Site icon BhaloBhasa

মণি কাউল: যাঁর প্রতিটি ছবি বিস্ময়করভাবে আন্তর্জাতিক

ইন্দ্রপতনের সময়েই আমরা জন্মগ্রহণ করেছি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই চারপাশে বড় বড় গাছের উপড়ে যাওয়ার শব্দ শুধু শুনতে পাই। তেমনই আর একটি ঘটনা ঘটেছিল ২০১১-র ৬ জুলাই। সংবাদটা পরদিন খবরের কাগজে ছোট্ট করে বেরিয়েছিল, অধিকাংশ খবরের চ্যানেল তখন এটাকে ‘বিগ নিউজ’ বলে মনে করেনি! তাতে কী, আমরা শুনতে পেয়েছি মড়মড় শব্দে উল্টে পড়ল পেশিবান বিশাল সেগুন। সিনেমা ব্যবসার এই যুগে, যখন দৃ্শ্য-শ্রাব্য এই মাধ্যম ঢুকে পড়েছে পরিত্রাণহীন গোলকধাঁধায়, তখন মণি কাউলের মত পরিচালকদের প্রয়োজন আসলে আগের চেয়ে অনেক বেশি।

‘উসকি রোটি’ (১৯৬৯)।

১৯৪৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর মণি কাউল জন্মগ্রহণ করেন এক কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারে। তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন পরিচালক মহেশ কাউল। দুটি উত্তরাধিকার থেকে তাঁর রক্ত বহন করে এনেছিল সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র। যাকে ঘষে-মেজে দিয়েছিলেন শ্রীঋত্বিককুমার ঘটক। মণি কাউল ‘পুনে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (FTTI)-এর সেই ব্যাচের, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে পেয়েছিলেন শিক্ষক ঋত্বিককে। তাঁর কয়েকজন সতীর্থ হলেন— কুমার সাহানি, কমল স্বরূপ (‘ওম-দার-বি-দার’ নামক আশ্চর্য চলচ্চিত্রের স্রষ্টা), জন আব্রাহাম প্রমুখ। এঁদের কাজের দিকে একবার তাকালেই বোঝা যাবে, ‘ইন্ডিয়ান নিউ ওয়েভ’ বলে যে চলচ্চিত্র ধারাটিকে পণ্ডিতরা চিহ্নিত করেছেন, কেন তার কাণ্ডারি হিসাবে ইতিহাসের পাতায় এঁদের সাক্ষ্য থাকবে।

‘আষাঢ় কা এক দিন’ (১৯৭১)।

মণি কাউলের প্রথম ছবি ‘উসকি রোটি’ বেরয় ১৯৬৯ সালে (যে বছর মৃণাল সেন পরিচালিত ‘ভুবন সোম’ মুক্তি পায়)। এ ছবিতে মণি সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করলেন ভারতীয় সিনেমার প্রচলিত যাবতীয় রীতিকে। তা সে গল্প বলার ক্ষেত্রে হোক, অথবা ছবির ক্ষেত্রে। এ অস্বীকার এতই তীব্র এবং মিডিয়ার পক্ষে এতই ভয়াবহ ছিল এই ‘নতুন রীতি’ যে তাঁকে পেতে হল অজস্র বিরূপ সমালোচনা। কিন্তু হায়! বৃথাই সে সব। ঋত্বিককুমার ঘটকের পানপাত্রে একবার চুমুক দিয়ে ফেলার পর কোনও মানুষকে তার নিজস্ব অবস্থানবিন্দু থেকে নড়ানো যে সম্ভব নয়, তা তখন তারা বোঝেনি। তাই এরপর একে একে ভারতীয় মিডিয়া ‘গোলিয়াথ’-এর দিকে ধেয়ে এল মণি কাউল নামক ‘ডেভিড’-এর বেশ কিছু অব্যর্থ পাথর— ‘আষাঢ় কা এক দিন’ (১৯৭১), ‘দুবিধা’ (১৯৭৩), ‘সতহ সে উঠতা আদমি’ (১৯৮০), ‘নজর’ (১৯৯১), ‘নৌকর কি কামিজ’ (১৯৯৯) ইত্যাদি। কাহিনিচিত্র ছাড়াও ‘চিত্রকথি’ (১৯৭৭), ‘পাপেটিয়ার্স অব রাজস্থান’ (১৯৭৪) বা ‘সিদ্ধেশ্বরী’ (১৯৮৯) প্রভৃতি তথ্যচিত্রে মণি দেখালেন কীভাবে বিষয় ও চিত্রগ্রহণের ঊর্ধ্বে উঠে আদতে তৈরি হয় একটি ‘সিনেম্যাটিক অবজেক্ট’।

‘দুবিধা’ (১৯৭৩)।

দুর্ভাগ্য আমাদের, মণি কাউল কোনওদিনই তথাকথিত ‘বাণিজ্যিক’ বা ‘সমান্তরাল’ কোনও ধারাতেই চিহ্নিত হলেন না। আর তাই চলচ্চিত্র উৎসবগুলো ভুলে যেতে লাগল তাঁর নাম। বিভিন্ন ফিল্ম ক্লাবে আমরা মেতে রইলাম ‘গোদার অ্যাট সেভেন্টিস’ নিয়ে। চর্চা করা হল না ‘মণি কাউল অ্যাট সেভেন্টিস’ নিয়ে। রেট্রোস্পেক্টিভ তাঁর ছবি দেখাল না। ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’ দিতে ভুলে গেল সব্বাই। বলছি না, এসবগুলো হলে তাঁর সাঙ্ঘাতিক উপকার হত। আসলে উপকারটা হত আমাদের। বহু বছর ধরে যাকে আমরা সিনেমা বলে জেনেছি ও বিশ্বাস করেছি, সেই মাধ্যমটা যে শুধু বিনোদন বা বিদেশি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পাওয়ার জন্য সৃষ্টি নয়— তার যে বিশুদ্ধ শিল্প এবং তার মাধ্যমে মানুষকে ছুঁয়ে ফেলার দায় আছে, আমরা তা জানতে পারতাম। দেখতে পেতাম একজন পরিচালককে যিনি ‘সিনেম্যাটিক স্পেস’-কে নিজের ইচ্ছেমত সঙ্কুচিত-প্রসারিত হতে দেবেন বলে ছবি তোলার সময় একবারও চোখ রাখছেন না ‘ভিউ ফাইন্ডার’-এ। একজন এমন শিল্পীকে দেখতাম যিনি অস্বীকার করেন ‘বাজার’-এর সমস্ত শর্ত, যাঁকে কোনও নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বাঁধা যায় না এবং যিনি শেষমেশ ‘গ্লোবাল’ নন, ‘ইন্টারন্যাশনাল’।

‘নজর’ (১৯৯১)।

মণি কাউল পেশাগত জীবনে ছিলেন চলচ্চিত্র শিক্ষক। তাঁর কোনও ক্লাস বর্তমান লেখকের করার সৌভাগ্য হয়নি। শুধু তাঁর পড়ানোর পদ্ধতি নিয়ে একটা মজাদার উক্তি আমার সংগ্রহে আছে। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনার ছাত্রদের আপনি কীভাবে পড়ান?’ উত্তরটা একসঙ্গে মজার এবং গুরুত্বপূর্ণ— ‘খুব সোজা। আমি ওদের ঋত্বিক ঘটকের আটখানা সিনেমার ডিভিডি কিনে নিতে বলি।’ এই কথার মানে সম্ভবত এটা নয় যে মণি কাউল বিশ্বাস করেন যে, ঋত্বিককুমার ঘটকের পর ভারতীয় সিনেমা এগোয়নি। বরং আমার ধারণা, তিনি একথার মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন ‘ফর্ম’ ও ‘কনটেন্ট’ যেকোনও শিল্পমাধ্যমের এই দুই চিরাচরিত ডানাকে ঠিক কীভাবে আন্দোলিত করলে সম্ভব এক স্বপ্নের উড়াল, তার বীজ রোপিত হয়ে আছে ওই আটটি সিনেমায়। তাঁর চলচ্চিত্র দর্শনেও আমরা এটাই পাই। তাঁর প্রতিটি ছবি আশ্চর্যরকম ভারতীয়। তাঁর প্রতিটি ছবি বিস্ময়করভাবে আন্তর্জাতিক। এই আন্তর্জাতিকতা একদেশিকতা নয়।

‘নৌকর কি কামিজ’ (১৯৯৯)।

সমস্ত সংস্কৃতি-সভ্যতার মাথাকে পায়ের নিচে পিষে ফেলে পৃথিবী জুড়ে বাজারের প্রয়োজনীয় ও উপকারী একটি পঙ্গু সংস্কৃতিকে কায়েম করার জন্য যে তাণ্ডব নৃত্য নাচছে তথাকথিত ‘গ্লোবালাইজেশন’; মণি কাউল তার বিপ্রতীপে দাঁড়ানো গুটিকয় নাবিকদের একজন। প্রবল ঝড়ের রাতেও যাঁরা নৌকা বাইছেন। তাঁর সঙ্গে হাল ধরে আছেন কুমার সাহানি, ইলমাজ গুনে, বেলা তার-এর মত মুষ্টিমেয় কয়েকজন। আমরা যারা জলেটলে নামতে পারিনি, সাহস বলতে শূন্য, লোভ ষোলোআনা এবং শিল্পের প্রতি বিশ্বস্ততা শর্তাধীন, তারা আর কিছু না পারি, একবার অন্তত হাততালি দিয়ে সমবেত কণ্ঠে বলে উঠতে পারি না— ‘হো হো হো! জোরসে চল…’?

চিত্র: গুগল