন। সেখানেই চোখে পড়ে যান তৎকালীন বিখ্যাত ধ্রুপদ গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি কিশোর যদুভট্টকে আশ্রয় দেন ও গান শেখান। অনেক বছর পরে গুরুর নির্দেশিত পথে যদুভট্টও পশ্চিমাঞ্চলে যান এবং ভারতবর্ষের নানা ঘরানার গুণী সঙ্গীতজ্ঞের সঙ্গ লাভ করেন। বাঁকুড়ার কুচিয়াকোল নিবাসী রাজা রাজবল্লভ সিংহ মহাশয়ের রাজদরবারে সংগীতাচার্য হয়েছিলেন। হয়েছিলেন পঞ্চকোট ও ত্রিপুরার রাজদরবারের সভাগায়কও। এছাড়াও ত্রিপুরা ও বাংলার নানা দরবারে থেকেছেন, গান গেয়েছেন ও শিখিয়েছেন। লাভ করেছেন ‘তানরাজ’, ‘রঙ্গনাথ’ প্রভৃতি উপাধিও। রবীন্দ্রনাথও অল্পকাল যদুভট্টের কাছে মাৰ্গ সঙ্গীত শিখেছেন। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রও যদুভট্টের শিষ্য হয়েছিলেন এবং বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতের প্রথম সুর-সংযোজক তিনিই। যদুভট্টের বহু শিষ্যও পরবর্তী জীবনে বিখ্যাত হয়েছেন।

‘‘সম্ভবত তাঁর চেয়ে বড়ো ওস্তাদ তখন হিন্দুস্থানে অনেক ছিল, অর্থাৎ তাঁদের গানের সংগ্রহ আরো বেশি ছিল, তাঁদের কসরতও ছিল বহুসাধনাসাধ্য, কিন্তু যদুভট্টর মতো সংগীতভাবুক আধুনিক ভারতে আর কেউ জন্মেছে কিনা সন্দেহ। অবশ্য, এ কথাটা অস্বীকার করবার অধিকার সকলেরই আছে। কারণ, কলাবিদ্যায় যথার্থ গুণের প্রমাণ তর্কের দ্বারা স্থির হয় না, যষ্টির দ্বারাও নয়। যাই হোক, ওস্তাদ ছাঁচে ঢেলে তৈরি হতে পারে, যদুভট্ট বিধাতার স্বহস্তরচিত।’’ এই ছিল যদুভট্ট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মত। আসলে জীবৎকালেই যদুভট্ট কিংবদন্তিতে পরিণত হন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত হন ‘বাংলার তানসেন’ যদুভট্ট। অন্যদিকে, তাঁর কয়েক বছর আগে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত হয়েছেন যদুভট্টের গুরু ধ্রুপদাচার্য গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। যদুভট্টের নাম দেশের সঙ্গীতমহলে সকলেরই কম-বেশি জানা। তবে তাঁর গুরু গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায় হারিয়ে গিয়েছেন কালের অতলে। ইতিহাসে তাঁর নামটুকুই কেবল উচ্চারিত। তাঁকে মনে রাখেনি বাঙালি। বিস্মৃতিই এই সঙ্গীতসাধকের ভবিতব্য যেন!

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

 দেখুন, ধ্রুপদাচার্য গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে প্রথম ও একমাত্র তথ্যচিত্র।

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শতবর্ষে মহানায়ক উত্তমকুমার

‘মহা’ শব্দটি মহান আর বিশাল, এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘মহাকাব্য’ বা ‘মহারাজ’। কাব্য আর রাজার চেয়ে তার মাত্রা ভিন্ন, মহিমা অনেক বেশি তাৎপর্যময়। উত্তম বাংলা চলচ্চিত্রের সেই তাৎপর্যময়তার একমাত্র উদাহরণ। যাঁকে শ্রদ্ধাভরে আমরা ‘কিংবদন্তি’-ও বলে থাকি। তাই সত্যজিৎ রায়ের মতো আরেক কিংবদন্তি তাঁকে নিয়ে চিত্রনাট্য লেখেন, ছবি বানান, আর সে ছবির ‘নায়ক’ হন উত্তমকুমার।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সুকান্ত ভট্টাচার্য: ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার সহোদর এক কবি

‘–ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে’, সুকান্ত লিখেছেন নিজের সম্পর্কে। বলেছেন, ‘আমি এক অঙ্কুরিত বীজ’। এই বীজ মহীরুহে পরিণত হতে পারল না, বাংলা সাহিত্যের পরম দুর্ভাগ্য এটা। কিন্তু তাঁর একুশ বছরের জীবনে তিনি আভাস দিয়ে গেছেন, তাঁর সম্ভাবনা কতদূর প্রসারিত হতে পারত। সুকান্ত মানে একজন কবিমাত্র নন, তার চেয়েও আরও অধিক কিছু।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও প্রসঙ্গত

প্রয়াণের আগে, সব হিসেব বাদ দিয়ে যদি তাঁর জীবনের শেষ পাঁচ বছরের কথা-ই ধরি, দেখব, কত প্রিয়জনের মৃত্যুশোক বহন করতে হয়েছে তাঁকে। যেহেতু তিনি ছিলেন মানুষের সান্নিধ্যপ্রিয়, তাই অন্যের চেয়ে ঢের ঢের বেশি মৃত্যুবেদনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। এসব মৃত্যু তাঁকে বেদনার্ত করলেও নিজের মনোবলের জোরে সে-অরুন্তুদ বিষাদকে কাটিয়েও উঠেছেন। পাশাপাশি মৃত্যু নিয়ে তাঁর দর্শন গড়ে উঠতেও তা ভূমিকা রেখেছে। তাই তিনি বলতে পারেন, তিনি-ই বলতে পারেন, ‘দুদিন দিয়ে ঘেরা ঘরে/ তাইতে যদি এতই ধরে/ চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়?’ কেন পারেন?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার: অন্য ও অনন্য

তাঁর জন্মদিনের চেয়েও মৃত্যুদিনটিকে অধিকভাবে স্মরণ করা হয়, এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। তাছাড়া বাংলা চলচ্চিত্র-জগতে তো কম খ্যাতিমান ব্যক্তির আবির্ভাব হয়নি, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল, ছবি বিশ্বাস-কানন দেবী-সুচিত্রা-সৌমিত্র, তবু তাঁর মতো, ঠিক তাঁর মতো স্মরণযোগ্য হয়ে রইলেন না কেউ। শ্রাবণের অনুষঙ্গে নয়, উত্তমকুমারের প্রয়াণদিবসটি চিহ্নিত চব্বিশে জুলাই তারিখটির বিধুরতায়। ১৯৮০-র এই দিনটিতে বাংলা চলচ্চিত্র-জগতের এই দিকপাল প্রতিভার জীবনাবসান ঘটে। আজ তাঁর মৃত্যুর পঁয়তাল্লিশ বছর পূর্তিতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করে উত্তম সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্যের ডালি।

Read More »
শৌনক দত্ত

রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী

নাটকটির নাম প্রথমে রেখেছিলেন যক্ষপুরী, তারপর নন্দিনী এবং পরিশেষে রক্তকরবী নামে থিতু হয়। শিলং-এ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে যে নাটক লেখা শুরু হয়েছিল তার দশম খসড়া প্রকাশিত হয় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রায় দেড় বছর পর আশ্বিন ১৩৩১ বঙ্গাব্দে—১৯২৪ সালে। প্রকাশিত হবার পরেও, একাদশতম খসড়া প্রস্তুত করার কথা ভাবেন নাট্যকার। অনেকেই বলেছেন, এটি নাট্যকারের হৃদয়ে লালন করা কোনও স্বপ্ন। কেউ কেউ এই নাটকের মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম চেতনার ছায়া খুঁজেছেন। নানা প্রশ্ন, নানা যুক্তি নিয়ে নাটকটি রচনার পর থেকে সমসাময়িক সময় পর্যন্ত দারুণ আলোচিত ও জনপ্রিয়। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত নাটকটি নিয়ে বহু আলোচনা। শতবর্ষে এসে দাঁড়ানো সেই রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নানামাত্রায় বিবেচনাযোগ্য একটি নাটক; বহুমাত্রিক এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।

Read More »
নুশান জান্নাত চৌধুরী

নুশান জান্নাত চৌধুরীর কবিতাগুচ্ছ

কিছুকাল ঘুমিয়ে, কিছুকাল লুকিয়ে,/ কিছু শহর, কিছু মানুষের ভিড়ে হারিয়ে/ আমি দেখি—// কোনও এক/ পথহারা দেবদূতের বিষণ্ণ ডানার পাশে/ আমি বুক পেতে দিয়েছি// চুলের ভেতর জন্ম নিয়েছে/ ঘাসফুল থোকা থোকা, বুকের মাঝখানে একটা প্রাচীন পেরেক,// ঝরাপাতার রাজ্যপাটে/ আমার বাম হাঁটুতে গেঁথে আছে—/ আগামী বছরের প্রথম সন্ধ্যা;

Read More »