ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে
‘পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ,
ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে’—
মধ্যরাতে বাংলা ভাষার যে কবির পা টলমল করে, যিনি ফুটপাত বদলে ফেলেন অনায়াসে, তাঁর মৃত্যু তিরিশ বছর অতিক্রান্ত হল। ২৩ মার্চ ১৯৯৫ ভোররাতে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় চলে গেলেন চিরনিদ্রায়। আসলে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন। অতিথি-অধ্যাপক হিয়ে বিশ্বভারতীতে সৃষ্টিশীল সাহিত্য বিষয়ক লেকচার দিতে। ছাত্রছাত্রী মহলে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল তাঁর ক্লাস। সেই কাজ অসমাপ্ত রেখে অকস্মাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় চলে গেলেন চিরনিদ্রায়। তাঁর সমস্ত পাঠক সেদিন প্রশ্ন তুলেছিল, এমনিভাবেই কি চলে যেতে হয়? এই শান্ত নির্জন সকালে, এই মধুমাসে, রক্তক্ষরা বসন্তদিনে, এই মহাপ্রস্থান কি ভাল হল! চারপাশে বন্ধুরা ছিল না, ছিল না তুমুল আড্ডা, স্তাবকের ভিড়, মধ্যরাতের কলকাতা ছিল না, গন্তব্যে পৌঁছে দেবার জন্যে শেষ বাস দাঁড়ায়নি সশব্দে! তবু তুমি চলে গেলে। এ যাওয়া তো সম্রাটের মতো হল না। লণ্ডভণ্ড হল না কিছুই! আগুন জ্বলল না কোথাও! ধ্বংস হল না কোনও মহাফেজখানা! নিরাসক্ত গৈরিক মানুষের মতো চির-নিবেদনে চলে গেলে! একহাতে আগুন নিয়ে অন্যহাতে শব্দকে ছেনেছ! আগুনের পরিবর্তে নিজেকে জ্বালিয়ে যে পদ্য গেঁথেছ, তারা যদি একজোট হয়ে কবিকে পোড়াত, তা হলেই ভাল হত। শুদ্ধ হত এই অগ্নিস্নান!
আগের দিন সন্ধ্যায় কবি সভায় অনর্গল পড়ে গেছেন তাঁর প্রিয় সব পদ্য। শেষ পদ্য ছিল ‘আনন্দ-ভৈরবী’।
‘আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিলো না আষাঢ়-শেষের বেলা
উদ্যানে ছিলো বরষা-পীড়িত ফুল
আনন্দ-ভৈরবী।’
তারপর আর কোনওদিন নিজের কবিতা পড়লেন না। তবু তাঁর ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে বাংলা কবিতায়। অনন্ত নক্ষত্রবীথি তিনি অন্ধকারে।
না, তিনি অন্ধকারে ছিলেন না কখনও। যতদিন বেঁচে ছিলেন কবি আলোময় ছিলেন। উজ্জ্বল দৃঢ় দীপ্ত এক কবি-ব্যক্তিত্ব। কবি বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা তখন আধুনিক বাংলা কবিতায় উজ্জ্বল মশাল। এই পত্রিকায় ‘যম’ শিরোনামে কবিতা লিখে বাংলা কবিতার আসরে এলেন। নিজেই লিখেছেন, ‘কোনও প্রেরণা নয়, কোনও সনির্বন্ধ অনুরোধে না— শুধুমাত্র চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে এইসব পদ্য লেখা।’ তারপর সারাজীবন শুধুই পদ্য লিখেছেন। কিন্তু আগে লিখেছেন গদ্য, ‘কুয়োতলা’-র মতো উপন্যাস। লাঙলের ফলায় বর্ণমালা চষে তিনি শব্দ তুলে এনেছেন। অমোঘ আর অব্যর্থ সব শব্দ। যা তাঁর কবিতার মোহময় অবয়ব গড়েছে। লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছেন জীবনের প্রচলিত ধারণা। ছন্দের মধ্যে খুঁজে নিয়েছেন অনিবার্য ছন্দহীনতা। মিল ও অমিলের দ্বন্দ্বে তাই সারাবেলা কাঙালের মতো শুধু কবিতাকেই খুঁজেছেন। বুকপকেটে পদ্য রেখে তিনি মধ্যরাত শাসন করেছেন। উপমা চিত্রকল্প প্রয়োগ, শব্দের ব্যবহার, সবেতেই ছিলেন চৌকস। জীবন তাঁর কাছে ছিল তরল অগ্নি, আবার মৃত্যু ছিল দাউ দাউ আগুন, পোড়া কাঠ। ‘ও চিরপ্রণম্য অগ্নি/ আমাকে পোড়াও’। তবু তাকে তিনি তাচ্ছিল্য করেছেন।
‘যেতে পারি
যে-কোনো দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু কেন যাবো?
সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো।’
কবি শক্তি মৃত্যুবিলাসী হয়েও বার বার ফিরে এসেছেন জীবনের কাছে। প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো?’ সন্তানের মুখে চুমো খেয়েছেন। শব্দের মুখে চুমো খেয়েছেন। কবিতা এমন সম্পূর্ণভাবে খুব কম কবিকে খেয়েছে। তিরিশের কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আমরা যে রহস্যময় অবচেতনের ইশারা খুঁজে পাই, ষাটের দশকে এসে কবি শক্তি তাকেই জড়িয়ে নিলেন গায়ের কাঁথা করে। আমার কথার সপক্ষে আমি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে উদ্ধৃত করব, যা তিনি আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত সমীর সেনগুপ্ত সম্পাদিত ‘পদ্যসমগ্র ১’-এর ‘মুখবন্ধের মুখোশে লিখেছেন। ‘বাংলা কবিতাকে তার স্বখাতে ফিরিয়ে আনলেন জীবনানন্দ। শক্তি তাঁর উত্তরসাধক।’
দেশজ গ্রামীণ শব্দের ব্যবহার, সাধু-চলিত মিশিয়ে তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষা, তাঁর প্রকরণ-বৈশিষ্ট্য। যা আন্তরিকতায় উজ্জ্বল। চির-ভ্রাম্যমাণ এই কবি, গ্রাম শহর নগর বনপথ জঙ্গল পাহাড় নদী পেরিয়ে কোন সুদূরে যে গেছেন! ছন্নছাড়া আত্মভোলা সেই কবি আবার নিজের তাগিদেই সংসারে ফিরেছেন। ফিরেছেন আপন মানুষের কাছে।
ব্যক্তিগত জীবনে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সবার থেকে আলাদা। নিজের তাগিদে, নিজের শাসনে, নিজের মর্জিতে চলেছেন সারা জীবন। তাঁর কবিতা যতটা জনপ্রিয়, ঠিক ততটাই চমকপ্রদ ও আকর্ষণীয় ছিল তাঁর কবিজীবন। খেয়ালি বেপরোয়া দ্বিধাহীন স্পর্ধিত এক মানুষ। যতটা-না সংসারী তার চেয়ে অনেক বেশি ছিলেন ভ্রামণিক। তবে কবিতায় ছিলেন একান্ত সিরিয়াস, সমৃদ্ধ। জীবৎকালে মিথ হয়ে উঠেছিলেন। কখনও শব্দকে শাসন করেছেন, আবার কখনও শব্দের অনুগত পূজারী। কবিস্বভাবে তিনি সতেজ সবল টাটকা এক উচ্চারণ। স্বেচ্ছাচারী হয়েও শৃঙ্খলাপরায়ণ, অমোঘ। ছন্দ ও ছন্দহীনতায় সমান মনোযোগী। লিখেছেন অজস্র কবিতা। ৫১টি কাব্যগ্রন্থ। অনূদিত ও সম্পাদিত কবিতা ও গদ্যগ্রন্থের সংখ্যা ১১১। এরমধ্যে গদ্য লেখা, উপন্যাস ও স্মৃতিচারণ আছে। এছাড়াও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর অজস্র অগ্রন্থিত লেখা ছড়িয়ে আছে। ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৭৫-এ পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার ও ১৯৮৩-তে সাহিত্য আকাদেমি।
বর্ণময় এক জীবন ছিল কবি শক্তির। জীবনে বহু বন্ধুর সঙ্গলাভ করেছেন। আবার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনেক বন্ধু দূরে সরে গেছেন। কিংবা নিজে সরে এসেছেন। তবে কবি-কথাকার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব সবচেয়ে উজ্জ্বল। কবির নিজের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, সেই কৃত্তিবাসের সময় থেকেই সুনীলের সঙ্গে তাঁর সখ্য দীপক মজুমদারের মাধ্যমে। আমরা এও জানি, সুনীল তখন সবে কৃত্তিবাস প্রকাশ করছেন। কফি হাউসে টেবিল জুড়ে চলত তাঁদের আড্ডা। পাশের টেবিলে একমুখ দাড়ি উজ্জ্বল চোখ একটি ছেলের দিকে বার বার চোখ চলে যায় কবি সুনীলের। ছেলেটি ঘন ঘন বিড়ি খায়। খোঁজখবর নিয়ে জানলেন, ছেলেটি স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার ছদ্মনামে বিভিন্ন কাগজে গদ্য লেখে। আসল নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সেই শক্তির লেখা দ্বিতীয় পদ্য সম্পাদক সুনীল ছাপলেন তাঁর সম্পাদিত কৃত্তিবাস পত্রিকায়। শক্তি কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত হলেন। সুনীলের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হল গাঢ়। তারপর তো ইতিহাস। রূপকথার মতো তাঁদের বন্ধুত্বের গল্প ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অনুরাগীদের মধ্যে। এক জায়গা দুই বন্ধুর অদ্ভুত মিল ছিল, তা রবীন্দ্রপ্রীতি। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গান দুই কবি শুধু পছন্দ করতেন না, ভালবেসে দরাজ গলায় গাইতেন। অনেক রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁদের কণ্ঠস্থ ছিল। এই রবীন্দ্রসঙ্গীত আবার এক সময় হারিয়ে যাওয়া কবি-বন্ধুকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।
কলকাতার কবিমহলে খবরটা হাওয়ার মতো ছড়িয়ে পড়েছিল, কবি শক্তি নাকি কোন বন্ধুকে হাওড়া স্টেশনে ছাড়তে গিয়ে নিরুদ্দেশ। তাঁর আর কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। বন্ধু সুনীল খুবই চিন্তিত। শেষে খবর পাওয়া গেল, তিনি নাকি বিহারের চাইবাসায় বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর কাছে আছেন। খবর পাওয়া মাত্র আর এক বন্ধু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে সুনীল ছুটলেন বিহারের চাইবাসা। সেখানে গিয়ে জানলেন সমীর রায়চৌধুরী ট্রান্সফার হয়ে চলে গেছেন অন্যত্র। তা হলে শক্তি কোথায়? সে তো কলকাতায় ফেরেনি! খোঁজ শুরু করলেন দুই বন্ধু। রোরো নদীর ধার ধরে দুই বন্ধু যত এগোচ্ছেন, ততই জঙ্গলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছেন। প্রকৃতির রূপে মোহিত হয়ে তাঁরা বন্ধুকে খুঁজতে ভুলে গেলেন। উদাত্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে এগিয়ে চললেন। এমন সময় বাংলো টাইপের একটা বাড়ির ভিতর থেকে চিৎকার ভেসে এল। —এখানে আমি ছাড়া কে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে? সুনীল-সন্দীপন দাঁড়িয়ে পড়লেন। অবাক হয়ে দেখলেন, সেই বাড়ির ভিতর থেকে মুখে দাড়ি, চোখে চশমা, গায়ে পাঞ্জাবি শক্তি বেরিয়ে এলেন। এইভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বন্ধুর সঙ্গে আর এক বন্ধুর মিলন ঘটিয়ে দিল। শক্তি-সুনীলকে নিয়ে অনেক গল্প ছড়িয়েছিল সে-সময়। তার কিছু সত্যি, কিছু-বা নিছক রটনা।
কবি শক্তির মধ্যে সবসময় যেন একটা বোহেমিয়ান ঘোড়া বাস করত। যা তাকে থিতু হতে দিত না। প্রায়ই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেন। তাঁর বিখ্যাত সব কবিতার জন্মরহস্য নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। কবি নিজে তাঁর জীবনভিত্তিক তথ্যচিত্রে নিজেই বলেছেন, ‘অবনী বাড়ি আছো’ কবিতা রচনার পিছনের গল্পকথা। মেদিনীপুরের হিজলিতে কবির দুই শিক্ষকবন্ধু থাকতেন। শক্তি একদিন সেখানে গিয়ে হাজির। গল্প কবিতায় আসর জমে উঠেছে। সেখানে দু’বোতল মহুয়া খেয়ে কবির বেশ নেশা হয়ে গেল। আচ্ছন্নতার ভিতর কবির মাথায় এল দুটো লাইন। একটা কাগজ-পেন জোগাড় করে কবি তখনই লিখে ফেললেন ‘অবনী বাড়ি আছো’-র মতো বিখ্যাত কবিতা। এ-প্রসঙ্গে কবি-বন্ধু আর এক বিখ্যাত কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি ‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে’, এই দীর্ঘ কবিতাটির জন্মবৃত্তান্ত। শক্তি প্রায়ই কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের জলপাইগুড়ির ভাড়াবাড়িতে যেতেন। কখনও মাসখানেক, কখনওবা দু’মাস থাকতেন। সেবারও গেছেন। তখন শীতকাল। এক সকালে অমিতাভ দাশগুপ্ত দেখলেন শক্তি চুপচাপ বসে আছেন বারান্দা লাগোয়া ছোট পড়ার ঘরটিতে। অল্প সময় পরে হঠাৎ টেবিলে ঝুঁকে পড়ে লিখতে শুরু করলেন। অনর্গল লিখে চললেন। সকাল পেরিয়ে বিকেল, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। স্নানাহার বন্ধ। শুধুই লেখা। রাত ন’টা নাগাদ হঠাৎ কবি অমিতাভ শুনতে পেলেন, বন্ধু শক্তি জোর গলায় তাঁকে ডাকছেন। কবি ঘরে গিয়ে দেখেন, সারা ঘরময় লেখার কাগজ ছড়িয়ে। তাঁকে দেখতে পেয়ে কবি শক্তি সেই কাগজগুলো কুড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে কবিতা পড়তে শুরু করলেন। সুদীর্ঘ একটা কবিতা। এত বড় দীর্ঘ কবিতা শক্তি আর জীবনে লেখেননি। পড়া শেষ করে উপরের পাতায় খসখস করে শিরোনাম লিখলেন, ‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে’। তারপর নির্জীব হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। এই ছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এক আত্মমগ্ন ও নিবেদিত প্রাণ কবি। অনির্বাণ পদ্যকার।
চিত্র: গুগল








One Response
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি সম্পাদক মণ্ডলীকে। রবীন বসু