Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বিশেষ নিবন্ধ: ড. প্রদীপকুমার দাশগুপ্ত

রবীন্দ্রমননে প্রেম: কিছু কাব্য, কিছু অনুভব

স্বল্প পরিসরে এমন এক জটিল বহুবিতর্কিত বিষয়ে আলোকপাত কাব্যের মতন কলায় সম্ভব হলেও প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে সম্ভব কি না জানি না— যেখানে প্রেম প্রসঙ্গে রবীন্দ্রমননের বিশ্লেষণ অভিলক্ষ্য। আলোচনার সুবিধার্থে তাঁর প্রেমের কাব্যশৈলীকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে: ১) প্রাক ‘মানসী’ পর্ব, ২) ‘মানসী’ এবং ‘মানসী’-পরবর্তী পর্ব, যদিও এভাবে বিভাজন তাঁর কাব্যধারার নিয়ত বহমানতার অঙ্গহানি ঘটায় কিন্তু লেখকের অকিঞ্চিৎকর প্রয়াসকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে বিচার করলে বোধহয় অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে।
‘কড়ি ও কোমল’-এর ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন, ‘এই আমার প্রথম কবিতার বই যার মধ্য দিয়ে বৈচিত্র এবং বহির্দৃষ্টির প্রবণতা দেখা দিয়েছে।’ তা হলে ‘প্রভাত সঙ্গীত’ বা ‘সন্ধ্যা সঙ্গীত’-এ কবির যে বিপুল প্রাণশক্তির বহিঃপ্রকাশ এবং আত্মনিমগ্নতার নির্মোক উন্মোচন লক্ষিত হয়, তা কি কবির অন্তরবাণী নয়? আসলে, গোটা রবীন্দ্রসৃজন, মনন সম্পৃক্ত হয়ে আছে এরকম বহু বিচিত্র দোলাচলে। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে কাদম্বরী দেবীর অকালমৃত্যু চব্বিশ বছরের যুবক রবীন্দ্রনাথের মানসে যে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল, ‘সন্ধ্যা সঙ্গীত’-এ সেই আত্মনিমগ্ন বিষাদের বাষ্প আচ্ছন্ন হয়ে আছে। বিজ্ঞজন একে দুঃখবিলাস বলে অভিহিত করেছেন, নতুন বৌঠানকে নিয়ে তিনি যে নন্দনকানন নির্মাণ করেছিলেন, সেই paradise lost কবির মনোজগতে এক বায়রনিক বিষাদের বহমানতা সৃষ্টি করেছিল। এই বিষাদ তাঁর আজীবন ছিল কিন্তু তাঁর অনুভবের প্রকাশমাত্রা কাব্য থেকে কাব্যান্তরে ভিন্নতর বিমূর্ত রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ‘কড়ি ও কোমল’ কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর দু’বছর পর প্রকাশিত হয়। যদি কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুতে তাঁর হৃদয় তীব্র যন্ত্রণায় আশ্লিষ্ট থাকত, তা হলে কবিতাগুলোতে তার আভাস অবশ্যই মিলত, তার বদলে বরং দুটি বিপরীত রাগিণী একই সাথে বেজে উঠেছে— জীবনের জয়গান, সুন্দর পৃথিবীতে মানুষকে নিয়ে যাপনের অভিপ্রায়, অন্যদিকে ‘মৃত্যুর নিবিড় উপলব্ধি’। তাঁর জীবনে অজস্র প্রিয় মানুষের মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে বারবার ভেঙে নতুন এক রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছে।
‘এই সূর্যকরে এই পুঞ্জিত কাননে/ জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই!/ ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত,/ বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রুময়—/ মানবের সুখেদুঃখে গাঁথিয়া সঙ্গীত/ যদিগো রচিতে পারি অমর আলয়!/ তা যদি না পারি তবে বাঁচি যতকাল/ তোমাদের মাঝে লভি যেন ঠাঁই।’
(কড়ি ও কোমল — প্রাণ)

মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি মাকে হারান, নতুন বৌঠানের স্নেহ, সাহচর্য, আশ্রয়ে আবার তাঁর জীবনের ভিন্নতর নির্মিতি। সেটা স্নেহ হোক, দুই প্রায় সমবয়সীর মধ্যে অবুঝ ভাল লাগা হোক, যার পরিণতি প্রেমও হতে পারে। সেই বিচিত্র রসায়ন তাঁকে ‘মানসী’ রচনায় প্রবুদ্ধ করেছে।
‘মানসী’ রবীন্দ্রমননে মানসপ্রতিমা নির্মাণের এক দীর্ঘ বিলম্বিত প্রয়াস। সুদীর্ঘ তিনবছর ধরে একটু একটু করে সে মানস প্রতিমার নির্মিতি— ‘একজন কবির সাথে যেন একজন শিল্পী এসে যোগ দিল’, কবির ভাবলোকের মানসপ্রতিমার বিমূর্ত রূপ ধরা দিল শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায়। ভাবের আচ্ছন্নতা অপসারিত, ভাষার প্রকাশ সুদৃঢ়, আবেগ সংযত, অতিবিস্তারের প্রবণতা বর্জিত, স্বচ্ছ সাবলীল চলনে মানস প্রতিমার নির্মাণ। জানি না কালিদাসের ‘মেঘদূত’ বা কিটসের রচনা তাঁর ব্যক্তিমানসে এই কাব্য রচনায় কোনও প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেছিল কি না। তবে যে অতৃপ্তি ও নৈরাশ্যের ঘন ছায়া তাঁর প্রেমের কবিতায় লক্ষ্য করা যায়, তা কখনও মনে হয় কিটসের রোমান্টিসিজমের প্রতিভাস, কখনও মনে হয় এ অতৃপ্তি মেঘদূতের বিরহী যক্ষের মানসপ্রতিমা নির্মাণের এক দুর্বার প্রয়াস:
‘অন্ধকার রুদ্ধগৃহে একেলা বসিয়া/ পড়িতেছি মেঘদূত, গৃহত্যাগী মন/ মুক্তগতি মেঘপৃষ্ঠে লয়েছে আসন,/ উড়িয়াছে দেশদেশান্তরে। কোথা আছে/ সানুমান আম্রকুট, কোথা রহিয়াছে/ বিমল বিশীর্ণ রেবা বিন্ধ্যপদমূলে/ উপলব্যথিতগতি; বেত্রবতী কূলে।’
(মেঘদূত — মানসী)

এই মানসযাত্রায় কবি তাঁর মানসীর অধরা প্রেমকে অদ্ভুত এক অতৃপ্তির আলো-আঁধারে খুঁজে ফিরেছেন:
‘কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ?/ সশরীরে কোন্ নর গেছে সেইখানে,/ মানসসরসীতীরে বিরহ শয়ানে,/ রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদোষের দেশে/ জগতের নদী গিরি সকলের শেষে।’
(মেঘদূত — মানসী)

এই অতৃপ্তি তাঁকে তাড়িত করেছে, প্রাণিত করেছে তাঁর মানসপ্রতিমা নির্মাণে। তিনি নিজেই বলেছেন,— ‘মানসীর প্রেমের কবিতার মধ্যে ঈশ্বরের জন্মকথা লেখা আছে—’। এই ঈশ্বর কে? যাঁকে আমরা খুঁজে ফিরি অধ্যাত্মচেতনার রহস্যময়তায়— তিনি? না এই ঈশ্বর তাঁর নিজের হাতে তৈরি মানসপ্রতিমা—‘মানসীতে যাকে খাড়া করেছি সে মানসেই আছে, সে আর্টিস্টের হাতে রচিত ঈশ্বরের প্রথম অসম্পূর্ণ প্রতিমা, ক্রমে ক্রমে শেষ হবে কি?’ তাঁর এ বক্তব্যে মানসীর নির্মাণের সামান্য আভাস পাওয়া গেলেও তাঁর নৈরাশ্য বা অতৃপ্তির  ব্যাখ্যা মেলে না। এ বিষয়ে প্রমথ চৌধুরীর একটি পত্রের উত্তরে তিনি প্রায় এড়িয়ে যাওয়ার মতো উত্তর দেন— ‘এক একবার মনে হয় আমার মধ্যে দুটি বিপরীত শক্তির দ্বন্দ্ব চলছে। একটা আমাকে সর্বদা বিশ্রাম ও পরিসমাপ্তির দিকে টানছে আর একটা আমাকে কিছুতে বিশ্রাম করতে দিচ্ছে না। আমার ভারতবর্ষীয় শান্ত প্রকৃতিকে ইয়োরোপের চাঞ্চল্য সর্বদা আঘাত করছে… একদিকে কর্মের প্রতি আসক্তি, অন্যদিকে চিন্তার প্রতি আকর্ষণ। সবশুদ্ধ জড়িয়ে একটা নিষ্ফলতা এবং ঔদাসীন্য।’ ভাবুক সত্ত্বা এবং কর্মী সত্ত্বার বিরোধ অবশ্যই রবীন্দ্রনাথমানসে আশ্লিষ্ট হয়েছিল কিন্তু এর থেকে প্রমথ চৌধুরীর প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আমরা পেলাম না। মানসীপ্রতিমা নির্মাণে তিনি ঈশ্বরের জন্মকথার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে থেমে গেছেন। ‘মানসী’ কাব্যে জীবনদেবতা প্রসঙ্গের অবতারণা ঘটেনি, আসলে ওই প্রতিমার অন্তরালে ‘আত্মার যে রহস্য-শিখা কাঁপছে’ তার অনুসন্ধানই কি তাঁকে জীবনদেবতার পরম উপস্থিতির বোধিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল?

রবীন্দ্রমননে প্রেমের আনুভূতিক ফর্ম বাঁক নিয়েছে বারবার— মানসী সেই বারবার খুঁজে ফেরা নৈরাশ্য ও অতৃপ্তির রহস্য ঘেরা ক্রমনির্মিতির অবিরাম এক ধারাপাত, যে মানসীপ্রতিমা তাঁর দৃষ্টিতে ধরা দেয় তার রূপলাবণ্যে অতৃপ্ত হয়ে খুঁজে ফেরেন অন্তরালে লুকানো আধ্যাত্মিক সত্ত্বাকে যে ‘আত্মার রহস্য-শিখা কাঁপছে’— তাকে। তিনি এ কথা জানেন যে, এই খোঁজা, এ নীরব ক্রন্দন হয়তো ব্যর্থ হবে কিন্তু এই নিরুদ্দেশ যাত্রা হয়তো অনন্তযাত্রা পথের দ্বার উন্মোচন করে দিতে পারে। তাঁর অতৃপ্তি আর নৈরাশ্যের খানিকটা হলেও আভাস পাওয়া গেল। প্রেয়সীর মধ্যে তিনি খুঁজে ফেরেন এমন এক সৌন্দর্যকে যা তাঁর মানবিক সত্ত্বাকে ছাপিয়ে বহুদূর প্রসারিত, কালের সীমারেখা পেরিয়ে অসীমে ব্যাপৃত— প্রেমিকের খোঁজ কিন্তু বহমান, একটি মূর্ত ব্যক্তি-স্বরূপের অন্তরালে বিমূর্ত অখণ্ড অনন্তের আভাস। মাঝেমাঝে এই আভাস তাঁর দৃষ্টি ঝলসে দেয় কিন্তু সে প্রতিমা অধরাই থেকে যায়,
‘অকূল সাগর মাঝে চলেছে ভাসিয়া
জীবনতরণী, ধীরে লাগিছে আসিয়া
তোমার বাতাস’।

বাস্তবের রক্তমাংসে গড়া প্রেয়সীর  কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গভীর ব্যথা ও অসম্ভব দুরাশায় প্রেমিক কবি বেরিয়ে পড়েছেন তাঁর মানসপ্রতিমার সন্ধানে, ‘সংসারের খেলাঘরে’ যে খণ্ডিতাকে ছেড়ে এলেন আর ‘সর্বপ্রান্ত দেশের’ ও পারাপারের যে পূর্ণতার দিকে নিরুদ্দেশ মাঝে ভেসে চলেছেন, এ-দুজনের বিপরীতমুখী টানে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ। ‘মানসী’-র অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘বিদায়’ এই ব্যথার আশ্চর্য সুন্দর এক প্রকাশ, এই কবিতাটি তাঁর বাস্তব মানুষী প্রিয়াকেই সম্বোধন করে লেখা, যা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। মানুষী প্রতিমাকে পাওয়ার জন্য যতখানি ব্যাকুলতা তার চেয়ে গৃহকর্মরতা রক্তমাংসে গড়া মানুষটিকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনা অনেক বেশি গভীর—
‘এই তটপ্রান্তে বসে শ্রান্ত দু’নয়ানে/ চেয়ে দেখো ওই অস্ত-অচলের পানে/ সন্ধ্যার তিমিরে, যেথা সাগরের কোলে/ আকাশ মিশায়ে গেছে। দেখিবে তা হলে/ আমার সে বিদায়ের শেষ চেয়ে-দেখা/ এইখানে রেখে গেছে জ্যোতির্ময় রেখা ।/সে অমর অশ্রুবিন্দু সন্ধ্যাতারকার/ বিষন্ন আকার ধরি উদিবে তোমার/ নিদ্রাতুর আঁখি-পরে; সারারাত্রি ধরে/ তোমার সে জনহীন বিশ্রাম শিয়রে/ একাকী জাগিয়া রবে…’।
(বিদায় — মানসী)

‘মানসী’ কাব্যে যে অতৃপ্তি ও নৈরাশ্যের অস্থির ছায়া লক্ষিত হয় তার একটা conclusive আভাস পাই ‘অনন্ত প্রেম’ কবিতাটিতে—
‘অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে/ দেখা দেয় অবশেষে/ কালের তিমিররজনী ভেদিয়া/ তোমার মূরতি এসে/ চির স্মৃতিময়ী ধ্রুব তারকার বেশে।।/ আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের স্রোতে/ অনাদি কালের হৃদয় উৎস হতে’।

অবশেষে সেই মানসীপ্রতিমা কালের তিমিররজনী ভেদিয়া কি কবিমানসে প্রতিভাত হয়? জানি না, সত্যিই আমরা জানি না কবিমননের এই বিচিত্র রসায়নের conclusive অভিলক্ষ্যে পৌঁছানো যায় কি না।
যারা সৌন্দর্যের মধ্যে সত্যি সত্যি নিমগ্ন হতে অক্ষম, তারাই সৌন্দর্যকে কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের ধন বলে অবজ্ঞা করে কিন্তু এর মধ্যে যে অনির্বচনীয় গভীরতা আছে তার আস্বাদ যারা পেয়েছে তারা জানে, সৌন্দর্য ইন্দ্রিয়ের চূড়ান্ত শক্তিরও অতীত। কেবল চক্ষুকর্ণ দূরে থাক, সমস্ত হৃদয় নিয়ে প্রবেশ করলেও ব্যাকুলতার শেষ পাওয়া যায় না।
(ছিন্ন পত্রাবলী)

যে মানসসুন্দরীকে আমরা প্রত্যক্ষ করি নারীরূপে ‘প্রণয়-বিধুরা সীমন্তিনীরূপে, প্রকৃতপক্ষে তা নিরাকার এবং নিঃসীম, তিনি এ সৌন্দর্যের পূর্ণতাকেই খুঁজে ফিরেছেন নারীর দেহমনের লীলায়, প্রকৃতির বর্ণগন্ধের বৈভবে যা অস্ফুট তাই সমস্ত হৃদয় দিয়ে বারবার প্রয়াস পেয়েছেন সৌন্দর্যের অন্তরালে ‘আত্মার রহস্য শিখা’ অনুসন্ধানে। তার ব্যর্থতায় নৈরাশ্য, আত্মনিমগ্নতা, অতৃপ্তিই বোধকরি ‘মানসী’ কাব্যে রবীন্দ্রমননে প্রেমের মূল মর্মবাণী।

‘সোনার তরী’ কাব্যে তাঁর মননে ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায় মানসপ্রতিমাকে পেলাম কবির একদম কাছাকাছি, স্বয়ং হাল ধরেছেন কবি সোনার তরীর মুখে তার রহস্যময় হাসি, এক অনির্দেশ যাত্রায়। কান্ডারি মানসসুন্দরী এখানে অস্ফুট, কবি শুধু তার দেহসৌরভ অনুভব করেন সাথে বিপুল কেশপাশের আভাস, অনন্তযাত্রায় শুধু তার রহস্যময় হাসিই কবির গন্তব্য জানার প্রত্যুত্তর। আসলে যে চিত্রকল্পের প্রয়োগে কবি তাঁর মানসসুন্দরীকে রেখায়িত করতে চেয়েছেন, তাতে মানসীর অধরা সন্ধান থেকে বোধের সীমারেখায় যেন চিত্রিত।
‘যখনই শুধাই ওগো বিদেশিনী/ তুমি হাসো শুধু, মধুর হাসিনী/ নীরবে দেখাও অঙ্গুলি/ আকূল সিন্ধু উঠেছে আকুলি

কী আছে হোথায় চলেছি কিসের অন্বেষণে?’

আসলে, ‘মানসী’ কাব্যে যে অতৃপ্তি নৈরাশ্য তাঁকে ব্যস্ত করে রেখেছিল, ‘সোনার তরী’-তে সে অতৃপ্তির ছোঁয়া থাকলেও তিনি তাঁর মানসসুন্দরীর বিনির্মাণ করেছেন, যদিও মানসসুন্দরী বাঙ্ময় নয় তবুও হাল ধরেছেন ‘সোনার তরী’-র ‘মানসসুন্দরী’ কবিতায় রোমান্টিক রহস্যময়তা নয়, অধরা বাণীই মানসসুন্দরী হয়ে কবির বাহুবন্ধনে—
‘…সব ফেলে দিয়ে/ ছন্দোবদ্ধ গ্রন্থগীত— এসো তুমি প্রিয়ে/ আজন্ম-সাধন-ধন সুন্দরী আমার,/ কবিতা, কল্পনালতা শুধু একবার কাছে বোসো’।

বোধহয় তাঁর মানসসুন্দরীর স্বরূপ এখানে সামান্য হলেও একটুখানি আভাসিত, ‘কবিতা কল্পনালতা’ দিয়েই কি তাঁর মানসসুন্দরীর নির্মাণ? তাঁর আকুল প্রণয়চিত্র কি এ স্বনির্মিত মানসসুন্দরীকেই আবর্তন করে? এক মহত্তর উত্তরণের প্রান্তসীমায় এই মানসসুন্দরীই কি একটু একটু করে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে গেছে? আপনার মনের মাধুরী মিশায়ে তাঁর এই প্রতিমার নির্মাণ প্রয়াস এক সুদক্ষ আর্টিস্টের হাতে শিল্পীত বিমূর্ত ভাবনার প্রতীক, কবিতায় symbolism-এর সংকেত। পরে পাঠক এই প্রতিমার মর্মমূলে প্রবেশ করতে পারলেও কবির প্রেমিক সত্ত্বার পরম উপস্থিতিতে পৌঁছানো দুষ্কর।
‘চিরজীবনের মোর ধ্রুবতারা সম/ চিরপরিচয়-ভরা ওই কালো চোখ।/ আমার নয়ন হতে লইয়া আলোক,/ আমার অন্তর হতে লইয়া বাসনা/ আমার গোপন প্রেম করেছে রচনা/ এই মুখখানি’।
(সোনার তরী — মানসসুন্দরী)

এই ‘মানসসুন্দরী’-ই তাঁর আজন্ম সাধনার ধন— তাঁর ঈশ্বরকথার নির্মিতি। অনেক পরে আমরা দেখা পাব তাঁর জীবনদেবতার, যিনি তাঁর হাত ধরে নির্মাণ করিয়েছেন এই  প্রতিমাকে— যে জীবনদেবতা সে কবির কবি।

‘চিত্রা’ কাব্যে সেই জীবনদেবতার কথা স্পষ্ট ভাষায় কবি পাঠককে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাই ‘চিত্রা’ কাব্য রবীন্দ্রমননে প্রেমের অনেক break-through। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পাঠককে বুঝিয়েছেন ‘চিত্রা’ কাব্যের জীবনদেবতা মানুষের বর্ণিত ঈশ্বর নন, ‘‘ধর্ম শাস্ত্রে যাহাকে ঈশ্বর বলে তিনি বিশ্বলোকের, আমি তাহার কথা বলি নাই। যিনি বিশেষরূপে আমার, অনাদি অনন্তকাল একমাত্র আমার, ‘চিত্রা’ কাব্যে তাঁহারি কথা আছে।’’ এই জীবনদেবতা কিন্তু ‘মানসসুন্দরী’-র মতো কবির অন্তর্মানসবিহারী নন, তিনি রয়েছেন তাঁর প্রত্যক্ষ অনুভূতিতে। ১৮৯০ সাল নাগাদ বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার শাহজাদপুরে অবস্থানকালে কবির চেতনায় জীবনদেবতার আভাস লক্ষিত হয়। তাঁর প্রত্যক্ষ অনুভূতিতে ধরা পড়ে যে, তাঁর কবিতা এমন এক স্তরে পৌঁছে যায় যেখানে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর পরিমিত শক্তিতে এবং সচেতন চেষ্টায় সম্ভব ছিল বলে তিনি ভাবতে পারেন না। কোনও এক অদৃশ্য মহান শিল্পী তাঁর হাত দিয়ে এই অসাধ্যসাধন করে চলেছেন। এই অদৃশ্য অন্তর্যামী কবি প্রতিভাই কবির জীবনদেবতা। এই জীবন দেবতাকেই তিনি বলেছেন ‘রচয়িতার মধ্যে আর একজন রচনাকারী’, যিনি কেবলমাত্র কাব্যনির্মাণের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করছেন না, ‘আমার সমস্ত ভালোমন্দ, আমার অনুকূল প্রতিকূল উপকরণ লইয়া আমার জীবন রচনা করিয়া চলিয়াছেন।’ প্রেমিকা যেমন তার প্রেমাস্পদের হাতে আপনাকে সমর্পণ করে পরম সুখ ও সার্বিক সার্থকতা লাভ করে, কবি তেমনই তাঁর জীবনের সমস্ত কর্ম, সফলতা, ব্যর্থতা, ছন্দ-রাগিণী সেই জীবনদেবতার তরে নিবেদন করেছেন। প্রিয় সম্ভাষণের মধুর করুণ চিত্রকল্পের প্রয়োগে জীবনদেবতার চরণধ্বনি—
‘ওহে অন্তরতম,/ মিটেছে কি সকল তিয়াস আসি অন্তরে মম। … … কত যে বরণ কত যে গন্ধ/ কত যে রাগিণী কত যে ছন্দ/ গাঁথিয়া গাঁথিয়া করেছি বয়ন/ বাসরশয়ন তব—/ গলায়ে গলায়ে বাসনার সোনা,/ প্রতিদিন আমি করেছি রচনা/ তোমার ক্ষণিক খেলার লাগিয়া/ মুরতি  নিত্যনব।’
(চিত্রা — জীবনদেবতা)

পাঠক এক অদ্ভুত দোলাচলে, কে এই অন্তরতম? কার তরে এমন সর্বস্ব নিবেদন? ইনিই কবির জীবনদেবতা যিনি কবির সবটুকু নিয়ে নির্মাণ ও বিনির্মাণ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত, মানবিক প্রতিভার ধরাছোঁয়ার বাইরে উত্তরণ ঘটিয়েছেন অতিমানবিক এক বিমূর্ত প্রতিভার স্তরে।
‘চিত্রা’ কাব্যে ‘চিত্রা’ কবিতাটিতে তিনি তাঁর মানসসুন্দরীকে প্রত্যক্ষ করেছেন জগৎ মাঝে—
‘জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে/ তুমি বিচিত্ররূপিনী’।

আবার অন্তর মাঝে ডুব দিয়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেন সেই মানসসুন্দরীর এক ভিন্ন রূপ, যা একান্তই তাঁর একার, তাঁর কাব্যের বোধের চালিকাশক্তি। সে কিন্তু জগতের নয়— তাঁর নিভৃত প্রাণের অন্তরবাসিনী—
‘অন্তর মাঝে তুমি শুধু একা একাকী/ তুমি অন্তরবাসিনী’।

Advertisement

অপরিজ্ঞাত এই অন্তরবাসিনী, তাঁর মানসুন্দরী নয়, এ তাঁর জীবনদেবতা, যার তরে তাঁর তৃষ্ণা, উৎকণ্ঠা কাব্য অনুভূতিকে অন্য মাত্রায় সংরক্ত করেছে আর একই সাথে পাঠককে তাড়িত করেছে রহস্যময়তার স্নিগ্ধ দীপালোকে।
‘কল্পনা’ কাব্যে তাঁর মানসসুন্দরী ধরার বন্ধন থেকে এক অদ্ভুত অধরায় বিলীয়মান—
‘তোমার প্রণয় যুগে যুগে মোর লাগিয়া/ জগতে জগতে ফিরিতেছিল কি জাগিয়া?/ এ কি সত্য?’
(কল্পনা — প্রণয় প্রশ্ন)

প্রেমের বহমানতাকে কালাকালের সীমারেখা অতিক্রম করিয়ে অনন্ত অসীমে স্থাপনার প্রবণতা এ কাব্যের চালচিত্র—
‘মোরে হেরি প্রিয়া/ ধীরে ধীরে দীপখানি দ্বারে নামাইয়া/ আইলো সম্মুখে— মোর হস্তে হস্ত রাখি,/ নীরবে শুধালো শুধু, সকরুণ আঁখি,/ হে বন্ধু, আছো তো ভালো?’
(কল্পনা — স্বপ্ন)

এক দীর্ঘ পরিক্রমা চলেছে কাব্যের অন্তর্লোক ভেদ করে অনন্তযাত্রায়, যেখানে তাঁর চিরকালের মানসসুন্দরী অচঞ্চল প্রতীক্ষারত, গভীর ‘স্বপ্ন’ সন্ধানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় তাঁর সেই পরিক্রমা, পৌঁছে যান কালিদাসের কালে, এ কি জন্মান্তরের সন্ধান? প্রেমের তরে পূর্বজন্মের ‘প্রথমা প্রিয়া’-র এমন আশ্চর্য সুন্দর পরিক্রমা বাংলা সাহিত্যে বিরল।
কবিতায় আমরা তিন ভিন্ন ডাইমেনশন পাই— বাক, অর্থ ও ছন্দ। কিন্তু গানের জগৎ চতুরাঙ্গ— বাক, অর্থ, ছন্দ এবং সুর। রবীন্দ্রনাথ একমাত্র কবি, যিনি কবিতার মুক্তি ঘটিয়েছেন এই চতুরাঙ্গের সুরের আঙ্গিকে, বৈষ্ণব পদাবলির স্নিগ্ধমধুর পদগুলোর প্রতি তাঁর আকর্ষণ আশৈশব— সেকথা পাঠকমাত্রই অবগত। তাই তাঁর মননে রাধাকৃষ্ণের লীলাচঞ্চল symbol যেমন তাঁকে আজীবন তাড়িত করেছে, তেমনই উপনিষদের ধ্বনির প্রশান্ত-গভীর উচ্চারণ তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’-র দ্বারে, রবীন্দ্রমননে শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বসত্ত্বার symbol আর শ্রীরাধা স্বয়ং কবিসত্ত্বা। বাঁশি সত্ত্বার আহ্বানের symbol— তাঁর দেখা-অদেখা জীবনদেবতার অমোঘ আহ্বান। বীণা তাঁর অন্তর্যামীর সাড়া, বাঁশির ডাক তাঁকে ঘরছাড়া করে, অভিসারে টেনে নিয়ে যায়, কিন্তু বাঁশি তো এক সুরে বাজে না, কবিসত্ত্বা তাই বিভ্রান্ত—
‘দিনের বেলা বাঁশি তোমার বাজিয়েছিলে অনেক সুরে/ গানের পরশ প্রাণে এলো, আপনি তুমি রইলে দূরে’।

বিশ্বসত্ত্বার বাঁশির সুর যখন কবিসত্ত্বার বীণা স্পর্শ করে, তখনই তা প্রকাশ পায় গানের সুরের আনন্দে, সে আনন্দে দেহমন পূর্ণ হয়ে ওঠে, অন্তরের গভীর বাণী ভাষার দু’ডানায় ভর করে প্রকাশের ভূমিতে নেমে আসে। চিত্রাঙ্গদার জবানিতে আমরা পেলাম—
‘আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি/ আনন্দে বিষাদে মন উদাসী’।

এ বাঁশির ডাক কর্ণকুহর থেকে যখন বুকে পৌঁছায়, তখন প্রাণের বীণা বেজে ওঠে। কিন্তু অন্তঃপুরিকা কবিসত্ত্বা তখন অনুভব করতে পারে না বিশ্বসত্ত্বার সান্নিধ্য-ব্যাকুলতা, ব্যাকুলতা বেড়ে চলে ক্রমাগত—
‘বিশ্ব যখন নিদ্রা মগন গগন অন্ধকার/ কে দেয় আমার বীণার তারে এমন ঝংকার’।

সেই অপ্রতিরোধ্য বাঁশির আহ্বানে কবিসত্ত্বা বেরিয়ে পড়ে মিলনের প্রত্যাশায়, যখন বাঁশির ডাক শ্রবণে আসে না অথচ হৃদয়বীণায় ঝংকার উঠতে থাকে, তখন কবিসত্ত্বা প্রতীক্ষা করতে থাকে বিশ্বসত্ত্বার অভিসারের—
‘আমার জ্বলেনি আলো অন্ধকারে/ দাও না সাড়া কি তাই বারে বারে’।

সৃষ্টির সব ঐশ্বর্য ও বিশ্বের সমস্ত বৈচিত্র নিয়ে এ বাঁশির অমোঘ আহ্বান যেন তাঁর প্রতীক্ষারত—
‘ভুবন বলে তোমার তরে আছে বরণ ডালা/ গগন বলে তোমার তরে লক্ষ প্রদীপ জ্বালা’।

প্রেম যে তাঁর অপেক্ষায়—
‘প্রেম বলে যে যুগে যুগে তোমার লাগি আছি জেগে/ মরণ বলে ‘আমি তোমার জীবন তরী বাই’।

ভাবে ভাষায় সুরে অনবদ্য চতুরাঙ্গের একটি গানের মধ্য দিয়ে তাঁর মননের প্রেমকে ছোঁয়ার একটুখানি প্রয়াস পাই—
‘ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি।/ মিলনের উৎসবে তায় ফিরায়ে দিও আনি।।/ বিষাদের অশ্রুজলে নীরবের মর্ম তলে গোপনে উঠুক ফলে হৃদয়ের নূতন বাণী।।/ যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা— নয়নে আঁধার রবে/ ধেয়ানে আলোকরেখা।/ সারা দিন সঙ্গোপনে সুধারস ঢালবে মনে/ পরানের পদ্মবনে বিরহের বীণাপাণি।’

লক্ষণীয়, গানটিতে একার পরে একটি ড্যাশ রয়েছে, এর মানে তুমি কে? তুমি ‘নয়নে আঁধার রবে’ বাক্যের কর্তা অর্থাৎ তোমাকে চোখে দেখি না, ধেয়ানে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি, তুমি বিরহের বীণাপাণি— কবি হৃদয়ের অভীষ্ট, কবিসত্ত্বার প্রণয়নী বিশ্বসত্ত্বা যিনি কবিমানসে সারাদিন সঙ্গোপনে সুধারস ঢেলে যাচ্ছেন। আসলে, গানে জীবনদেবতা/ মানসসুন্দরী এবং অন্তর্যামী যথাক্রমে বিশ্বসত্ত্বা ও কবিসত্ত্বাতে transform হয়ে যাচ্ছে, কবিসত্ত্বার প্রণয়নী বিশ্বসত্ত্বা যিনি সারাদিন সঙ্গোপনে সুধারস ঢেলে যাচ্ছেন, তিনিই পরানের পদ্মবনে বিরহের বীণাপাণি।
আরেকটি গানের কথায় আসা যাক—
‘অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দবন্ধনে
ও যে সুদূর রাতের পাখি
গাহে সুদূর রাতের গান’।

এ গানে ‘অধরা মাধুরী’ কী, তা বিশ্লেষণ করতে হবে বিশ্বের বহমান অজস্র মাধুরীধারার স্রোতের সাথে মিশে গেলেই কবিসত্ত্বার মুক্তি। এ মাধুরী হল কবিহৃদয়ের প্রথম প্রেম থেকে শুরু করে জীবনের সব স্নেহ, সব ভালবাসা মিলেমিশে একাকার বহমান এক স্রোতধারা। কালিদাস বলেছেন, বিরহে ভালবাসা নষ্ট হয় না, বেগহীনতায় তা জমে জমে জমাট হয়ে যায়—
‘স্নেহান্ আহুঃ কিমপি বিরহে ধ্বংসিনস্ তে ত্বভোগাদ্ ইষ্টে বস্তুন্যুপচিতরসাঃ প্রেমরাশী ভবন্তি।’

রবীন্দ্রনাথ এই গানে এবং আরও অনেক গানে ‘হৃদয় মাধুরী’-কে আকাশের উধাও পাখির প্রতীক দিয়েছেন। এ গান ‘সুদূর রাতের গান’ অর্থাৎ বহুকাল পিছে ফেলে আসা প্রথম প্রণয়ের স্মৃতিগুলি, যে পাখি সুদূর ভোরের কবিসত্ত্বা যখন দুঃখ-রাত অতিক্রম করে মহাজীবনের জাগরণ লাভ করবেন, যে-পাখিকে কবি হৃদয়ে ধরে রাখতে পারেননি, সে-পাখি ধরা পড়েছে খাঁচায় নয়, তাঁর কবিতায় আর গানে। এই গানটির দুর্বোধ্যতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও দৃষ্টি এড়ায়নি। পরে ৩ জানুয়ারি ১৯৪০-এ গানটিকে ভেঙে তিনি ‘অধরা’ নাম দিয়ে ‘সানাই’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত করেন, যদিও গান আর কবিতার মূল মর্মবাণী ছিল একই। তবে কবিতাটি ছিল ছবি— চোখের, কানের ও মনের উপভোগ, তিন ডাইমেনশনের রসাস্বাদন। গানে আছে নিগুঢ় ও অন্তর্বেদনা, যা সুরের পক্ষবিস্তারে হারিয়ে গেছে চতুর্থ ডাইমেনসনে।
রবীন্দ্রমননে প্রেমের পরিক্রমা কিছু কাব্য, কিছু গান, কিছু আলেখ্য দিয়ে সম্পূর্ণ হবার নয়। হয়তো যুগের পরে যুগ অতিক্রান্ত হয়ে যাবে সে অনুধ্যানে। এ পরিক্রমাবৃত্তের শুরু যদি ‘কড়ি ও কোমল’ দিয়ে হয়ে থাকে তবে শেষ কেন ‘শেষের কবিতা’ দিয়ে নয়? ‘শেষের কবিতা’ তো সেই অর্থে উপন্যাস বা কাব্য নয়। আমার সামান্য বোধি বলে, এ রচনা উপন্যাস থেকে কাব্য পর্যায়ে রসোত্তীর্ণ। উপন্যাসের লক্ষণ অনুযায়ী নায়ক-নায়িকা রয়েছে, একটা ঘটনাপ্রবাহ রয়েছে কিন্তু বারবার পাঠ করলে বোধ হবে— এ তো উপন্যাস নয়, এ এক বিশুদ্ধ কবিতাবলি যেখানে কবি উপন্যাস রচনার ছলে একের পর এক কবিতা নির্মাণ করেছেন অদ্ভুত এক লীলা-চপলতায়।

শিলং পাহাড়ে আকস্মিক দেখা হওয়া দুই যুবক-যুবতীর মধ্যে দ্রুত গড়ে ওঠা প্রেম, ভাবরসের বর্ণিল তুলিতে আঁকা টুকরো টুকরো স্বপ্ন ও কাব্যকথা। অবশেষে অমিতের সাধের নির্মিত paradise lost। লাবণ্যকে বিদায় জানিয়ে ফিরতে হয় অমিতকে। এ কি মানসীপ্রতিমার আবাহন চিরকালের, না বিসর্জন?
রবীন্দ্রনাথ অংশত হলেও প্রেমের প্লেটনিক তত্ত্বের একটা esthetic value অনুসন্ধানে নিমগ্ন এই ‘শেষের কবিতা’-য়, Keats তাঁর ‘Ode on an Gracian Urn’ কাব্যগ্রন্থের উপক্রমণিকায় উল্লেখ করেছেন— ‘love is something immortal and something that stands apart and something that seems concrete.’

প্রেমের এই অবিনশ্বরতায় রবীন্দ্রনাথও বিশ্বাসী, হয়তো চিরতরে দূরেও সরিয়ে রাখে, তবু তা অবিনশ্বর। প্রবন্ধের সূচনাতে আমি উল্লেখ করেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ কি কিটসের রচনা দ্বারা খানিকটা হলেও প্রভাবিত ছিলেন? আসলে, ‘মানসী’ কাব্য থেকেই তাঁর এই ভাবনার সূত্রপাত। অমিত লাবণ্যের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সংসারপ্রান্তে ফেলে আসা খণ্ডিতা প্রিয়া কেতকীর কাছে ফিরে যায় আর লাবণ্য ফিরে যায় তার একদা উপেক্ষিত প্রেমিক শোভনলালের কাছে। প্রেম কিন্তু রয়ে গেল স্বমহিম হয়ে, চিরকালের হয়ে।
‘কোনদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে
বসন্ত বাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস, ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ
সেই ক্ষনে খুঁজে দেখো কিছু মোর পিছে রহিলো সে
তোমার প্রাণের প্রান্তে; বিস্মৃত প্রদোষে

সব-চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়,
সে আমার প্রেম।
তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ তোমার উদ্দেশে…’।

পরিবর্তনের স্রোতে লাবণ্য ভেসে গেছে, তার প্রেম ভেসে আছে শান্ত দিঘির জলে স্থির ধ্রুবতারা হয়ে আর সেই জলে অমিতের নিত্য অবগাহন। ব্যত্যয় ঘটেনি সেই ‘মানসী’ থেকে ‘শেষের কবিতা’-র দীর্ঘ পরিক্রমায় রবীন্দ্রমননে প্রেমের অভিঘাতের সংরাগের— শুধু বারবার পরিবর্তন ঘটে গেছে, বাঁকবদল করেছে প্রেমের সন্ধানের অনির্দ্দেশ্য দিক।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটক ও বাংলাদেশ

ঋত্বিক ঘটকের জীবনের প্রথম বাইশ বছর (১৯২৫-১৯৪৭) কেটেছে মূলত পূর্ব-বাংলায়, যা এখনকার বাংলাদেশ। তাঁর জন্ম ঢাকার ২,ঋষিকেশ দাস রোডের ঝুলন বাড়িতে। ১৯৪৭, অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি মূলত পূর্ব-বাংলায় কাটান। আমরা দেখব, পূর্ব-বাংলা যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে-দেশ, সে-ভূমির প্রভাব তদনুরূপ ঋত্বিকেরও পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে।

Read More »
মণিকর্ণিকা রায়

অনুগল্প: অর্জন

অসহায় বৃদ্ধের খাওয়া হয়ে গেলে মাঝেমাঝে গল্পও করত ওঁর সাথে। আদিত্য লক্ষ্য করেছিল এই ব্যাপারটা যেন তার মনে একটা বদল আনছে— যেন রোজ তার শরীর-মন জুড়ে সঞ্চালিত হচ্ছে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি। যেন সে সত্যিই মানুষ হয়ে উঠছে।

Read More »
মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গা মাঈ কী! জয়!

ঢাকা বা সমগ্র বাংলাদেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজোর চাঁদা আদায়ের চল খুব একটা নেই। মণ্ডপে এসেই পাড়ার লোক চাঁদা দেন। জবরদস্তি করে চাঁদা আদায়ের যে বীভৎসতা কলকাতা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে আছে, তা অন্তত ঢাকা আর বরিশালে দেখিনি। পুজোর দিনেও অনেকে এসে প্যান্ডেলের পাশে চাঁদা আদায়কারীদের টেবিলের সামনে এসে চাঁদা দিয়ে যান। পাড়ার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। স্বেচ্ছায় এসে চাঁদা দিয়ে যান। এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

Read More »