ঋত্বিককুমার ঘটক নিঃসন্দেহে এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক। কেবল চলচ্চিত্রেই যে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল তা নয়। কিশোর বয়স থেকেই তিনি নাটকে অভিনয় করেছেন, কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন গল্প, নাটক, প্রবন্ধ। রাজশাহী কলেজে পড়াকালীন তিনি ‘অভিধারা’ নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। যৌবনেই যোগ দিয়েছিলেন রাজনীতিতে। পিতা ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। তাই ছাত্রজীবনে তাকে নানা জেলায় ঘুরতে হয়েছে, আর তাই তাঁর বিদ্যালয়-জীবন কেটেছে বিভিন্ন স্থানে ও জেলায় জেলায়।
একথা অনস্বীকার্য যে, আজ ঋত্বিকের মূল পরিচয় একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র পরিচালকরূপে। আর তাঁর সমগ্র চলচ্চিত্রভাবনার পেছনে ক্রিয়াশীল সাতচল্লিশের দেশভাগের বেদনা ও আর্তি, ক্ষত। দুই বাংলার ভাগ হয়ে যাওয়াকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। পারেননি কোনও সচেতন ও স্থির মস্তিষ্কের মানুষ। তবে ঋত্বিকের যন্ত্রণাটা এতই প্রবল ও চিরস্থায়ী হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, সমগ্র জীবনটাই তিনি ব্যয় করে ফেললেন দেশভাগের কাজরীগাথা নির্মাণে।
অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, ‘আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে, ভাগ হয়নিকো নজরুল’। নজরুলের মতো ঋত্বিক-ও ভাগ হননি। তার প্রমাণ, ৪৭-এর দেশভাগের দরুন তিনি তাঁর জন্মভূমি রাজশাহী ছাড়তে বাধ্য হলেও কোনওদিন তার মাতৃভূমিকে ভুলতে পারেননি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বেপরোয়া হয়ে পূর্ববঙ্গে ঢুকে পাক-সৈন্যদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের ছবি তুলেছেন। সারা ভারতের চলচ্চিত্রজগতের মানুষকে,— দিলীপকুমার, নার্গিস, লতা মঙ্গেশকর প্রমুখকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলেছেন। যুদ্ধের শেষে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে ঢাকায় পদার্পণ করামাত্রই বিহ্বল হয়ে কেঁদে ফেললেন! এবং অচিরেই বাংলাদেশের মাটিতে বসে নির্মাণ করলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণের কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-কে ভিত্তি করে তাঁর চলচ্চিত্র।
ঋত্বিক ঘটকের জীবনের প্রথম বাইশ বছর (১৯২৫-১৯৪৭) কেটেছে মূলত পূর্ব-বাংলায়, যা এখনকার বাংলাদেশ। তাঁর জন্ম ঢাকার ২,ঋষিকেশ দাস রোডের ঝুলন বাড়িতে। ১৯৪৭, অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি মূলত পূর্ব-বাংলায় কাটান। আমরা দেখব, পূর্ব-বাংলা যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে-দেশ, সে-ভূমির প্রভাব তদনুরূপ ঋত্বিকেরও পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে।
ঋত্বিক পড়াশোনা শুরু করেন সম্ভবত যশোরে, দু-আড়াই বছর বয়সে, যখন তাঁর ম্যাজিস্ট্রেট বাবা সুরেশচন্দ্র ঘটক সেখানকার কার্যভার নিয়ে সে-জেলায় যান। ঋত্বিকের যমজ বোন প্রতীতি দত্তের স্মৃতিচারণে সেসময়ের বেশ কিছু ছবি পাই। সেই সময় বাবার সাহচর্যে ঘোড়ায় চড়া শিখেছিলেন ঋত্বিক। ওই বয়সেই রবীন্দ্রনাথের গান শোনার সূচনা, ‘আমার অভিমানের বদলে আজ নেবো তোমার মালা’! প্রতীতি লিখছেন, ‘ঋত্বিক আর আমি গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম’। বই আর গান সে বয়স থেকেই ছিল ঋত্বিকের নিত্যসঙ্গী। ভূতের ভয় ছিল তাঁর বেজায়। তাই মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোতেন। আর ছিল যমজ বোনটির সাথে ভাব, মেলামেশা ও সুখদুঃখ ভাগ করে নেওয়া।
কী যে অসম্ভব টান ছিল ঋত্বিকের, এই বোনটির প্রতি! শিশু বয়স থেকেই একসাথে ওঠাবসা থাকাটাই স্বাভাবিক, তবে একজনের জ্বরে আরেকজনের জ্বর বাঁধানো? ছোটবেলায় দু’জনকে পড়তে পাঠানো হল দার্জিলিংয়ে। প্রতীতি লিখছেন, ছোটবেলায় ‘একসঙ্গে ঘুমিয়েছি। একরকম পোশাক পরেছি, একসঙ্গে সাইকেল চালিয়েছি। — এক মুহূর্তের জন্যও আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না।’ ওদের ডাকনাম ছিল ভবা আর ভবি। আট বছর বয়সে বোনের ডিপথিরিয়া হল। ছোঁয়াচে রোগ। কাছে যাওয়া বারণ। ভবা ভবিকে লুকিয়ে দেখতে গিয়ে নিজের রোগ বাঁধিয়ে স্বস্তি! ‘তোকে ছাড়া একদম ভালো লাগছিলো না রে! অসুখ হয়ে ভালোই হলো’— ভবা উবাচ!
ন’বছর বয়সে ভবির টাইফয়েড। জ্বর ছাড়ল ৮৬ দিন পর। ‘আমার অসুখের সময় ঋত্বিক ঘরের সব জিনিসপত্র পাগলের মতো ভেঙে ফেলত। আমার খেলনা, বই বুকে চেপে আমাদের খেলাঘরে বসে বসে শুধু কাঁদত।’ আড়বাঁশি বাজাতেন ভাই, আর বোনের গান। এই অসম্ভব ভাইবোন লগ্নতাই কি ঋত্বিকের ছবিতে বারবার ঘুরেফিরে আসেনি? আর তাঁর শেষপর্যায়ের ছবি ‘তিতাস’-এ?
যশোরের পর ঋত্বিকের ময়মনসিংহ-পর্ব। এখানেও ঘটনা কম ঘটেনি। সেখানে তিনি মিশনারি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ঋত্বিকের জীবনের এই পর্যায়টি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ-সময় ঋত্বিক ছিলেন অসম্ভব দুরন্ত। কিন্তু স্কুলের প্রিন্সিপাল ইংরেজ মহিলা মিস হগবেনের স্নেহ-ভালবাসায় ঋত্বিকের জীবনে পরিবর্তন আসে। ঋত্বিক আর প্রতীতি তাঁর কাছে ছিলেন Rit আর Prit। কেবল কি তাই? হগবেন তাঁকে এমন একটি শাশ্বত শিক্ষা দিয়ে গেছেন, যা ঋত্বিকের জীবনে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। হগবেন তাঁকে বলেছিলেন, ‘Whatever you do, do with your mind.’ ঋত্বিক কি তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষয়িত্রীর কথাটি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেননি?
ঋত্বিকের পরিবারটি ছিল পরিশীলিত ও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে অগ্রণী। শোনা যায়, আদিতে তাঁরা কাশ্মীরি। তাঁদের কোনও এক পূর্বপুরুষ প্রথমে পাবনায় এসে বসবাস করতে থাকেন। পরে তাঁরা রাজশাহীতে থিতু হন। তাই একদিকে কাশ্মীরী ব্রাহ্মণের ঐতিহ্য, আর অন্যদিকে বরেন্দ্র ভূমির সংস্কৃতিতে গড়ে উঠেছিল তাঁদের সাংস্কৃতিক পরম্পরা। বাড়িতে গানবাজনার চল ছিল। নাটক অভিনীত হত। তাঁদের রাজশাহীর বাড়িতে এমনকি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর-ও বসত। ঋত্বিকের বড়ভাই মণীশ ঘটকের উৎসাহ ছিল এতে, যে কারণে ১৯৩৫ সালে রাজশাহীতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কনফারেন্সে ফয়েজ খাঁ, আব্দুল করিম খাঁ, ওঙ্কারনাথ ঠাকুর প্রমুখ এসে তাঁদের বাড়িতে ছিলেন। পরবর্তীতে আমরা যে ঋত্বিককে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সরোদের তালিম নেওয়ার কথা জানতে পারি, তখন এই উৎসটির কথা মনে না পড়ে পারে না। শুধু কি তাই? ঋত্বিকের যাবতীয় ছবিতে যে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ব্যবহার, তার উৎস নির্দেশ পাই তো এখানেই। এসব কি বাংলাদেশ-বাহিত ঐতিহ্য নয়? ঋত্বিকের কবিতা লেখার সূচনা (প্রতীতি জানাচ্ছেন, ঋত্বিকের কবিতা দেশ পত্রিকায় বেরোয় নাকি তিনি ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়!), গল্প-নাটক লেখার, ‘অভিধারা’ নামে পত্রিকা সম্পাদনার সূচনা পূর্ব-বাংলায় বসে।
প্রকৃতিকে দু’চোখ মেলে দেখার সূচনা ও ময়মনসিংহ থেকে। টর্নেডো দেখেছেন, দেখেছেন ব্রহ্মপুত্রের মতো ভয়াল নদী, বাবার সঙ্গে দুই ভাইবোন হাতির পিঠে চড়ে সুসং যাত্রা, এসব তাঁর মনে চিরস্থায়ী দাগ রেখে যায়। দাদা লোকেশ ঋত্বিককে ছবি আঁকায় তালিম দেন। হ্যাঁ, ঋত্বিক ছবিও আঁকতে পারতেন।
মাঝে তিনি কলকাতা ও কানপুরে কিছুকাল কাটালেও ফের রাজশাহীতে এসে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। ঋত্বিকের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় ছিল এই পর্যায়টি। ইংরেজি অনার্সের ছাত্র ঋত্বিক শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন নামকরা অধ্যাপক আবু হেনাকে। এ-সময় নাটক নিয়ে মেতে ওঠা, পত্রিকা সম্পাদনা, গল্পের পর গল্প লিখে চলা, এবং সেসব গল্প দেশ, শনিবারের চিঠি, অগ্রণী-তে প্রকাশিত হয়ে রাতারাতি লেখক খ্যাতি লাভ, এসব ঘটেছিল। গঠন পর্বের এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়কে বাদ দিয়ে কি ঋত্বিকের মূল্যায়ন সম্ভব?
বাংলাদেশের কাছে তাই ঋত্বিকের ঋণ অসীম।
