Site icon BhaloBhasa

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

এবছর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের (শ্রাবণ ৩০, ১৩৩৩/১৫.০৮.১৯২৬ – বৈশাখ ২৯, ১৩৫৪/ ১৩.০৫.১৯৪৭) জন্মশতবর্ষ পূর্তি এবং মৃত্যুর আশিবছর পূর্ণ হবে। আমরা তাঁকে মূলত কবি বলে জানলেও সাহিত্যের নানা শাখায় অতি অল্প বয়স থেকেই ছিল তাঁর সাহসী ও সার্থক বিচরণ। মাত্র ছ’বছরের সাহিত্যিক জীবন, তার মধ্যে আবার রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে তাঁকে, পরিচালনা করতে হয়েছে ‘স্বাধীনতা’ নামীয় দৈনিক পত্রিকার ‘কিশোর বাহিনী’-র। তবু এর-ই মধ্যে তিনি কবিতা ছাড়াও ছড়া লিখেছেন, গল্প, নাটক, গান, প্রবন্ধ, এমনকি রবীন্দ্র-পরবর্তীতে যে দিকটিতে বিশেষ কেউই হাত-ই দেননি, সেই নৃত্যনাট্য-ও লেখেন দুটি, ‘অভিযান’ এবং ‘সূর্য-প্রণাম’। তাঁর কৈশোরে তিনি যেমন কবিতা পড়েছেন আকাশবাণী কলকাতার ‘গল্পদাদুর আসর’-এ, তেমনই বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী পঙ্কজকুমার মল্লিক তাঁর লেখা গানে সুর দিয়ে বেতারে পরিবেশন করেছেন। পরবর্তীতে তাঁর গানে সুর দিয়েছিলেন সলিল চৌধুরী, গেয়েছেন দেবব্রত বিশ্বাস ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মত শিল্পীরা। ঋত্বিক ঘটক সুকান্তর কবিতার গীতিরূপ তাঁর পরিচালিত ছবি ‘কোমলগান্ধার’-এ ব্যবহার করেছেন। জীবিতকালেই তাঁর কবিতা রুশ, ইংরেজি সহ নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। একটি বারোয়ারি উপন্যাসেও হাত দিয়েছিলেন ‘চতুর্ভুজ’ নাম দিয়ে, বন্ধু অরুণাচল বসু ও অন্যদের সঙ্গে। অসমাপ্ত উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গেছে চিরতরে। সংখ্যায় কম, তবু বন্ধু ও অন্যান্যদের যেসব চিঠি লিখেছেন তিনি, সেখানেও রয়েছে তাঁর মনীষা আর সাহিত্যবোধের নিদর্শন। করেছেন অভিনয়। অনুবাদেও যে হাত দিয়েছিলেন, তার প্রমাণ সোভিয়েত শিশুসাহিত্যিক ভি. বিয়াঙ্কি-র (Vitaly Bianki) ‘টেইলস’-এর অনুবাদ। সম্পাদনা করেছেন পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে কবিতার। যথার্থ আয়ু পেলে সুকান্ত কোথায় পৌঁছাতে পারতেন!

সুকান্তর যখন বারো বছর বয়স, মা সুনীতিদেবী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হলেন। বউদির স্নেহচ্ছায়ায় মানুষ। যে একমাত্র ছবি আমরা দেখি সুকান্তের, বউদি টাকা দিয়েছিলেন স্টুডিওতে গিয়ে সেটি তুলে আনতে। বন্ধু অরুণাচল বসুর মা কবি সরলা বসু তাঁকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান, মা-বাবার সাত ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। দারিদ্র্যের মাত্রাটা কেমন ছিল, তার স্পষ্ট প্রমাণ অরুণাচল বসুকে লেখা তাঁর একটি চিঠিতে, ‘একখানাও জামা নেই… অর্থের অভাবে কেবলই নিরর্থক মনে হচ্ছে জীবনটা।’ বাবা নিবারণচন্দ্র বইয়ের প্রকাশনা চালাতেন, ‘সারস্বত লাইব্রেরি’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেভাগা, মন্বন্তর, দাঙ্গা আর ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের সময়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। অল্প বয়সেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৪৪-এ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কাজে অহরহ ব্যস্ত হয়ে পড়েন, সেইসঙ্গে চলে লেখালেখি। এগারো বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ লেখেন, গীতিনাট্য। দুর্ভিক্ষ নিয়ে সংকলন বের করেছেন যেমন, আবার ‘একসূত্রে’ নামক কবিতা সংকলনে স্থান পাচ্ছেন তিনি। কবিতা বেরোচ্ছে সেকালের প্রতিনিধিস্থানীয় সব কাগজে,– কবিতা, প্রবাসী, পরিচয়, বসুমতী ও অন্যান্য। তাঁকে নিয়ে তাঁর বন্ধু শিল্পী দেবব্রত মুখোপাধ্যায় পরবর্তীকালে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার চালু করে তাঁর নামে পুরস্কার। বাংলাদেশেও অনুরূপ পুরস্কার দেওয়া হয়।

এটা বিস্ময়কর অথচ সত্য যে, মাত্র একুশ বছর বয়সের মধ্যে বেশ কিছু স্মরণীয় পঙক্তি বাংলাসাহিত্যে সংযোজন করে গিয়েছেন সুকান্ত। তাই বাংলা কবিতার পাঠকমাত্রই এসব কবিতাংশ কণ্ঠস্থ করে রেখেছে,– ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’, বা ‘দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে’, অথবা ‘চলে যাব– তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল’। কী নাজুক তাঁর বাংলাদেশ-প্রীতি, যা ধরা পড়েছে তাঁর অবিনাশী চরণে, ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ!’ কী দরদী ভাষায় তিনি লেখেন, ‘এ আকাশ, এ দিগন্ত, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি,/ সহস্র বছর ধরে একে আমি জানি পরিপাটি,/ জানি এ আমার দেশ অজস্র ঐতিহ্য দিয়ে ঘেরা,/ এখানে আমার রক্তে বেঁচে আছে পূর্বপুরুষেরা’। তাঁর লেখাতে পাই বাঙালির চিরায়ত বিপ্লবী কণ্ঠস্বর, ‘–বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, জেনে নিক দুর্বৃত্ত’। তাঁর লেখা ‘রানার’, ‘বোধন’, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’, ‘একটি মোরগের কাহিনী’, ঠিকানা’, ‘আঠারো বছর বয়স’ (কবিতাটি তিনি ষোলোবছর বয়সে লেখেন) আবহমান কাল ধরে বাঙালির মুখে মুখে ফেরে। অতুলনীয় ছিল তাঁর ছড়ার হাত, ‘বড়োলোকের ঢাক তৈরি গরীব লোকের চামড়ায়’, আর ‘’নাগ যদি ‘নাগা’ হয়, ‘সেন’ হয় ‘সেনা’/ বড়ই কঠিন হবে মেয়েদের চেনা’’,– অনবদ্য! রবীন্দ্রনাথের ‘কণিকা’-ধাঁচের কবিতাও আছে তাঁর, ‘আঁধিয়ারে কেঁদে কয় সলতে,/ ‘চাই নে চাইনে আমি জ্বলতে’।

বাঙালি প্রতিভার অকালপ্রয়াণের তালিকা আরও আছে। ডিরোজিও (০৮.০৪.১৯০৯ – ২৬.১০.১৯৩১, বাইশ বছর), তরু দত্ত (০৪.০৩.১৯৫৬ – ৩৯.০৮.১৯৭৭, একুশ বছর), সোমেন চন্দ (২০.০৫.১৯২০ – ০৮.০৩.১৯৪২, বাইশ বছর), হুমায়ুন কবীর (২৫.১২.১৯৪৮ – ০৬.০৬.১৯৭২, চব্বিশ বছর)। সুকুমার রায় তুলনায় বেশিদিন বেঁচেছেন, ৩৭ বছর। সুকুমার তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আবোলতাবোল’ দেখে যেতেও পারেননি। সুকান্ত-ও পারেননি ‘ছাড়পত্র’ দেখে যেতে। ‘কুসুমিত ইস্পাত’, হুমায়ুনের প্রথম কবিতার বই, ওঁদের-ই মত প্রেসে ছিল। মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন পর তাঁদের বইগুলি বেরোয়। এটা তাঁদের স্বল্পায়ু জীবনের অন্য এক ট্র্যাজেডি। আরও মর্মান্তিক, সোমেন ও হুমায়ুন নিহত হয়েছিলেন, যথাক্রমে ছুরিকাঘাতে ও গুলিবিদ্ধ হয়ে! সোমেনের মৃত্যুতে সুকান্ত কবিতাও লেখেন, ‘ছুরি’।

কীটস, চেস্টারটন, সিলভিয়া প্লাথ, আপলেনিয়ারের মতই স্বল্পায়ু ও চিরজীবী কবিকিশোর সুকান্ত।

চিত্র: গুগল