Site icon BhaloBhasa

গুরু নানক : জন্মতিথির শ্রদ্ধা

গুরু নানক (১৪৬৯-১৫২৯) শিখধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। এই ধর্মটি পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম ধর্ম। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে তিন কোটি শিখ তাঁর মতাবলম্বী।

একটি কথা মনে রাখা জরুরি। শিখধর্ম উদ্ভূত ও বিকশিত হয় অভিভক্ত পঞ্জাবে। কিন্তু পাঞ্জাববাসী মাত্র-ই শিখ নন। তাঁদের মধ্যে মুসলমান যেমন আছেন, তেমনই আছেন বহু সনাতনপন্থীও। আছেন আদিবাসীরাও,— খোক্কর, গাক্ কারা, রাওয়াল, সানসি ও অন‍্যান‍্য।

উপমহাদেশের ধর্মীয়, আধ‍্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একদিকে সুফীবাদ ও অন‍্যদিকে ভক্তিবাদের ভূমিকা ছিল অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজামউদ্দীন আউলিয়া, খাজা মইনুদ্দীন চিশতি, রজব, রুইদাস, জোলা, কবীর, শ্রীচৈতন‍্য, জ্ঞানদেব, শঙ্করদেব, তুলসীদাস, তুকারাম যে সহজ ঈশ্বর-উপলব্ধি ও আরাধনার কথা ব‍্যক্ত করে গেছেন, তাতে অগণিত মানুষ তাঁদের অনুসারী হন। ধর্মীয় বহু কুসংস্কার দূর হয় তাতে।

গুরু নানকের ভূমিকাও এইরকম শ্রদ্ধার সঙ্গে কীর্তিত হয়। ১৪৬৯-এ মাতা তৃপ্তা ও পিতা মেহতা কল‍্যাণ দাস বেদীর সন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। লাহোরের তালবন্দী গ্রামে, এখন যা নানকানশরীফ নামে পরিচিত। পিতা কাজ করতেন মুসলিম জমিদার রায় বুল্লারের ভূমিরাজস্ব বিভাগে। শিশুকালে কিছুটা ফার্সিভাষা শেখেন। পড়াশুনো খুব একটা করেননি। গান লিখতেন ছোট বয়স থেকেই। বন্ধু মর্দানাকে নিয়ে গ্রামে-গ্রামান্তরে গেয়ে বেড়াতেন। হাতে রবাব। পর্যটনপ্রিয়তা তাঁকে আঠাশ হাজার কিলোমিটার পদব্রজে পরিক্রমা করিয়ে ছেড়েছে। আধ‍্যাত্মিক এই ভ্রমণকে বলে ‘উদাসীন’। ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত,— দিল্লি কাশী কাশ্মীর বৃন্দাবন গয়া কামরূপ বাংলা তো বটেই, গিয়েছেন মক্কা মদিনা বাগদাদ, শ্রীলঙ্কা, সুদূর তিব্বত। তাঁর ধর্মীয় এষণা অতঃপর তেত্রিশ বছরে তাঁকে এই উপলব্ধি এনে দিয়েছে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ অর্থহীন, সমতা, ভ্রাতৃত্ব ও সদাচরণ-ই প্রকৃত মনুষ‍্যধর্ম। বর্ণপ্রথা ও মূর্তিপূজা মানতেন না। তাঁর প্রচারিত ধর্মের তিনটি স্তম্ভ,— ভাণ্ড চাককো, কিরাত করো, আর নাম জপো।

নানক বিবাহিত ছিলেন। স্ত্রীর নাম সুলখনা। দুই পুত্র ছিল তাঁর,— শ্রীচাঁদ ও লক্ষ্মীদাস।

নানকের অনুসারীরা ‘শিখ’, অর্থাৎ শিষ‍্য। শিখদের যে ধর্মগ্রন্থ, ‘গ্রন্থসাহেব’, সেখানে হিন্দু, মুসলিম ও অন‍্যান‍্য ধর্মীয় মহাত্মাদের বাণীও স্থান পেয়েছে।

নানকের শিষ‍্যরা একত্র বসে আহার করেন। জাতপাত মানেন না। এই আহারকে বলে ‘লঙ্গর’। মধ‍্যযুগে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার ওপরে উঠে মানুষকে ‘সবার উপরে সত‍্য’ দেখানোর এই যে প্রয়াস, শিক্ষালাভের জন‍্য প্রয়োজনে চীনদেশে যাওয়ার-ও যে নির্দেশনা হজরত মহম্মদ রসলুল্লাহ্-এর (সা.), তাকে মান‍্যতা দিয়েই যেন মক্কায় যাওয়া, গুরু নানকের কাছে এই শিক্ষা নিতে পারি আমরা। ‘যিনি সব মানুষকে এক বলে বিবেচনা করেন, তিনি-ই ধার্মিক’, একথা বলেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে মুসলিম মাস্তানার বন্ধুত্ব, তাঁর একেশ্বরবাদ, এসমস্ত তাঁর ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন। তাছাড়া শিখদের পবিত্র গ্রন্থে রসুলুল্লাহ্ যে শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখিত, সেটাও তাঁর ধর্মসহিষ্ণুতার প্রমাণ।

তাঁর শিষ‍্যদের প্রতি নির্দেশ ছিল প্রত‍্যূষে ওঠা, নামজপ, ঈশ্বরের নামে কাজ করে যাওয়া।

মধ‍্যযুগের সুফি ও ভক্তিমার্গের ধর্মপ্রবক্তাদের মাধ‍্যমে তাঁদের নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষাও ব‍্যাপকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। শ্রীচৈতন‍্যের আবির্ভাব নিয়ে এসেছিল জীবনীসাহিত‍্যের প্লাবন ও একই সঙ্গে বৈষ্ণবপদাবলীর বন‍্যাধারা। কবীরের আবির্ভাব হিন্দি সাহিত‍্যকে গতিজাড‍্য দিল। তাঁর রচিত ‘দোহা’ আর ‘বীজক’ হিন্দি সাহিত‍্যের অমূল‍্য সম্পদ। মীরাবাঈ-রচিত ভজন তেমনি রাজস্থানি-গুজরাতি-ব্রজ (বৃন্দাবনের ভাষা) ভাষার অনায়াস বহতা নিয়ে আসে। তুকারামের ‘অভঙ্গ’ মারাঠি সাহিত‍্যকে সমৃদ্ধ করে। সুফি সন্তদের গজল, তাসাউফ, পীরগাথা, জঙ্গনামাও এক্ষেত্রে উল্লেখ‍্য। নানকের প্রভাবেও গুরমুখী ভাষা অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। শিখ গুরুদের মধ‍্যেই তো দেখি গুরু নানক ছাড়াও অঙ্গদ, অমরদাস, রামদাস, অর্জুনদেব, তেগবাহাদুর ও গোবিন্দ সিং কাব‍্যচর্চা করে গেছেন। তাই ধর্মীয় ইতিহাস ও সাহিত‍্য সমধারায় বয়ে চলে। একথা প্রাচীন ধর্মসমূহের ক্ষেত্রেও দেখতে পাওয়া যায়। সাহিত‍্য ছাড়াও চিত্রশিল্প, এমনকি স্থাপত‍্য-ভাস্কর্যেরও প্রগতি ঘটে এর ফলে।

নানক সম্পর্কে বিস্তৃত তথ‍্য জানা যায় না। পুরীতে শ্রীচৈতন‍্যের সঙ্গে দেখা হয়েছিল নাকি তাঁর। কাশীতেও কবীর-সান্নিধ‍্য ঘটে থাকতে পারে। তাঁর ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন মার্দানা নামে এক মুসলমান। পরে তিনি শিখধর্মে দীক্ষা নেন। সঙ্গীতগুণী মার্দানা তানসেনের গুরু স্বামী হরিদাসকে যন্ত্রবিদ‍্যা শিখিয়েছেন। পর্যটনপ্রিয় নানক পূর্ববঙ্গের ঢাকা ও চট্টগ্রামেও এসেছিলেন। চট্টগ্রামের চকবাজারে তাঁর আগমনের প্রমাণ মিলেছে। ইতিহাসবিদ হরিরাম গুপ্তের মতে, নানক ১৪৯৬ থেকে ১৫২১, এই পঁচিশ বছর দেশবিদেশ ঘুরে বেরিয়েছেন। তাঁর পোশাকে হিন্দু ও মুসলিমদের পোশাকের অনুবর্তিতা ছিল। অবশেষে পাঞ্জাবের কর্তারপুরে থিতু হন তিনি। এবং এখানেই সম্ভবত নদীতে ডুবে মৃত‍্যু হয় তাঁর। তাঁর মরদেহের হদিশ মেলেনি।

চিত্রণ: গুগল