Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্ত প্রিয় ঋতু ছিল তাঁর। অজস্র কবিতায় তিনি হেমন্তের ছবি এঁকেছেন। প্রকৃতি, ঋতু নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান বৈভবপূর্ণ। কিন্তু হেমন্ত রবীন্দ্রনাথের কাছে ততটা ধরা দেয়নি, যা জীবনানন্দে দিয়েছে। মহাকবি কালিদাসের ‘ঋতুসংহার’ কাব্যেও হেমন্তের বিশদ বর্ণনা আছে। তবে কাব্যটি প্রেমিক-প্রেমিকার পরস্পর আবেগ ও গান্ধর্ব-আশ্রয়ী। সেজন্য ঋতু ও প্রেমের সংযোগ লক্ষ্য করি সেখানে। তবু হেমন্তকালকে কালিদাস চিহ্নিত করেন ‘চিরসন্তাপের ঋতু’ বলে। ক্রৌঞ্চের ডাক, বিরহী প্রিয়ার জন্য দীর্ঘশ্বাস এ-ঋতুর চিহ্ন। আর হ্যাঁ, খেতভরা ধানের কথাও লিখে গেছেন তিনি।
রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডে দেখছি, বনবাসকালে গোদাবরীতে স্নান করার সময় লক্ষ্মণ রামকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, রামের প্রিয়তম ঋতু শরৎ সমাগত। নীহারে জর্জরিত প্রকৃতি, মধ্যাহ্নে সুখসেব্য রোদ্দুর, দক্ষিণায়ণের সূচনাকাল। রাতে তুষার, বাষ্পাচ্ছন্ন অরণ্য।
হেমন্তের বৈভব ও বৈশিষ্ট্য দেশি-বিদেশি বহু কবির রচনায় মেলে। শেকসপিয়রের সনেট থেকে (বিশেষ করে ৭৩-সংখ্যক) গ্যেটের কবিতায়। গ্যেটের একটি বিখ্যাত কবিতা ‘Herbstgefuhi (Autumn Feelings)। কবিতাটিতে বিষাদ ও রিক্ততা হাত ধরাধরি করে আছে। আবার জীবনের নশ্বরতা ও ক্ষণস্থায়ী আনন্দের কথা আছে ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতে, যা বহুসময় হেমন্তের আবহ নিয়ে আসে বলে সমালোচকেরা মনে করেন।
গৌতম বুদ্ধের জীবনী-গণনাকারীরা তাঁর গৃহত্যাগের ভবিষ্যদ্বাণী করলে পিতা শুদ্ধোধন তাঁকে বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত করতে চেয়ে অন্য নানা আয়োজনের মতো ছয় ঋতুর উপযোগী ছ’টি প্রসাদ নির্মাণ করে দেন। সেখানেও হেমন্তের বর্ণনা আছে।
তবু হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে? অথচ বৈষ্ণব কবি থেকে শুরু করে আজকের কবিরা অনেকেই এই প্রায়-অননুভূত ঋতুকে নিয়ে কবিতা লিখতে ছাড়েননি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তো লিখেই ফেললেন ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’ কাব্যগ্রন্থ! না, তিনি কিন্তু পোস্টম্যান নন সেখানে। কেবল এক পোস্টম্যানকে ‘দেখেছেন’ মাত্র!
জীবনানন্দের একই বয়সী কাজী নজরুল। হেমন্তের কবিতা ও গানে মুখর তিনিও। তবু হেমন্ত বন্দনায়, হেমন্তের রূপনির্মাণে মেরুপ্রতিম ব্যবধান দু’জনের মধ্যে। নজরুলেও আমন ধান, শিশিরস্নাত শীতল বাতাস, তারপর ‘ঝিলের জলে কাঁচা রোদের মানিক’, আছে। হেমন্তের খাদ্য নিয়েও কৌতুক তাঁর কবিতায়, ‘শিরনি রাঁধেন বড়ো বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত!’ তার পাশে জীবনানন্দ, ‘সেইখানে উঁচু উঁচু হরীতকী গাছের পিছনে/ হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল, রাঙা/ চুপে চুপে ডুবে যায় জ্যোৎস্নায়/ পিপুলের গাছে বসে পেঁচা শুধু একা/ চেয়ে দেখে/ সোনার বলের মতো সূর্য আর/ রূপার ডিমের মতো চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা’ (গোধূলিসন্ধির নৃত্য)।
জসীম উদ্দীন বা সুধীন্দ্রনাথ নন, হেমন্তের এক ও অদ্বিতীয় অধীশ্বর জীবনানন্দ। ‘কলমীলতায় দোলন লেগেছে, ফুরালো ফুলের আয়ু’ (জসীমউদ্দিন), বা ‘ধূমায়িত রিক্ত মাঠ, গিরিতট হেমন্ত-লোহিত/ তরুণ তরুণী-শূন্য বনবীথি চ্যুতপত্রে ঢাকা’ (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)-র সঙ্গে তুলনা করা যাক ‘মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায়/ কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে’, অথবা ‘আমি এই অঘ্রানেরে ভালোবাসি/ বিকেলের এই রং, রোদের শূন্যতা,/ রোদের নরম রোম, ঢালু মাটি,/ বিবর্ণ বাদামী পাখি/ হলুদ বিচালি/ পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে/ কুড়ানীর মুখে তাই নাই কোনো কথা’! আমরাও কথাহারা এসব দৈবী উচ্চারণে!
কেবল বিভূতিভূষণ। একমাত্র তাঁর লেখাকেই, হেমন্তভাবনাকেই জীবনানন্দের পাশে দাঁড় করানো যায়। ‘ছেলেবেলার সেই প্রথম হেমন্তকালে, আমাদের গ্রামের উত্তর-দক্ষিণ মাঠে যখন আস্তে আস্তে সোনালী রং ধরছে আর অচিন তলার পাকা রাস্তায় ছাতিমফুলের উগ্র গন্ধে বাতাস হয়ে উঠেছে ভারাক্রান্ত, বিকেল ফুরিয়ে আসছে স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতেই, পশ্চিম আকাশে আবির ঢালা মন খারাপ করার পাশে সন্ধ্যাতারার টিপটি পরা আকাশপট!’
হেমন্তের সঙ্গে পরানের রাখী বাঁধা ছিল বলেই কি শরতে আহত হয়ে (১৪-ই অক্টোবর ১৯৫০-এ ট্রাম-অ্যাক্সিডেন্ট হয় তাঁর), হেমন্তে নির্বাণ নেবেন বলেই ২২-এ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন কবি? জীবনানন্দ, এই নামে আর কোনও বাঙালির নাম নেই। সম্ভবত তাঁর মতো হেমন্তপ্রেমিক না থাকাই তার কারণ।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গা মাঈ কী! জয়!

ঢাকা বা সমগ্র বাংলাদেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজোর চাঁদা আদায়ের চল খুব একটা নেই। মণ্ডপে এসেই পাড়ার লোক চাঁদা দেন। জবরদস্তি করে চাঁদা আদায়ের যে বীভৎসতা কলকাতা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে আছে, তা অন্তত ঢাকা আর বরিশালে দেখিনি। পুজোর দিনেও অনেকে এসে প্যান্ডেলের পাশে চাঁদা আদায়কারীদের টেবিলের সামনে এসে চাঁদা দিয়ে যান। পাড়ার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। স্বেচ্ছায় এসে চাঁদা দিয়ে যান। এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও প্রসঙ্গত

সমসময় তাঁকে চেনেনি। বরং সর্বপ্রযত্নে বানচাল করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে তাঁর প্রগতিশীল কাজকর্মকে। এই সময় ও বাঙালি সমাজ-ও কি চিনেছে তাঁকে? তাঁকে তাই শেষ জীবন কাটাতে হল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী থেকে দূরে সাঁওতাল পরগনায়। শেষ বয়সে উপলব্ধি করেছিলেন তিনি, যাদের জন্য তাঁর এই কাজ, সব অপাত্রে দান!

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: দেড়শো বছরের সূচনায়

তাঁকে অনুবাদ করা হয় ভারতীয় নানা ভাষায় নানা সময়ে। তবুও কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ মূল্যায়িত হননি আজ-ও। বেশ কিছু অনুবাদ ছিল তাঁর, প্রথমজীবনে কলকাতা বাসকালে, হিন্দি থেকে ইংরেজিতে, যা হারিয়ে গেছে চিরতরে। বারো বছর রেঙ্গুন-পেরু পর্বে আগুন লেগে পুড়েছে তাঁর আঁকা ছবি, ‘চরিত্রহীন’-এর পাণ্ডুলিপি, পরে আবার যা লেখেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শতবর্ষে মহানায়ক উত্তমকুমার

‘মহা’ শব্দটি মহান আর বিশাল, এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘মহাকাব্য’ বা ‘মহারাজ’। কাব্য আর রাজার চেয়ে তার মাত্রা ভিন্ন, মহিমা অনেক বেশি তাৎপর্যময়। উত্তম বাংলা চলচ্চিত্রের সেই তাৎপর্যময়তার একমাত্র উদাহরণ। যাঁকে শ্রদ্ধাভরে আমরা ‘কিংবদন্তি’-ও বলে থাকি। তাই সত্যজিৎ রায়ের মতো আরেক কিংবদন্তি তাঁকে নিয়ে চিত্রনাট্য লেখেন, ছবি বানান, আর সে ছবির ‘নায়ক’ হন উত্তমকুমার।

Read More »