Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

সুজিত বসুর কবিতাগুচ্ছ

ঝংকারে অনুস্বার

জংঘায় ঝংকার তুলে ছন্দে বেজে যেতে অনুস্বার;
কিছুটা অম্লতা, তবু অপার মাধুর্য ছিল সোনার সংসারে
রক্তমাংসে গড়া দেহে অহংকারে রাজহংসী গ্রীবা
উদ্ধত হলেও ছিল প্রয়োজনে নতমুখী সালংকারা নারী
কিছুটা সংকোচবশে; এছাড়া নম্রতা ছিল খুবই স্বাভাবিক
দেখি না সেসব দৃশ্য, এখন কংসের দল হিংসায় অস্থির
কেন এই দৃশ্যাবলি অনুস্বার, ধমনীতে যুদ্ধের টংকার
সাপের দংশন বিষে নীল দেহ, রব ওঠে সংহার সংহার;
আমাদের যদুবংশ ধ্বংস করা, এই তবে ছিল অভিপ্রায়
কোথায় সংস্কার গেল, কোথায় যে সংস্কৃতের শান্ত মন্ত্রপাঠ
জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং
কোথায় দর্শন গেল, কোথায় হারাল সাংখ্য, ভয়ের সংকেত
বেড়াজালে ঘিরে রাখে, যন্ত্রগণকেরা পাতে মায়াবী সংখ্যার
শতেক রঙিন জাল, মরচে পড়ে জংধরা লোহার লাইনে
চলে না জীবন ট্রেন, রুদ্ধগতি থেমে আছে ভয়াল জংশনে
বেশ তো ছিলাম আমরা, সারাক্ষণ রাস্তাঘাটে ইংরেজির বুলি
তুমিই তো এনে দিলে অনুস্বার, ভয়ংকর বিদেশি বাতাসে
পারি না নিশ্বাস নিতে, দুয়োরানি জননীকে ফেরাও এবার
আবার প্রতিষ্ঠা করো বাংলা মাকে রাজেন্দ্রাণী রূপে।

*

চন্দ্রবিন্দুকে মিনতি

তুমি না থাকলে চাঁদ চলে যেত আফ্রিকার ঘন নিরুদ্দেশে
বন্যাকে রোখার জন্য অসম্ভব হত গড়া প্রতিরোধী বাঁধ
সাহায্যের কাঁধ কেউ বাড়াত না বিপদের দিনে দৌড়ে এসে
বন্য জন্তু থেকে যেত অধরাই, সম্ভব হত না পাতা ফাঁদ

বাঁচা হত অর্থহীন, আনন্দে বা দুঃখে কেঁদে ওঠা
পুজোর আনন্দ কিছু ম্লান হত, সংগ্রহ হত না মোটা চাঁদা
মনের লকারে জমা অজস্র সুখের হীরে, হোক তা যতই ধরাবাঁধা
কচিকাঁচাদের হাসি ব্যর্থতাকে চাপা দেয়, সাফল্যের জন্য ফের ছোটা

তুমি আছ তাই আছে বৈচিত্র্য, জীবন নদী নিতে পারে তাই বহু বাঁক
কাঁড়া বা আকাঁড়া হোক চাল, তবু ভিক্ষাবৃত্তি অবিরত করে যাওয়া রোজ
দাসত্বে জীবন কাটে, মাসান্তের মোটা টাকা সুখের দেওয়ালে রাখে ফাঁক
হারানো রুপোলি সেতু মনকে অশান্ত করে, চতুর্দিকে করি তার খোঁজ

ছেঁড়া ছেঁড়া সুখ দুঃখ দিয়ে হয় জীবনের নকশিকাঁথা বোনা
অদৃশ্য শত্রু বা বন্ধু ঘৃণা হিংসা স্নেহ প্রেম মায়ার অলীক তাস বাঁটে
রঙের টেক্কাটা শুধু পাইনি কখনো, ব্যথা সেঁটে বসে আমার কপাটে
কাঁসর ঘণ্টার শব্দ এখনও ভোলায় তবু অনেক যন্ত্রণা

মনোরম দৃশ্যাবলি, সাঁতারে যুবতী মুখ, হাঁসেরা মন্থর ভাসে জলে
পবিত্র শাঁখের শব্দ শুনি আজ কদাচিৎ, নিভৃতে তবুও মনে বাজে
ঝকঝকে দাঁতের সারি প্রেমিকা উজ্জ্বল হেসে নির্জনে প্রেমের কথা বলে
অদৃশ্য দড়ির ফাঁস রোজ অনুভব করি, ভয় পাই বোমার আওয়াজে

রোজ ভাবি উপড়ে ফেলব পথের কাঁকর যত, উপড়ে ফেলব কাঁটা
পারি না কিছুই, শুধু কিছুটা আনন্দ দেয় উড়ে যাওয়া একঝাঁক পাখি
অনেক ঘেঁটেও জল পাইনি অমৃতকুম্ভ, কপাল চিরটাকাল ফাটা
উদ্যত মৃত্যুর খাঁড়া অগ্রাহ্য করেই রোজ দৌড়োই একাকী

অনেক খেলা তো হল চন্দ্রবিন্দু, শুধু একটি করুণ মিনতি
কোনো প্যাঁচ না কষেই এটুকু তো দিতে পারো, হবে না তোমার কোনো ক্ষতি
যেখানেই ঠাঁই নাও, কারোর নামের আগে বসো না কখনো যেন ভুলে
বাগানে বাড়াক শোভা, ঢাকে না কারোর দেহ যেন ফুলে ফুলে।

*

পরিতৃপ্তি

বাড়ির পাশের পুকুরে মাছটা কুবকুব শব্দে ঘাই মারত
জল থেকে লাফিয়ে উঠলে রুপোলি শরীরে পিছলে যেত আলো
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা বেশ উপভোগ করতাম
আমার বাড়িটা শহরের একপ্রান্তে বেশ নিরিবিলিতে
হঠাৎ কিছুদিনের জন্য বউ অফিস টুরে বাইরে গেছল
একটু সাহসী হয়ে এবারে বান্ধবীকে বাড়িতে ডাকলাম
খুচরো কিছু কথাবার্তা, অল্প মদ্যপান হল যেমনটা হয় আর কী
টপের বোতামে সবে হাত দিয়েছি, হঠাৎ সেই কুবকুব শব্দ
বুকে হঠাৎ কীরকম ব্যথা অনুভব করলাম
সঙ্গে সঙ্গে হাত অবশ, আর মুড হল না
মন বলল বিশ্রাম চাই
বান্ধবীর কাছে ক্ষমা চেয়ে উবের ডেকে ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম
এরপর থেকে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

আর একদিনের ঘটনা বলছি
সংসারে বাড়তি কিছু সুখের জন্য মাঝেমাঝে ঘুষ নিতে হয়
অফিসেই নেওয়া চলছিল কিন্তু ইদানীং বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে
তাই যিনি দেন তাকে এবারে বাড়িতে ডাকলাম
নোটের বান্ডিলটা হাতের মুঠোয় শুধু ধরেছি
আবার সেই কুবকুব শব্দে মাছটা ঘাই মারল
বুকটা যেন ফেটে গেল যন্ত্রণায়, টাকা খসে পড়ল মেঝেতে
ভদ্রলোককে একটু অপমানজনকভাবেই বিদায় দিলাম।

কিছুদিন পরের ঘটনা বলছি
আয়কর রিটার্ন ফাইল করছি ল্যাপটপে
এটা তো সহজবোধ্য যে মাইনের বাইরের উপরি আয় দেখানো যায় না
শুধুমাত্র মোট বেতনের সংখ্যাটি আয়ের ঘরে লিখেছি, আবার সেই কুবকুব শব্দ
আয়ের ঘরে বসানো অঙ্কটা দেখে চমকে উঠলাম
মাইনের সঙ্গে অবৈধ আয় জড়ো করে বেশ বড় একটা সংখ্যা
সংশোধনের জন্য ডিলিট বাটনের দিকে আঙুলটা কিছুতেই গেল না
রিটার্ন ফাইলের সেদিনই শেষদিন, তাই বাধ্য হয়ে সাবমিট করতে হল।

পরে ঠিক করে ফেললাম এভাবে চলতে দেওয়া যায় না
জেলেকে দিয়ে জাল ফেলিয়ে মাছটাকে তুললাম
বউ মাছটাকে কেটেকুটে মশলা দিয়ে ঝোল রাঁধল
বেশ তৃপ্তি করে খেলাম দুজনে
এখন আমার জীবন আবার আগের মত সহজ
বউ টুরে গেলে বান্ধবীকে মাঝেমাঝে বাড়িতে ডাকি
এটি অবশ্য অন্য বান্ধবী যাকে সম্প্রতি জুটিয়েছি
আদরটাদর এখন সহজেই করা যায়, কুবকুব শব্দ তো আর নেই
বাড়িতে এখন অনায়াসে ঘুষ নিতে পারি
আয়করের রিটার্নে খুশিমত কারচুপি করি, আঙুল আর অবাধ্য হয় না
জীবনে আবার সুখ ফিরে এসেছে।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
2 years ago

বাঃ দারুন। এইজন্যই সুজিত বসুর কবিতা আমি পছন্দ করি। ছন্দের মুন্সয়ানায় তাঁর অতুল দক্ষতা, আবার নিমেষে ছন্দবদ্ধ চলন ছেড়ে তাঁর কবিতা নতুন আঙ্গিকে চলতে পারে। ভাষা আর চলনের বৈচিত্র্য সুজিতের কবিতাকে অনন্য করে তোলে। ভালভাষাকে ধন্যবাদ, তাঁরা নিয়মিত সুজিত বসুর কবিতাগুচ্ছ আমাদের উপহার দিচ্ছেন। ্

Kishore Dutta
Kishore Dutta
2 years ago

আমার প্রিয় কবি সুজিত বসুর ছন্দেভরা অর্থে পরিপূর্ণ কবিতাগুলো পড়ে খুবই ভালো লাগলো। উনার ভাষার দক্ষতা অতুলনীয়। আবারও কবির সুন্দর সুন্দর কবিতা পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ভালোভাষাকে অশেষ ধন্যবাদ।

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »