Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

নদী নিয়ে যা বলা হয়নি এমনভাবে

বাংলার নদীগুলির ইতিহাস আসলে বাংলারই ইতিহাস বলেছিলেন স্বনামধন্য ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়৷ ব্রিটিশ আমলে রেনেল সাহেব প্রথম সিস্টেমেটিক সার্ভে করলেন নদী নিয়ে৷ আমরা ইতিহাস মনে রাখলে দেখতে পাই, নদী ছিল প্রধানত বাণিজ্যের প্রধান যোগাযোগপথ, কাজেই সেকারণে ওলন্দাজ সাহেবরা নদীচর্চা করতেন, যা পল্লবায়িত হয়েছিল বাঙালিদের মধ্যে৷ নদী নিয়ে ‘কিছু কথা’ পর্বে দারুণ লিখেছেন লেখক৷ তাতেই মূল বিষয় বা এই বই লেখার উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন৷

নদী সভ্যতার নির্মাতা৷ বা নদীর হাত ধরে সভ্যতা গড়ে ওঠে৷ সেই নদীকে আমরা মনে রেখেছি কি? নগরায়ণ, বাঁধ নির্মাণ, বহু নদীর অবলুপ্তি ঘটিয়েছে৷

কী এবং কেনর প্রশ্ন খুঁজেছেন সুপ্রতিম৷ দেশ জুড়ে নদী বিক্রি থেকে মরা নদীকে বাঁচিয়ে তোলার ঘটনা রয়েছে এই বইতে৷ উত্তরবঙ্গের সংকোশ থেকে দক্ষিণবঙ্গের বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত সমস্ত নদীরাই আজ জলসমস্যায় জর্জরিত৷

প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছে প্রধানত উত্তরবঙ্গের নদী নিয়ে৷ জলরাজনীতির তিস্তা-আত্রেয়ী, কুলিক নদী, নদীও যখন পণ্য বা মালদহের নদনদী, কীর্তিনাশার চর, চরাচর এবং না-মানুষেরা প্রভৃতি প্রবন্ধ পাঠকদের ভাবায়৷ জ্বলন্ত প্রশ্নর সামনে দাঁড় করায়৷ দ্বিতীয় অধ্যায় নদিয়া জেলার নদীকে নিয়ে৷ বিপন্ন চূর্ণী নদী যার কথা আমরা জয় গোঁসাইয়ের কবিতায় পেয়েছি “চূর্ণী নদী পার করে দিই সবার জন্য অন্ন মাপো৷” (জন্মদিনের কবিতা) সেই চূর্ণী আজ মৃতপ্রায়৷ নদীয়ার বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অঞ্জনা৷ ইছামতীও আজ বিপন্ন৷ বাঁধের পর বাঁধ এই শৃঙ্খলে নদী আজ অসুস্থ৷ তাই সুপ্রতিম বলছেন, “বন্যাপ্রবণ এলাকার নির্ভুল মানচিত্র তৈরি, ঘন জনবসতিও কৃষির পুনর্বিন্যাস, বন্যার আগাম সতর্কবার্তা পৌছে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো, ফ্লাড সেন্টার তৈরি করা ও বন্যাবিমা চালু করা৷” গুরুত্ব দিয়েছেন নদীচরিত্রকে বুঝে সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্টের দিকে জোর দিতে৷

একাধিক উদাহরণ বা কেসস্টাডি দিয়েছেন সুপ্রতিম৷

নদী বিক্রি হয়? সুনীলের কবিতায় কবি ইচ্ছেপ্রকাশ করেছিলেন পাহাড় কিনতে, বিনিময়ে নদী তিনি দেবেন৷

বাস্তবেও তা সত্যি হয়৷ জলরাজনীতির শিকার হয়ে মহারাষ্ট্রের রোপালা গ্রাম খরার কবলে পড়ে৷ উজানি বাঁধের সে ভয়ংকর সত্য কাহিনি শুনিয়েছেন সুপ্রতিম (পৃ. ১০১)

তৃতীয় অধ্যায়ে আছে জলব্যাংক সহ সুন্দরবনের তেল দূষণ ও সুন্দরবনের সমস্যা৷ চতুর্থ অধ্যায় তিতাসের বৃত্ত ও অন্ত এবং পদ্মার জলরেখার জীবন৷ “পদ্মাতীরের ধীবরপল্লিতে তো চিরদারিদ্রের চিরবসতি৷ তা স্থানীয় মধ্যশ্রেণির বাবু লোকদের প্রমোদপল্লি৷” আবার কখনও বলছেন, “তাহলে পদ্মানদীর মাঝি আর নদীর মাঝি থাকে না? তা তো নয়— কারণ এই প্রাপ্তির প্রত্যাশা আর অভ্রান্তির ক্ষোভ, সবই তো নদীকেন্দ্রিক৷ সেখানে ‘নদী ছাড়া সবই বাহুল্য’— হয়তো কুবের সেভাবে দেখে— মানবী প্রিয়ার যৌবন চলে যায়— কিন্তু পদ্মা চিরযৌবনা৷ সেই পদ্মার জলেই তো কুবের কপিলার ভাসমানতার ক্রমিকে, তার কুচযুগ শোভা দেখেছিল৷”

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন বোধহয়৷

পঞ্চম অধ্যায় অনেক জেনারালাইজড কিন্তু ভীষণ বাস্তব ও যুগের নিরিখে প্রয়োজনীয়ও বটে৷ নদী কেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর খোঁজার চেষ্টা৷ নদীপাড়ের ভাষা, বা তাদের কথা যাদের জীবন মরণ জলে, এবং শেষ পর্বটি নদী মারা ও বাঁচানো বিষয়ক৷

পরিশিষ্টতে লেখক তথ্যসূত্র দিয়েছেন যা তার গভীর গবেষণার সাক্ষ্য দেয়৷ বিভিন্ন টেকনিকাল টার্মের অর্থ বর্ণানুক্রমিকভাবে সজ্জিত যা সাধারণ পাঠকদের কাছে ভীষণ উপকারী৷ নির্দেশিকা পাঠককে দিশাদানে সক্ষম৷ পরিশিষ্টে আছে একটি দুর্লভ মানচিত্র৷ (১৭৫২ সালে ডি অ্যানভিলের আঁকা৷

সুপ্রতিমের লেখা ঝরঝরে টানটান সোজাসাপ্টা৷ অহেতুক তত্ত্বের কচকচানি নেই, সাধারণ পাঠকরাও এর স্বাদ নিতে পারবেন৷

পৃষ্ঠা, বাইন্ডিং ছাপা সবদিক দিয়ে সর্বাঙ্গসুন্দর৷ মুদ্রণপ্রমাদ নেই বললেই চলে৷ বড় যত্নে নির্মিত বোঝাই যায়৷

পড়ে ফেলুন৷ নদীকে চিনুন, নদীকে ভালবাসুন৷ সুস্থ সবল নদীর পাশে থাকার আজ যে বড় প্রয়োজন৷ আজ তো বটেই আগামীর জন্যও৷
পাঠ শুভ হোক৷

নদীজীবীর নোটবুক
সুপ্রতিম কর্মকার
প্রকাশক: ধানসিড়ি
প্রচ্ছদ: সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়
হার্ড বাউন্ড, পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৭৫
মূল্য: ২৫০ টাকা

5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »