Site icon BhaloBhasa

‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ ও তার গর্ভগৃহ ৩/৪সি তালতলা লেন

একটা ইতিহাসের মুখোমুখি আমরা। আর তা হল, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের যুগান্ত সৃষ্টিকারী ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এবছর শতবর্ষ পূর্ণ করে ১০১ বছরে পদার্পণ করবে। কাজী নজরুল ইসলাম তখন ২২ বছরের তরতাজা যুবক। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে মধ্য কলকাতার ৩/৪সি, তালতলা লেনে কনকনে শীতে তিনি তাঁর ‘অজর অমর অক্ষয়’ কালজয়ী কবিতাটি লিখে ফেলেন। কালজয়ী কবিতা এই ‘বিদ্রোহী’ একটি দীর্ঘ কবিতা। সারারাত জেগে তিনি এই কবিতাটি লেখেন। সে সময় তাঁর সর্বক্ষণের অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু ও ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক কাকাবাবু মুজাফ্ফর আহমেদ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। কিন্তু লেখার পরই কবিতাটি নজরুল ঘুম থেকে তুলে কাকাবাবুকে শুনিয়েছিলেন। তবে এই কবিতার জন্মতারিখটি নিয়ে সংশয় আছে। কেউ বলেন ২৩, কেউ বলেন ২৫, কেউ বলেন ২৭ ডিসেম্বর। কিন্তু ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ— এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই বলে গবেষকরা মনে করেন। কে কোন পত্রিকায় প্রথম বের করবে এই নিয়ে ছিল প্রতিযোগিতা। কিন্তু এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকার ১৩২৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায়। পরবর্তীতে কবিতাটি মাসিক ‘মোসলেম ভারত’, ‘ধূমকেতু’, ‘প্রবাসী’, মাসিক ‘বসুমতী’ ও ‘সাধনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পরপর ৬টি পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’-র পুনঃপ্রকাশিত হওয়া একটি নজিরবিহীন ঘটনা। কবিতাটি নজরুল প্রথমে দিয়েছিলেন ‘মাসিক মোসলেম ভারত’ পত্রিকায়। কিন্তু সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকা পরে পেলেও আগে প্রকাশ করার সুযোগ পায়। প্রকাশের শুরু থেকেই কবিতাটি জনপ্রিয়তা লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন তৈরি করে। আর ‘ধূমকেতু’-তে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই পত্রিকার বিক্রি বাড়তে থাকে। দিনে ওই পত্রিকার দুটো করে সংস্করণ বের করতে হত। কলকাতার জগুবাবুর মোড়ে একসময় ‘ধূমকেতু’ কেনার জন্য উপচে পড়া ভিড় হত। এই দীর্ঘ কবিতাটি ব্রিটিশ সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মীয় মিথ সুচারুভাবে পরিবেশিত। তাই ব্রিটিশ সরকার কবিতাটি বাজেয়াপ্ত বা নিষিদ্ধ করতে পারেনি। বলা ভাল সাহস দেখাতে পারেনি।

মধ্য কলকাতার মৌলালি মোড় থেকে এস এন ব্যানার্জি রোড (সাবেক জানবাজার রোড) ধরে সোজা তালতলা মোড়ের যশোদা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার পেরিয়ে একটা প্রস্তরফলক, যেখানে জানান দিচ্ছে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার গর্ভগৃহ ৩/৪সি তালতলা লেনের পথ বা ঠিকানা। তালতলা এলাকার নজরুল জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি ১৯৯৮-৯৯ সালে এই প্রস্তর ফলকটি স্থাপন করে। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ কবিতার গর্ভগৃহ ৩/৪সি তালতলা লেন আজও ‘হেরিটেজ এরিয়া’ হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি।

শুরুতেই আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য নজরুলকে অনেক সমালোচনা হজম করতে হয়েছে। একসময় নজরুলের বন্ধু কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদারের দাবি, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তাঁর ‘আমি’ প্রবন্ধের অনুকরণ। কিন্তু অনেক সমালোচক তা মানতে নারাজ। তাঁদের মতে, হৃদ্যতা থাকার সুবাদে নজরুল মোহিতলালের ‘আমি’ প্রবন্ধ পড়েছেন ঠিকই। প্রভাবিত হয়েছেন ঠিকই। কিন্তু নজরুলের অনুকরণ বা অনুসরণ থেকে অনুসৃজন অনেক বেশি। ‘বিদ্রোহী’ অতিমাত্রায় সৃজনশীল, মৌলিক ও স্বতন্ত্র। একেই বলে ‘Creation of creation’। একেই বলে সৃষ্টির সৃষ্টি। ‘বিদ্রোহী’-র মাধ্যমে একটি স্বকীয় দিক উন্মোচন করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। তারুণ্যের উন্মাদনা, রোমান্টিকতা, নবযৌবনের দীপ্তি, পৃথিবীর সব ধর্মের মিথকে মিলেমিশে একাকার করে দিয়েছেন নজরুল তাঁর এই কবিতায়। এ এক অভিনব দিক কাজী নজরুল ইসলামের। ‘বিদ্রোহী’ সেই কবিতা যা বাংলা সাহিত্যে প্রথম মুক্তক ছন্দে লেখা। একজন রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত কবি হয়ে ‘বিদ্রোহী’-র মধ্য দিয়ে বাংলা কাব্যে নতুন দিকের উন্মোচন করেন নজরুল। ‘আমি’-কে নানান বিশেষণে বিশেষিত করেছেন যা বাংলা কাব্যজগতে নজরুল স্বতন্ত্র পথের সন্ধান দিয়েছেন। অনেকে যখন নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে স্রেফ একটি ‘অগ্নিস্ফুলিঙ্গ’ বিশ্লেষণ করেন, তখন তাদেরকে ‘বিকৃত মস্তিষ্ক’ বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না।

একটা বিশেষ প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি থেকে কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখেছিলেন। কবি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বর্তমান পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল সদর মহকুমার জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে। গ্রামের আশপাশ আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা। বর্তমান ঝাড়খণ্ড বা সাবেক বিহার সংলগ্ন ছোটনাগপুরের মালভূমির অন্তর্গত আদিবাসী প্রভাবিত এলাকায় ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল। এই বিদ্রোহের আগুন দিকে দিকে ছড়িয়েছিল। নজরুল সেই ইতিহাস ভালভাবেই জানতেন। মকতবের ইমাম হিসাবে আয়ত্ত করেন ইসলামি দর্শন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামায় করাচি সেনানিবাসে মাত্র ১৮-১৯ বছর বয়সে উপলব্ধি করেন রুশ বিপ্লব ও তার সুদূরবিস্তারি প্রভাবকে। আর চুরুলিয়া গ্রামের হিন্দু মা-বোনদের কাছে তিনি ‘তারা খ্যাপা’ হিসাবে সমাদৃত হতেন। ততক্ষণে তিনি সনাতনী মিথ শিখে ফেলেন। আবার গ্রিক ও খ্রিস্টান মিথও আয়ত্ত করেন। তরুণ বয়সে উপলব্ধি করেন গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন ও আইন অমান্য আন্দোলন। আবার তুরস্কের মুক্তিকামী নেতা মোস্তাফা কামাল আতাতুর্কের লড়াই-সংগ্রাম-বীরত্ব উপলব্ধি করেন। তার প্রতিফলন ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় পড়েছে। তাই নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ এমনই একটি কবিতা, একদিকে যেমন ‘খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’ বলতে পারেন, অন্যদিকে তেমনি বলতে পারেন, ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন’। এই ‘খোদা’ বা ‘ভগবান’ আমরা ধরেই নিতে পারি শোষক, নিপীড়ক, অত্যাচারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আমাদের রক্তক্ষয়ী ও ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা যুদ্ধকে বারবার সাম্প্রদায়িকয়িক বিষদাঁত ও বিভাজনের মাধ্যমে বানচাল করতে চেয়েছিল। নজরুল বিষদাঁতকে উপড়ে দিতে একদিকে পূর্ণ স্বরাজের দাবি জোরালো করেন, অন্যদিকে সম্প্রীতি-সংহতির জয়গান করেন। তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় সমস্ত ধর্মীয় মিথকে মিলেমিশে একাকার করেন। তাই ‘বিদ্রোহী’ কখনও ‘জাহান্নামের হাসি’, ‘ইস্রাফিলের সিঙ্গার’, ‘শ্যামের হাতের বাঁশরি’, ‘বাসুকির ফণা’, ‘অর্ফিয়াসের পাশরি মহাসিন্ধু উতলা ঘুম’। এই ‘বিদ্রোহী’ এতটাই শক্তিশালী যে, ‘আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার/ নিক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব আনিব শান্তি শান্ত উদার’। আবার এই বিদ্রোহী হয়ে যান ‘আমি গোপন মেয়ের চকিত চাহনি ছল করে দেখা অনুক্ষণ।’ আবার এই ‘বিদ্রোহী’ বিশ্বামিত্রের অনুগামী হয়ে যেতে পারেন।

নজরুলই বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি যিনি পূর্ণ স্বরাজের কথা বলেন। যে পূর্ণ স্বরাজ আসবে সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে। যে বিপ্লব বা সংগ্রাম হবে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সেই সাহস, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। এই কবিতায় সব ধর্মের মিথ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল বলে ব্রিটিশ সরকার এই কবিতাকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ কবিতা যে কাব্যে স্থান পেয়েছিল সেই ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামকে উজ্জীবিত করতে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহী’। আবার সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহী’। মনে রাখা দরকার, রুশ বিপ্লবের আগে পৃথিবীতে সংগঠিত হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। নজরুলের উপলব্ধিতে তা ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে যখন পরিবর্তনের হাওয়া বইছে, সেখানে সবাই রোমান্টিক ও দেশাত্মবোধক রচনায় নিমগ্ন থাকলেও বিপ্লবী কবি, মানবিক কবি, সৈনিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে কলমকে চালনা করেছেন।

পরাধীন দেশের আবহাওয়ায় লালিত-পালিত নজরুল ছিলেন প্রচণ্ড রকমের দেশপ্রেমিক। আবার স্বাধীনতাকামীও। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথম ও প্রধান বিদ্রোহ ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক অন্যায়, অর্থনৈতিক শোষণ ও ধর্মীয় কুসংস্কার, অনাড়ম্বরতা এবং অনাচারের বিরুদ্ধে।

বিদ্রোহের অনুভূতি পৃথিবীর অনেক ভাষায় অনেক শ্রেষ্ঠ কবিতা ও সাহিত্যের জন্ম দিয়েছে। এ ব্যাপারে কয়েকজন কবির নাম করতেই হয়। তাঁরা হলেন ভলতেয়ার, রুশো, বায়রন, শেলি, ম্যাক্সিম গোর্কি, গ্যেটে, পল এল্যুয়ার, নাজিম হিকমত, পাবলো নেরুদা, মায়াকোভেস্কি, ব্রেখট প্রমুখ। নজরুলের কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকই হল বিদ্রোহের অনুভূতি-সঞ্জাত যাতে কোনও সন্দেহ নেই। ‘বিদ্রোহী’ কবি কথাটি বললেই আমাদের মনে আসে তাঁর সেই সুবিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’-র কথাটাই। কী সেই বিদ্রোহ?

‘মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেইদিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না/ বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেইদিন হব শান্ত।’

সত্যিই এ যেন এক বিদ্যুতের চমক। এ যেন এক চাবুক। এ যেন এক শিহরণ। হ্যাঁ, এই ‘বিদ্রোহী’-র মধ্যেই কবি যেন একাধারে প্রেমিক, পূর্ণ মাত্রায় রোমান্টিক, কঠিন বাস্তববাদী, ঘোরতর সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, প্রচণ্ড স্বদেশী, সব ধর্মের মিথ রোমন্থনকারী, সারা পৃথিবীর কৃষক-শ্রমিকের বন্ধু, পরম আধ্যাত্মিক, অবিমিশ্র নৈরাজ্যবাদী। কী নেই এতে? আমাদের মনে রাখতে হবে, নজরুল নিজেই লিখেছেন, ‘পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে। সকল কিছু নিয়ম কানুন বাঁধন শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে। আর বিদ্রোহ করতে হলে সকলের আগে আপনাকে চিনতে হবে। বুক ফুলিয়ে বলতে হবে, ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ’ (দ্রষ্টব্য: ‘ধূমকেতুর পথ’, ‘রুদ্রমঙ্গল’)। নজরুলের এই গদ্যের কথা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কাব্যময় অভিব্যক্তি হল, ‘আমি মানি নাকো কোন আইন/ আমি ভরা-তরী ভরা-ডুবি/ আমি টর্পেডো/ আমি ভীম ভাসমান মাইন।/ আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস/ আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ।’

এ কী আগুন ঝরানো তীব্র বাণ। এই আগুন ঝরানো বাণ দেশের যুবসমাজকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট। যুবসমাজের ঝলসে ওঠার পক্ষে যথেষ্ট। এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল হয়ে ওঠেন পূর্ণমাত্রায় প্রেমিক। তাই তিনি বলতে পারেন, ‘আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি ছল করে দেখা অনুক্ষণ/ আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা তার কাঁকন চুড়ির কনকন।’ তরুণ-তরুণীর মনকে তিনি প্রেমসাগরে ভাসিয়েছেন। এই মন তো শিরহি-ফরহাদ, লাইলি-মজনু, চণ্ডীদাস-রজকিনী কিংবা মমতাজ-শাহজাহানের মতই।

১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে গভীর রাতে তালতলায় লেখা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার পূর্ণাঙ্গটি ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থে নেই, ভাবের ঐক্য রক্ষার জন্য ৬টি চরণ পরিমার্জন করে বাদ দেওয়া হয়েছে। ১৯৬৫ সালে মুজাফ্ফর আহমেদের লেখা ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে ৩/৪সি তালতলা লেনে লেখা নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পাওয়া যায়। কাকাবাবু মুজাফ্ফর আহমেদের জামাতা কবি আব্দুল কাদের ‘নজরুল প্রতিভার স্বরূপ’ গ্রন্থে সে কথা স্বীকার করেছেন। কবিতার শেষের দিকে ‘আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার’-এর আগের ৬টি ছত্র ছিল এইরকম— ‘আমি উত্তাল, আমি তুঙ্গ, ভয়াল, মহাকাল/ আমি বিবসনা আর ধরাতল নভ/ ছেয়েছে আমার জটাজল।/ আমি ধন্য! আমি ধন্য!/ আমি মুক্ত, আমি সত্য, আমি বীর,/ বিদ্রোহী সৈন্য!/ আমি ধন্য! আমি ধন্য! আমি ধন্য!’

‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থে ভাবের ঐক্যের প্রয়োজনে ওই ৬টি চরণ বাদ দিয়েছেন নজরুল। এই পরিবর্তন ও পরিমার্জন নজরুলের একান্তই নিজস্ব। কাকাবাবু মুজাফ্ফর আহমেদ ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে নজরুলের তালতলা লেনে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি সম্পূর্ণ তুলে দিয়েছেন যা আধুনিক গবেষকদের বড় পাওনা, নতুন খোরাক। আরও উল্লেখ্য, তালতলা লেনে ‘বিদ্রোহী’-র অন্যতম ছত্র ছিল— ‘ছুটি ঝড়ের মতো করতালি দিয়ে হাসি হা হা হা হা হি হি হি হি/ তাজি বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার হাঁকে চি-হিঁ চি-হিঁ, চি-হিঁ চি-হিঁ।’ কিন্তু মিলের খাতিরে ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থে পরিমার্জন করে হয়ে যায়— ‘ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া স্বর্গ-মর্ত্য-করতলে/ তাজি বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার/ হিম্মত হ্রেষা হেঁকে চলে।’

আজকের দিনের পাঠকদের এই কথাগুলো জানানো দরকার। ‘বিদ্রোহী’ সেই কবিতা, যা বিগত শতকের বিশের দশকে পরপর ৬টি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ‘বিদ্রোহী’ সেই কবিতা, যা পৃথিবীর কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়ে অন্তত পৃথিবীর নামকরা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। তাই নজরুল শুধু জাতীয় নন, তিনি আন্তর্জাতিক। করাচি, তেহেরান, আঙ্কারা, মস্কো, টোকিও, বেজিং, ক্যালিফোর্নিয়া সহ ১০টি পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কবিতা পঠিত হয় অনুবাদ করেই। এর চেয়ে সম্মান আর কী হতে পারে? ‘বিদ্রোহী’ বলেই নজরুল হতে পেরেছিলেন জাহান্নামের হাসি, তাজি বোররাকের সওয়ার, আগ্নেয়য়ারি, কালানল, বাসুকির ফণা, জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি, দেবশিশু, অর্ফিয়াসের বাঁশরি। তার ‘আমি’ যেন নানা বিশেষণে বিশেষিত। সমস্ত ধর্মীয় মিথকে একসূত্রে বেঁধে দিয়েছে। পৃথিবীতে এই ধরনের কবিতা হাতেগোনা। তাই ‘বিদ্রোহী’ শুধু অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নয়। বাংলা সাহিত্যে নবযুগের সৃষ্টি করেছে। এমনই এক জ্বলন্ত লাভা যা গণজাগরণের গণকণ্ঠ।

পরিশেষে আরও একটি কথা বলতে ইচ্ছা করছে। আর তা হল, ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবির জাগরণের বিপুল ও বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বাইরের জগতের রাশি রাশি উপমা-অলঙ্কারের প্রকাশ। কিন্তু মূলত এ জাগরণ কবির আত্মগত। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আত্মজাগরণ পরিণত হয়েছে সমষ্টিতে। পরিণত হয়েছে গণজাগরণে। কবি যখন তাঁর অনুভূতি সমষ্টিতে পরিণত করতে পারেন তখনই তা সফল কবিতা হয়। প্রকৃতপক্ষে ‘কব’ উচ্চারণ ও উৎসারণই হল আসল কবিতা। ‘বিদ্রোহী’ সেই অর্থে বাংলা কাব্যজগতে একটি অন্যতম শক্তিশালী কবিতা। আর এই একটিমাত্র কবিতা লিখে নজরুল যদি কবিতা লেখা ছেড়ে দিতেন, তাহলে এই একটিমাত্র কবিতাতেই তিনি ‘অজর-অমর-অক্ষয়-অব্যয়’। শতবর্ষে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সার্থকতা ঠিক এখানেই।

যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর ভয়ংকর রূপ নজরুল দেখেছেন। চারপাশের মানুষের অবক্ষয় দেখেছেন। মানুষের অধিকার রক্ষার তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে অনুভব করেছেন। এক অগ্নিস্রাবী লাভা তৈরি হয়েছে নজরুলের চেতনার গভীরে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সেই রুদ্র ভৈরবের বিঘোষিত কণ্ঠস্বর। সংগ্রামে ও সাহসে তা অনন্য। ব্যাপকতা ও পরিধিতে যা সর্বাত্মক। নবজাগ্রত ও নতুন মূল্যবোধে উৎকীর্ণ মানুষের সার্বিক চেতনার স্বাক্ষরে অঙ্কিত ‘বিদ্রোহী’ জাতীয় কবিতার ভাবার্থে প্রতিফলিত এক সর্বপ্রসারী ও সুদূরপ্রসারী আবেগ। শতবর্ষে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মূল্যায়ন এখানেই। কথাটা দুঃখের হলেও সত্য, ‘বিদ্রোহী’ কবিতার গর্ভগৃহ ৩/৪সি তালতলা লেন নিছকই একটি দালানবাড়ি। আজও হতে পারেনি ‘হেরিটেজ এরিয়া’। মাঝে মাঝে ওই এলাকায় যখন যাই, তখন মনে হয়, ইতিহাস তুমি কথা বলো। ইতিহাস তুমি নীরব কেন? ইতিহাস তুমি বোবা কেন? ইতিহাস তুমি চুপ কেন?

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়