Site icon BhaloBhasa

গৌতম চৌধুরীর কবিতাগুচ্ছ

অপরগুচ্ছ হইতে

সমস্ত আঁচড় নির্মমভাবে মুছিয়া যাইতেছে। সরিয়া যাইতেছে উচ্ছ্বাস ও আর্তনাদ হইতে ঠিকরাইয়া-পড়া চাপচাপ রঙগুলি। পুরা নিশানটি কাফনের কাপড়ের মতো সাদা হইয়া আসিল। বিদায়-মুহূর্তের জন্য এটুকু আয়োজনই কি তবে শ্রেয়! পুরানো যাত্রীরা বিদায় লইবে। সাথে সাথেই আসিয়া পৌঁছাইবে নতুন যাত্রীরা। তাহাদের স্বাগত জানাইবার জন্য কি তবে নতুন কিছুর বন্দোবস্ত হইবে? নাঃ, তেমন সময় নাই। মনও নাই। বাতাস বিলকুল স্তব্ধ। সাদা কাপড়টিই আস্তে আস্তে দুলানো যাক। দুলাইতে দুলাইতে ক্রমে বুঝা যাইবে, সাদা রঙের কোনও তাৎপর্য নাই। চিহ্ন আরোপের সকল জটিলতা হইতে সরিয়া আসিয়া আজকের নিশানটি নিছকই সাদা…

জলের উপরে থিরথির ছায়াটি, প্রতারক। আত্মমুগ্ধতার ঘোর যেন শুনিতে পায় এক ফিসফিস গলার হাতছানি। কাছে আয়, কাছে আয়। আর পায়ে পায়ে নামিয়া যায় আরও। সামনে ঢলঢল করিতেছে মৃত্যুর মতো জল। কিন্তু সংবিৎ ফিরাইবে কে! সহসাই আকাশ ফুঁড়িয়া একটি কুকুর চিৎকার করিয়া উঠিল। চটকা ভাঙিল তাহার। বুঝা গেল, হাঁটুজল-বুকজল পার হইয়া গলাজলের একেবারে কিনারায় লইয়া গিয়াছিল ওই ছায়া। কালপুরুষের কুকুরটি এখনও থামে নাই। আকাশ তছনছ করিয়া যতই সে ঘেউ ঘেউ করুক, তাহাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়…

মাথার উপর দিয়া সাঁ সাঁ উড়িয়া যাইতেছে ঝাঁক ঝাঁক তারা। ইতস্তত খসিয়া পড়িতেছে দু’একটি উল্কা। দূরে দ্যাখা যাইতেছে এক ধূমকেতুর লেজ। আর নিচে, ওই যে, নীল রঙের চোখ-জুড়ানো আলো ছড়াইতেছে, ওই হইল আমাদের পৃথিবী। পড়িয়া পড়িয়া ঘুমাইলে কি আর এহেন তোফা সফরটি হইত! এমন মজা পাইতে গেলে একটু পেরেশানি তো করিতেই হইবে। দামড়া মানুষকে কে আর ঝিনুকে করিয়া দুধ খাওইয়া দিবে। লজ্জায় চোখ নামাইয়ো না। দ্যাখো, ওই যে ছুটিয়া যাইতেছে কিছু গ্রহাণুপুঞ্জ। ভয়ের কিছু নাই। সবারই চলিবার রাস্তা পূর্বনির্ধারিত। ঘণ্টা-প্রহর কাঁটায় কাঁটায় মিলাইয়া, যে যাহার সাধনোচিত ধামে গমন করিবে। যত অনিশ্চয়তা মানুষের মনে। লম্বা জীবন কাটাইয়াও কিছুতে সে নিজেকে চিনিতে পারে না। চিনিবে কী করিয়া! মুখের সামনে আটপহর আটখানি আয়না ধরিয়া থাকিলে কি চলে? সব ফেলিয়া মাঝে মাঝে এইভাবে বেফিকির শূন্যের বুকে ঘুরিয়া বেড়াইতে হয়…

তাহাকে তন্দ্রা বলা চলে। সুপ্তি নয়। মনে হইল, একটি অর্গল খুলিল। একটি বাতাস আসিয়া পৌঁছাইল অন্য জন্মের। পিছু পিছু আরও কয়েকটি। তখনই তাহাদের পান-সুপারি দিয়া আপ্যায়ন করিবার কথা। কিন্তু তন্দ্রার ঘোরে সব এলোমেলো হইয়া গেল। ক্ষণিক শিয়রে দাঁড়াইয়া তাহারা যেন কানে কানে কিছু বলিল। তাহার পর ফিরিয়া গেল। তন্দ্রা তখন ধীরে ধীরে সুপ্তির দিকে গড়াইতেছে …

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়