Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

রাজা রামান্না: পদার্থবিজ্ঞানীর পিয়ানো ও ‘পোখরান’

ছোট থেকেই ছেলেটির সঙ্গী ছিল মিউজিক। মাইসোরে কনভেন্ট মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় ক্লাসিক্যাল ইউরোপিয়ান মিউজিক শিখেছিলেন। পিয়ানো বাজানোতেও দক্ষতা অর্জন করেন। তখন ছ’বছর বয়স। তারপর যখন ব্যাঙ্গালোরের বিশপ কটন বয়েজ স্কুলে পড়েন, পিয়ানো বাজানোয় ডুবে থাকতেন। সেই সঙ্গে মিউজিকোলজির বক্তৃতা শুনতেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে। সুর ও সঙ্গীতের অনুরাগের পেছনে ছিল ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডেন এবং একজন মিশনারি শিক্ষিকার বিশেষ ভূমিকা।

সেই ছেলেটি যখন ম্যাড্রাস ক্রিশ্চান কলেজ থেকে ফিজিক্স নিয়ে বি.এসসি পাশ করছেন; পাশাপাশি ক্লাসিকাল মিউজিকেও বি.এ ডিগ্রি অর্জন করছেন তিনি। পরবর্তীতে সেই ছেলেটি যখন লন্ডনের কিং’স কলেজে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স বিষয় নিয়ে পিএইচ.ডি করছেন, ওই একই সময়ে সেখান থেকে এল.আর.এস.এম (LRSM) কোর্সে ডিপ্লোমা পাশ করছেন ‘মিউজিক’ বিষয় নিয়ে। আবার সেই তরুণটিকেই দেখা যাচ্ছে লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অফ মিউজিক-এ পিয়ানো বাজানোর প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছেন কিংবা অপেরা আর অর্কেস্ট্রার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকছেন।

যাঁর কথা বলছি, তিনি ড. রাজা রামান্না (Raja Ramanna, ১৯২৫–২০০৪)। ভারতবর্ষের অন্যতম নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট। ভারতের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠায় রূপ দেওয়ার পেছনে ছিল যাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কেউই বুঝতে পারেন না— রামান্নার নামের পাশে লেখা PhD, LRSM কেন। নামের পাশে ওইভাবে লেখাটাই পছন্দ ছিল রামান্নার। কিন্তু ওই LRSM-এর কী মানে? LRSM-এর পুরো কথাটি হল— ‘Licentiate of the Royal School of Music’। যা ইংল্যান্ডের ‘Royal Schools of Music’-এর একটি মিউজিক ডিপ্লোমা উপাধি।

পিয়ানো বাজানোয় মগ্ন থাকতেন ড. রামান্না।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। ড. রামান্নার ভূমিকা একদিকে যেমন প্রযুক্তিবিদ, নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট, প্রশাসক, লিডারের, অন্যদিকে মিউজিসিয়ান হিসেবে, সংস্কৃত সাহিত্যের স্কলার এবং ফিলোজফি গবেষক হিসেবেও ছিল তাঁর ভূমিকা। ড. হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন তিনি। ভারতের এনার্জি এবং প্রতিরক্ষা প্রোগ্রামে সঠিক দিশা দেখিয়েছেন রামান্না।

তাঁর লেখা ‘In Years of Pilgrimage’ নামক গ্রন্থে পিয়ানো বাদন সহ তাঁর বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। মিউজিকের ওপর লেখা তাঁর গ্রন্থটির নাম ‘The Structure of Music in Raga and Western Music’। প্রায়শই তিনি বেঠোভেন, মোৎজার্ট কিংবা ফ্রানজ লিস্টের সুর বাজাতেন কনসার্টে।

ড. রামান্নার সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ ‘The Structure of Music in Raga and Western Music’।

রামান্নার পূর্বসূরী হোমি ভাবার সঙ্গে তাঁর পরিচয়পর্বটিও একটি বেশ মজাদার ঘটনা। সেসময় ভারতবর্ষের দিকপাল বিজ্ঞানী ড. হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা। ভারতের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের জনক। আর রামান্না তখন পিএইচ.ডি স্টুডেন্ট। সালটা ছিল ১৯৪৪। প্রথম সাক্ষাৎ হচ্ছে দুজনের। ট্রিনিটি কলেজের একজন অধ্যাপক তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। রামান্নাকে সেই অধ্যাপক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘স্টেট গেস্টহাউসে একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী আছেন, সঙ্গে আছেন তাঁর মা। দারুণ মিউজিক অনুরাগী। এই গেস্টহাউসেও গ্রামাফোনে তাঁরা মিউজিক শোনেন। তুমি কি তাঁর সঙ্গে দেখা করবে?’ এভাবেই পরিচয় হল দুজন মোৎজার্ট অনুরাগীর।

এই সাক্ষাৎকারের পরে তাঁদের দুজনের আবার দেখা হচ্ছে ভারতে, বছর পাঁচেক পরে। তিন বছর পরে টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এ (Tata Institute of Fundamental Research, TIFR) রামান্নাকে নিউক্লিয়ার সায়েন্স বিভাগের স্থায়ী ফ্যাকাল্টি পদে নিযুক্ত করার জন্যে আহ্বান জানালেন ভাবা। দুবছর পরে দেশে ফিরে ড. রামান্না ট্রম্বে-তে অ্যাটমিক এনার্জি এসটাব্লিশমেন্ট, যা পরে হয়েছে ‘ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার’ (Bhaba Atomic Research Centre, BARC), সেখানে যোগ দেন। শুরু হল ভারতের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স তথা নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির এক নতুন অধ্যায়।

একজন পরিপূর্ণ এবং প্রতিভাধর মানুষ রাজা রামান্না তাঁর কৃতিত্ব ও সাফল্যের জন্যে অজস্র সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন। ড. হোমি ভাবা এবং বিক্রম সারাভাই যে পথে শুরু করেছিলেন সেই পথকে আরও সুবিস্তৃত করেছেন ও উচ্চতম পর্যায়ে তুলে নিয়ে গেছেন। ভারতের শক্তি এবং নিরাপত্তা কার্যক্রমে মুখ্যভূমিকায় থেকে যথাযথ রূপ দিয়েছেন। ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভিত্তিস্থাপনা এবং সফল রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে তথা পরীক্ষামূলক শান্তিপূর্ণ বিস্ফোরণের অন্যতম সফল সৃষ্টিকারীর নাম রাজা রামান্না।

ভারত প্রথমবার পরীক্ষামূলকভাবে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরীক্ষা করে এই পোখরানে।

‘পোখরান’ শব্দটির সঙ্গে আমাদের প্রায় সকলেরই পরিচয় আছে। উনপঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৭৪ সালের ১৮ মে। কী হয়েছিল সেদিন, মনে পড়ে? রাজস্থানের এই পোখরানে ভারত প্রথমবার পরীক্ষামূলকভাবে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরীক্ষা করে। যে খবরে বিশ্ববাসী চমকে উঠেছিল। আর এক বছর পরে, পঞ্চাশ বছরে পড়বে পোখরানের মাটিতে ভারতের ইতিহাস সৃষ্টি করার দিন। গুরুত্বপূর্ণ সেই মিশনটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’। ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ কেন? আসলে, যেদিন এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপটি নেওয়া হয়েছিল, সেই দিনটি ছিল বুদ্ধপূর্ণিমার দিন, বুদ্ধজয়ন্তী। পোখরানে সফলভাবে পারমাণবিক পরীক্ষার পরে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বপ্রথম বার্তাটি দেওয়া হয়েছিল, ‘বুদ্ধা ইজ স্মাইলিং’, বুদ্ধ হাসছেন। আর প্রধানমন্ত্রীকে এই বার্তাটি যিনি দিয়েছিলেন তিনি ভাবা রিসার্চ সেন্টারের তৎকালীন অধিকর্তা রাজা রামান্না। ভারতের প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষার সাফল্য দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। যার ফলে বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অন্যতম হিসেবে উঠে আসে ভারতের নাম৷ এই মিশনের পোশাকি নাম ছিল ‘পোখরান-১’। এত গোপনে এই পরীক্ষা করা হয়েছিল যে, ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামও এই বিষয়ে আগাম কিছু জানতে পারেননি। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের বিজ্ঞানীদলের প্রধান ছিলেন ড. রাজা রামান্না।

সফল পারমাণবিক পরীক্ষার পরে পোখরানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

ড. রামান্না ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টর পদে ছিলেন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ এবং ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ ছিলেন অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান। কলকাতায় ‘ভেরিয়েবেল এনার্জি সাইক্লোট্রোন সেন্টার’ (Variable Energy Cyclotron Centre, VEC) প্রতিষ্ঠায় ড. রামান্নার ছিল বিশেষ ভূমিকা এবং সহায়তা। এখনও রাজা রামান্নাকে ‘ভারতবর্ষের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের জনক’ হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ পুরস্কার ভাটনগর সহ ভারত সরকারের সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান পুরস্কার পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ সম্মান সহ পেয়েছেন আরও একাধিক সম্মান। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টর অফ সায়েন্স উপাধিতে সম্মানিত হয়েছেন। প্রায় এক বছরের মত ‘ইউনিয়ন মিনিস্টার অফ স্টেট ফর ডিফেন্স’-এর দায়িত্ব সামলেছেন।

আমরা বোধ হয় খুব তাড়াতাড়ি তাঁকে ভুলে গেলাম! গতকাল ২৮ জানুয়ারি নিঃশব্দে পেরিয়ে এলাম রাজা রামান্নার জন্মদিন।

চিত্র: গুগল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen − twelve =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »