অঁতনা আখতু
অনুবাদ: শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ
ক্যালিয়ারি এই ছোট্ট নগরটির মহাফেজখানায়, যা সার্দেইনাতে, একটি বিস্ময়কর ঐতিহাসিক তথ্যের বিবরণ আছে।
এপ্রিলের শেষে অথবা মে-র শুরুতে এক রাত্রে, ১৭২০-তে, গ্রাঁ-স্যান্ত-অঁতয়ার মাখসেইলাতে আগমনের কুড়ি দিন আগে, একটি জাহাজ যার বন্দরে আসা ওই নগরে প্লেগের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে, সেন-রেমিস, সার্দেইনার উপরাজন, যাঁর রাজকীয় কর্মের হ্রাস সম্ভবত তাঁকে সংবেদনশীল করে তুলেছিল সবচেয়ে ক্ষতিকর ভাইরাসে, খুবই কষ্টকর এক স্বপ্ন দেখেছিলেন: তিনি নিজেকে প্লেগে সংক্রমিত দেখেছিলেন যা তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন তাঁর সমগ্র ছোট্ট রাজ্যকে ধ্বংস করছে।
এমন আঘাতের ফলে, সমস্ত সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। শৃঙ্খলা ধসে যায়। তিনি নৈতিকতার সবরকমের লঙ্ঘন দেখলেন, সমস্ত মনস্তাত্ত্বিক দুর্যোগ; তিনি শুনতে পেলেন তাঁর সমস্ত শরীরের তরলগুলি তাঁর মধ্যে কলকল করছে; ছিন্ন, টিস্যুর মাথাঘোরানো অবস্থায় ধসে পড়ায়, তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ভারী হচ্ছে এবং আস্তে আস্তে কার্বনে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু এখন কি আঘাত থেকে সরতে খুব দেরি হয়ে গেছে? যদিও ধ্বংসপ্রাপ্ত, যদিও নিশ্চিহ্ন, জৈবিকভাবে বিচূর্ণ এবং তাঁর মজ্জা অবধি গ্রস্ত, তিনি জানেন আমরা স্বপ্নের মধ্যে মরে যাই না, আমাদের ইচ্ছাশক্তি কাজ করে এমনকী অর্থহীনতার মধ্যেও, এমনকী সম্ভাবনা বাতিলের মধ্যেও, এমনকী মিথ্যের রূপান্তরের মধ্যেও যার থেকে সত্যকে আবার তৈরি করা যায়।
তিনি জেগে ওঠেন। প্লেগ সম্বন্ধে সব গুজব, প্রাচ্য থেকে আসা এই ভাইরাসের পূতিবাষ্প:– তিনি জানবেন এখন কেমন করে দূরে সরিয়ে রাখা যায়।
গ্রাঁ-স্যাঁত-অতঁয়া, যা বেইরুট থেকে একমাসের পথ এসেছে, ক্যালিয়েরিতে নোঙর ফেলার অনুমতি চায়। উপরাজ একটি উন্মাদ আদেশে তার উত্তর দেন, একটি আদেশ যা দায়িত্বজ্ঞানহীন, অযৌক্তিক, বোকার মতো, এবং স্বেচ্ছাচারিতাসম্পন্ন বলে জনগণ ও তাঁর নিজের কর্মচারীদের মনে হয়েছিল। তিনি দ্রুততার সঙ্গে পাইলটের বোট এবং কিছু মানুষকে জাহাজে পাঠিয়ে দেন যা তিনি ধরেই নিয়েছিলেন দূষিত, সেই আদেশের সঙ্গে যে গ্রাঁ-স্যাঁত-অঁতয়া তৎক্ষণাৎ তার পথ পরিবর্তন করুক এবং নগর ছেড়ে সব পাল তুলে চলে যাক, নইলে কামানের গোলায় ডুবিয়ে দেবার হুমকি থাকে। প্লেগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। স্বৈরাচারী বিন্দুমাত্র সময়ও নষ্ট করতে রাজি ছিল না।
যে নির্দিষ্ট প্রভাবের শক্তি এই স্বপ্নটি তাঁর ওপর বিস্তার করেছিল তা সম্পর্কে যেতে যেতে কিছু মন্তব্য করা উচিত, যেহেতু এটা তাঁকে অনুমতি দিয়েছিল, জনতার ব্যঙ্গ এবং তাঁর অনুগামীদের সংশয়বাদ সত্ত্বেও, তাঁর আদেশের হিংস্রতা বজায় রাখার জন্য, শুধুমাত্র মানবাধিকারেই অনুপ্রবেশ নয়, মানুষের জীবনের প্রতি সহজ শ্রদ্ধাতেও এবং সমস্ত রকমের জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক নিয়মেও যা, মৃত্যুর সম্মুখে, কোনওভাবেই প্রাসঙ্গিক নয়।
যাই হোক না কেন, জাহাজটি তার পথে চলল, লেগহর্নে থামল, এবং মাখসেইলার রাস্তায় প্রবেশ করল যেখানে তাকে তার জিনিসপত্র নামানোর অনুমতি দেওয়া হল।
মাখসেইলার বন্দর কর্তৃপক্ষ প্লেগ-ভর্তি জাহাজের কী হল তার কোনও তথ্য রাখেননি। তার কর্মীদের কী হল তা কম বা বেশি জানা যায়; যারা প্লেগে মরেনি তারা নানান দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
গ্রাঁ-স্যান্ত-অঁতয়া মাখসেইলাতে প্লেগ আনেনি। তা ওখানে তখনই উপস্থিত ছিল। এবং পুনরায় প্রাদুর্ভাবের বিন্দুতে ছিল। কিন্তু এর কেন্দ্রগুলোকে সফলভাবে আঞ্চলিক করা গেছিল।
গ্রাঁ-স্যান্ত-অঁতয়া যে প্লেগ এনেছিল তা পূর্বের বা ওরিয়েন্টাল প্লেগ, আসল ভাইরাসটি, এবং এইটার এগোনো আর নগরে ছড়িয়ে পড়া থেকে প্লেগের নির্দিষ্টভাবে ভয়ংকর এবং সদূরপ্রসারিত বেধে যাওয়া শুরু হয়।
এইটা কিছু ভাবনার প্রেরণা দেয়।
এই প্লেগ, যা একটি ভাইরাসকে পুনরায় সক্রিয় করে তুলল বলে মনে হয়েছে, সে নিজেই সক্ষম ছিল সমানভাবে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করতে: সমস্ত কর্মীদের মধ্যে কেবল ক্যাপ্টেনকে প্লেগে ধরেনি; তাছাড়াও, এটাও মনে হয়নি যে, নতুন আসা শিকারেরা অন্যদের সঙ্গে কখনও সরাসরি সংস্পর্শে ছিল, তারা অতিনিকটে আটক থাকলেও। গ্রাঁ-স্যান্ত-অঁতয়া, যে ক্যালিয়েরির অত্যন্ত নিকট দিয়ে গেছিল, সার্দেইনাতে, সেখানে প্লেগ জমা করেনি, কিন্তু উপরাজ একটি স্বপ্ন থেকে কিছু নিঃসরণ পেলেন; যেহেতু এইটা অস্বীকার করা যায় না যে, উপরাজ এবং প্লেগের মধ্যে একটি বাস্তব যোগাযোগ, যতই সূক্ষ্ম হোক, স্থাপিত হয়েছিল: এবং এটা খুব সহজ এবং সহজ স্পর্শের মাধ্যমে এমন একটা রোগের সংক্রমণকে কিছু দিয়েই আটকে না-যাওয়াকে ব্যাখ্যা করে।
কিন্তু সেন-রেমিস এবং প্লেগের মধ্যে এই সম্পর্ক, তাঁর স্বপ্নের মধ্যে নিজেদের মুক্ত করার মতো শক্তিমান হলেও, তেমন শক্তিমান নয় যাতে তাঁকে রোগে আক্রান্ত করা যায়।
যাই হোক না কেন ক্যালিয়েরি নগর, কিছুকাল পর যখন জানল যে জাহাজটিকে তাদের তীর থেকে দূরে সরানো হয়েছে তাদের উপরাজের স্বেচ্ছাচারী ইচ্ছাতে, তাদের অলৌকিকভাবে প্রজ্ঞাবান উপরাজের, মাখসেইলাতে বিরাট মহামারির উৎসে ছিল, তারা এই তথ্য তাদের মহাফেজখানায় নথিভুক্ত করল, যেখানে আজ তাদের পাওয়া যায়।
১৭২০-র মাখসেইলার প্লেগ আমাদের জন্য শুধু আঘাতের তথাকথিত রোগলক্ষণ সংক্রান্ত বর্ণনা এনে দিয়েছে।
তথাপি ভেবে অবাক হতে হয় যদি মাখসেইলার ডাক্তারেরা যে প্লেগের বর্ণনা দিয়েছেন, তা যদি সত্যিই ১৩৪৭-এ ফ্লোরেন্সের প্লেগের মতন হত যা ডেকামেরনের জন্ম দিয়েছে। ইতিহাস, পবিত্র গ্রন্থগুলি, তারমধ্যে বাইবেল, কিছু প্রাচীন চিকিৎসা সংক্রান্ত শাস্ত্র সবরকমের প্লেগের বাইরে থেকে বর্ণনা দিয়েছে যেগুলোর ক্ষেত্রে তারা রোগসংক্রান্ত লক্ষণের দিকে খুব কম মনোযোগ দিয়েছে যতটা দিয়েছে শিকারের মনের মধ্যকার নীতিভ্রষ্ট করা এবং বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়ার ওপরে। সম্ভবত তারা ঠিকই করেছিল। কারণ চিকিৎসাবিদ্যার পক্ষে সিরাকিউসে পেরিক্লিসের মৃত্যু যে ভাইরাসে হয়েছে তার সঙ্গে মূলগত পার্থক্য প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সমস্যা হত, ‘ভাইরাস’ শব্দটি শুধুমাত্র বলার সুবিধের জন্য বলা না-ধরে নিলে, এবং হিপোক্রেটসের প্লেগ সংক্রান্ত বর্ণনায় যে ভাইরাসের প্রকাশ জানা যাচ্ছে তার, যাকে সাম্প্রতিক চিকিৎসা সংক্রান্ত তত্ত্ব মনে করে একধরনের ছদ্মপ্লেগ বলে। সেই একই শাস্ত্রগুলো অনুসারে, একমাত্র সত্যিকারের প্লেগ হল সেই প্লেগ যা ইজিপ্ট থেকে উঠে আসে যখন নীল নদ সরে গেলে কবরখানাগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। বাইবেল এবং হেরোডোটাস উভয়েই প্লেগের সেই বজ্রপাতের মতন আবির্ভাবের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যা একরাত্রিতে আসিরিয়ান সেনার ১,৮০,০০০ মানুষকে ধ্বংস করেছিল, তার দ্বারা ইজিপশিয়ান সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেছিল। যদি এই তথ্যটি সত্যি হয়, আমাদের বিবেচনা করা উচিত সেই আঘাতের একটি প্রত্যক্ষ অস্ত্র অথবা একটি বুদ্ধিমান শক্তির বাস্তবায়ন হিসেবে যা খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখে তার সঙ্গে যাকে আমরা নিয়তিগত অবস্থা বলি।
এবং এইটি ইঁদুরদের বাহিনী নিয়ে বা না-নিয়ে সেই রাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আসিরিয়ান বাহিনীর ওপর, যাদের চামড়ার বর্ম আর ঘোড়ার সাজসরঞ্জাম তারা দাঁতে ছিঁড়েছিল কয়েকঘণ্টার মধ্যে। এই তথ্যটি ৬৬০ বিসি-তে ছড়িয়ে পড়া সেই মহামারীর সঙ্গে তুলনাযোগ্য, যা ছড়িয়েছিল পবিত্র শহর মেকাও, জাপানে, কেবলমাত্র একটি সরকার পরিবর্তনের সাধারণ ঘটনার সময়।
প্রভেন্সের ১৫০২-এর প্লেগ, যা নস্ত্রাদামুসকে চিকিৎসক হিসেবে প্রথম সুযোগ দিয়েছিল, মিলিত হয়েছিল সবচেয়ে প্রগাঢ় রাজনৈতিক উত্থানপতনে, রাজাদের পতন অথবা মৃত্যুতে, প্রভিন্সের মুছে যাওয়া অথবা ধ্বংস হওয়ায়, ভূমিকম্প, সমস্ত রকমের চৌম্বকীয় ব্যাপারে, ইহুদিদের দলবদ্ধ প্রস্থানে, যা আগে ঘটেছিল অথবা অনুসরণ করেছিল, রাজনৈতিক অথবা মহাজাগতিক প্রণালীবদ্ধতার মধ্যে, প্রলয় এবং ধ্বংস যার ফলাফল, যারা তাকে উস্কেছিল তারা অত্যন্ত নির্বোধ ছিল আগে থেকে বুঝতে এবং যথেষ্ট বিকৃতরুচির ছিল না তা আসলেই চাইতে।
ঐতিহাসিক অথবা চিকিৎসকদের প্লেগ নিয়ে যাই ত্রুটি থাকুক না কেন, আমি বিশ্বাস করি আমরা একটি পীড়ার ধারণায় সম্মত হতে পারি যা হবে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক অস্তিত্ব এবং যা একটি ভাইরাস দ্বারা বাহিত হয় না। যদি কেউ খুব কাছ থেকে প্লেগ সংক্রমণের সব তথ্যকে বিশ্লেষণ করার ইচ্ছে করে যা ইতিহাস অথবা এমনকী স্মৃতিকথাও আমাদের দিয়েছে, এইটা খুব কঠিন হবে একটা সত্যিকারে স্পর্শ দ্বারা ঘটা সংক্রমণের ঘটনাকে প্রতিপাদিত করা, এবং বোকাচ্চিওর সেই শূকরটির উদাহরণ যে মরেছিল প্লেগের শিকারদের জড়ানোর আবরণদের শুঁকে খুব কমই বোঝায় শূকর এবং প্লেগের চরিতের মধ্যে অলৌকিক সম্বন্ধের বেশি কিছুকে, যা আবারও খুব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।
যদিও একটি আসল রোগাক্রান্ত কোনও অস্তিত্বের ধারণা নেই, তথাপি কিছু বিষয় আছে যে বিষয়ে মন আপাতভাবে সম্মত হতে পারে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাপারের চরিত্রায়ন বলে, এবং এটা মনে হয় যে, মন সম্মত হতে পারে প্লেগকে নিম্নলিখিত উপায়ে বর্ণনা করায়।
কোনও একটি স্পষ্ট শারীরিক অথবা মানসিক অস্বস্তির সূত্রপাতের আগে, শরীর লাল দাগগুলিতে ঢেকে যায়, যা শিকার আচমকাই লক্ষ্য করে যখন তা কালো হওয়ার দিকে যায়। শিকার খুব কম সময়েই শঙ্কিত হয় তার মাথা ফুটতে শুরু করার এবং পেড়ে ফেলার মত ভারী হওয়ার আগে, এবং সে মূর্ছিত হয়ে পড়ে। তারপরে তাকে এক ভয়ংকর ক্লান্তি গ্রাস করে, কেন্দ্রীভূত চৌম্বকীয়ভাবে শুষে নেবার ক্লান্তি, তার কণাগুলির বিভক্ত হবার এবং তাদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার দিকে চলার। তার উন্মত্ত হয়ে ওঠা শরীরের তরলপদার্থগুলো, অস্থির এবং পরস্পরের সঙ্গে মিশে যাওয়া, তার মাংসের মধ্যে দিয়ে যেন বন্যা বইয়ে দেয়। তার কণ্ঠনালি উঠে আসে, তার পেটের মধ্যেকার অবস্থা মনে হয় যেন তার দাঁতের পাটিগুলোর মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। তার নাড়ির চলন, যা একসময় নিজের ছায়ার মতন কমে আসে, নাড়ির একটি বাস্তবিকতা মাত্র, অন্য সময় ভেতরে জ্বরের ফুটন্ত অবস্থার পেছনে ছোটে, তার মনে বয়ে যাওয়া বিকারের সঙ্গে সুসঙ্গত, হৃৎপিণ্ডের দ্রুতগামী ধকধকের মতো বেজে ওঠে, যা ক্রমেই গাঢ় হয়, ভারী, চিৎকৃত; তার চোখগুলো, প্রথমে ফোলে, তারপরে চকচকে হয়; তার ফুলে ওঠা হাঁফানো ফুসফুস, প্রথমে সাদা, তারপরে লাল, তারপরে কালো, যেন পোড়া বা কাটা– সমস্তকিছু ঘোষণা করে একটি অভূতপূর্ব জৈবিক উত্থানের। শীঘ্রই শরীরে তরলগুলি, বজ্রপাত যেমন পৃথিবীতে লাঙলের দাগ রেখে যায়, লাভা যেমন ভূগর্ভস্থ শক্তিতে আচ্ছন্ন মিশ্রিত অবস্থায় থাকে, বেরিয়ে আসার জায়গা খোঁজে। সবচেয়ে জ্বলন্ত বিন্দুটি তৈরি হয় প্রত্যেক দাগের কেন্দ্রে; এই বিন্দুগুলিকে ঘিরে ত্বক ফোঁড়া হয়ে ওঠে যেন লাভার নিচে থাকা বাতাসের বুদ্বুদ্, এবং এই ফোঁড়াগুলি বৃত্তসকল দিয়ে ঘেরা, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বাইরেরটি, শনির চক্রের মতো প্রভমান গ্রহের চারিধারে, প্লেগ রোগের চূড়ান্ত সীমার দিকে নির্দেশ করে।
শরীর চামড়ার ভাঁজযুক্ত। কিন্তু আগ্নেয়গিরিদের যেমন পৃথিবীতে বাছাই করা জায়গা থাকে, তেমনই প্লেগের লক্ষণ তাদের পছন্দসই জায়গায় প্রকাশ ঘটায় মানবশরীরের ত্বকে। পায়ুদ্বারের চারপাশে, বগলে, সেই সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যেখানে কার্যকরী গ্ল্যান্ডগুলো বিশ্বস্তভাবে তাদের কাজ করে চলে, প্লেগের লক্ষণ দেখা দেয়, যেখানেই জীব তার অভ্যন্তরীণ পচনকে নির্গত করে অথবা, এই বিষয় অনুসারে, তার জীবনকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি ভয়ংকর জ্বলনের অনুভূতি, একটিমাত্র বিন্দুতে সীমাবদ্ধ, জানায় যে জীবটির জীবন তার কোনও শক্তিই হারিয়ে ফেলেনি এবং রোগের ভার লাঘব করা অথবা তার উপশমও সম্ভব। নিঃশব্দ ক্রোধের মতন, সবচেয়ে ভয়ংকর প্লেগ হল সেইটা যা তার লক্ষণগুলিকে প্রকাশ করে না।
প্লেগের শিকারের শবকে কাটাছেঁড়া করলে কোনও ক্ষতিই তাতে দেখা যায় না। গল ব্লাডার, যা অবশ্যই জীবের ভারী এবং স্থাবর বর্জ্যকে ছাঁকে, তা ভর্তি, ফেটে যাবার মতন ফুলে উঠেছে এক কালো, সান্দ্র তরলে যা এত ঘন যেন কোনও এক নতুন বস্তুর চেহারা বলে মনে হয়। ধমনী এবং শিরাতে থাকা রক্তও কালো এবং সান্দ্র। মাংস, পাথরের মতো শক্ত। পেটের মেমব্রেনের ভেতরের তলে, রক্তের অসংখ্য বের হওয়ার চিহ্ন দেখা দেয় বলে মনে হয়। সবকিছুই ইঙ্গিত করে নিঃসরণে একটি মৌলিক অব্যবস্থার। কিন্তু সেখানে কোনও ক্ষতি নেই অথবা ধ্বংস নেই বস্তুর, যেমন নাকি কুষ্ঠে বা সিফিলিসে হয়। অন্ত্রগুলোর নিজেরা, যারা সবচেয়ে রক্তাক্ত অব্যবস্থার স্থান, এবং যেখানে উপাদানগুলো পচন এবং অশ্মীভবনের অশ্রুতপূর্ব সীমায় গিয়ে পৌঁছোয়, জৈবিকভাবে আক্রান্ত হয় না। গলব্লাডার, যেখান থেকে শক্ত হওয়া পুঁজ প্রকৃতভাবে অবশ্যই ছিঁড়তে হয়, যেমন কিছু নরবলিতে, ধারালো একটি ছুরি দিয়ে, একটি শক্ত, কাচের মতো দেখতে আগ্নেয়শিলা দিয়ে তৈরি কাচের মত যন্ত্র– গলব্লাডারে এর উপাদান কোষ বৃদ্ধি পায় এবং কিছু জায়গায় ফাট ধরছে কিন্তু সম্পূর্ণ আছে, কোনও অঙ্গহীনতা নেই, কোনও দৃশ্যত ক্ষতি নেই, কোনও উপাদান হারায়নি।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যদিও, আহত ফুসফুস এবং মস্তিষ্ক কালো হয়ে যায় এবং পচনশীল ক্ষতযুক্ত হয়। নরম এবং ছোট ছোট গর্তযুক্ত হওয়া ফুসফুস কিছু অজানা কালো উপাদানের ছোট ছোট টুকরো হয়ে পড়ে– মস্তিষ্ক গলে যায়, সংকুচিত হয়, কয়লা-কালো ধুলোর মতো তা দানাদার হয়।
দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করা যায় এই তথ্যের বিষয়।
প্রথম হল প্লেগের লক্ষণ ফুসফুস অথবা মস্তিষ্কের পচনশীল ক্ষত ছাড়াই সম্পূর্ণ, এর শিকার কোনও অঙ্গের পচন ছাড়াই মরণোদ্যত হয়। রোগের প্রকৃতিকে খাটো না করেই, আমরা বলতে পারি যে, জীব একটি আঞ্চলিক শারীরিক পচনশীল ক্ষতের উপস্থিতির প্রয়োজন বোধ করে না নিজ মৃত্যুর জন্য।
দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণ হল দুটি মাত্র অঙ্গই প্লেগের দ্বারা আক্রান্ত এবং আহত হয়, মস্তিষ্ক এবং ফুসফুস, উভয়েই সচেতনতা এবং ইচ্ছার ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। আমরা আমাদের শ্বাস নেওয়া কিংবা চিন্তা করার থেকে বিরত রাখতে পারি, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসকে বাড়িয়ে দিতে পারি, আমরা যেমন ছন্দ চাই তেমন ছন্দ বাছতে পারি এর জন্য, আমাদের ইচ্ছেতে সচেতন বা অচেতন করতে পারি, দুই ধরনের শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে ভারসাম্য আনতে পারি: স্বয়ংক্রিয়, যা স্বতন্ত্র-স্নায়ুতন্ত্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে, এবং অন্যটি, তা মস্তিষ্কের প্রতিবর্তক্রিয়ার বিষয় যা আবারও সচেতন হয়ে উঠেছে।
একইভাবে আমরা বাড়াতে পারি, হ্রাস করতে পারি, এবং আমাদের চিন্তাকে যেমনখুশি ছন্দ দিতে পারি– মনের অচেতন খেলাকে নির্ধারণ করতে পারি। আমরা যকৃতে শরীরের তরলগুলির ছাঁকা অথবা হৃৎপিণ্ড এবং ধমনী দিয়ে, রক্তের পুনশ্চালনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, হজমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, অন্ত্র থেকে বস্তুর নিশ্চিহ্ন হওয়াকে থামাতে বা বাড়াতে পারি না। এইভাবে মনে হয় প্লেগ তার উপস্থিতিকে জানান দেয় এবং যেইসব অঙ্গগুলির প্রতি তার একটি পক্ষপাত আছে, সেইসব শারীরিক অঞ্চলগুলিতে, যেখানে মানবিক ইচ্ছা, চেতনা, এবং চিন্তা অনিবার্য এবং ঘটতে থাকা স্বাভাবিক।
১৮৮০ বা কাছাকাছি, একজন ইয়েরসা নামের ফরাসি ডাক্তার, কিছু ইন্দো-চীনা অধিবাসীর শবদেহ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যারা প্লেগে মারা গিয়েছিল, পৃথক করেছিলেন অনেকগুলোর মধ্যে একটি গোল মাথা, ছোট্ট লেজের ব্যাঙাচিকে যা কেবলমাত্র মাইক্রোস্কোপই বের করতে পারে এবং তাকে প্লেগের মাইক্রোব বলেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে, আমি এই মাইক্রোবকে মনে করি কেবলমাত্র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, বহু গুণ ক্ষুদ্র– মৌলিক পদার্থ যা ভাইরাসের কোনও এক সময়ের বিকাশে জন্মায়, কিন্তু যা কোনওভাবেই প্লেগের কারণ নয়।
এবং আমি চাইব যে, এই ডাক্তার আমাকে বলুন যে, কেন সব বিরাট প্লেগগুলোর, ভাইরাস সমেত বা ছাড়া, পাঁচমাসের সময়সীমা থাকে, যার পরে তাদের উগ্রতা কমে যায়, এবং কেমন করে তুর্কির রাষ্ট্রদূত যিনি লঙ্গেদক দিয়ে যাচ্ছিলেন ১৭২০-র শেষদিকে একটি রেখা টানতে সক্ষম হয়েছিলেন নিস্সা থেকে আভিনিও এবং টুলুইজো হয়ে বোর্ডো অবধি, আঘাতের একটি ভৌগোলিক সীমা চিহ্নিত করেছিলেন– একটি রেখা যাকে ঘটনাগুলো নিখুঁত প্রমাণিত করেছিল।
এইসব থেকে উদয় হয় একটি রোগের আধ্যাত্মিক দেহতত্ত্ব যার নিয়ম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করা যায় না এবং যার ভৌগোলিক উৎপত্তি নির্ধারণ করার কাজটা নির্বোধের মতন হবে, ইজিপশীয়দের জন্য প্লেগ প্রাচ্যের প্লেগ নয়, হিপোক্রেটস দ্বারা বর্ণিত যা তা নয়, সিরাকিউসেরও নয়, ফ্লোরেন্সেরও নয়, মধ্যযুগের ইউরোপে যে পাঁচ কোটি মানুষ ব্ল্যাক ডেথ-এ মারা গিয়েছিলেন তারও নয়। কেউ বলতে পারবে না কেন প্লেগ সেই সব ভীরুদের আক্রমণ করে যারা তার থেকে পালাতে চায় এবং সেই অধঃপতিতকে ছেড়ে দেয় যে শবদেহতে নিজের বাসনা নিবৃত্ত করে। কেন দূরত্ব, সতীত্ব, নির্জনতা এই আঘাতের বিরুদ্ধে অসহায়; এবং কেন একটি লম্পটের দল যারা নিজেদের গ্রামে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল, বোকাচ্চিও-র মতো তাঁর দুই সুসজ্জিত সঙ্গী এবং সাতজন যেমন কামাতুর তেমনই ধর্মনিষ্ঠ নারীকে নিয়ে, শান্তভাবে অপেক্ষা করতে পারেন সেই সব উষ্ণ দিনের যখন প্লেগ সরে যাবে; এবং কেন একটি কাছাকাছি প্রাসাদে যাকে দুর্গে পরিণত করা হয়েছিল সশস্ত্র পুরুষদের একটি ঘেরা দিয়ে সমস্ত প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে, প্লেগ গোটা গ্যারিসনটা এবং সমস্ত অধিবাসীদের শবদেহে পরিণত করেছিল এবং শুধুমাত্র সশস্ত্র পুরুষদের ছাড় দিয়েছিল যারা সংক্রমণের মুখেই ছিল। কে এরও ব্যাখ্যা দিতে পারে যে কেন সামরিক কদঁ স্যানিঠে যা মেহেমেট আলি গত শতকের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ইজিপশিয়ান প্লেগের প্রাদুর্ভাবে, কার্যকরীভাবে কনভেন্টগুলো, বিদ্যালয়গুলো, জেলখানাগুলো, এবং প্রাসাদদের রক্ষা করেছিল; এবং কেন অজস্র প্লেগের মহামারী প্রাচ্যদেশীয় প্লেগ বা ওরিয়েন্টাল প্লেগের সমস্ত চারিত্রিক লক্ষণ নিয়ে আচমকা মধ্যযুগের ইউরোপে এমন স্থানে প্রাদুর্ভূত হত যাদের প্রাচ্যের সঙ্গে কোনও সংযোগই ছিল না।
এই সব বৈশিষ্ট্য, এইসব রহস্যগুলো, এইসব দ্বন্দ্বগুলো এবং এইসব লক্ষণ থেকে আমাদের অবশ্যই একটি আধ্যাত্মিক দেহতত্ত্ব গঠন করে নিতে হবে যা ক্রমান্বয়ে জীবকে ধ্বংস করে এমন এক ব্যথার মত যা, যত গাঢ় এবং গভীর হয়, তার পুঁজিগুলোকে এবং সংবেদনের প্রত্যেক স্তরে আক্রমণকে গুণিতকে বাড়ায়।
কিন্তু এই আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা থেকে যার সঙ্গে প্লেগ বেড়ে ওঠে, ইঁদুরগুলো ছাড়া, মাইক্রোবগুলো ছাড়া, এবং কোনও সংস্পর্শ ছাড়া, একটি প্রদর্শনীর অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং পূর্ণ কার্যক্রমকে অনুমান করা যায় যা আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।
একবার নগরে প্লেগ ধরে গেলে, নিয়মিত সব পদ্ধতি ধসে পড়ে। রাস্তা এবং নালিদের কোনও দেখভাল হয় না, সৈন্য থাকে না, পুলিশ থাকে না, কোনও পৌর প্রশাসন থাকে না। মৃতদের পুড়িয়ে ফেলার জন্য যেমন তেমন চিতা জ্বালানো হয়, যা পাওয়া যায় তা দিয়েই। প্রত্যেক পরিবার নিজের একটা চিতা চায়। তখন কাঠ, জায়গা, এবং অগ্নিশিখাও দুর্লভ হয়ে ওঠে, চিতার ধারে পারিবারিক কলহ বেঁধে যায়, কিছুক্ষণেই একটি সাধারণ লড়াই লাগে, যেহেতু শবের সংখ্যাও অসংখ্য। মৃতরা ততক্ষণে রাস্তাগুলো বন্ধ করে ফেলেছে গলিত পিরামিড হয়ে গেছে যা পশুরা ধারের দিকে চিবোতে থাকে। দুর্গন্ধ বাতাসে অগ্নিশিখার মতো উত্থিত হয়। সমস্ত রাস্তাগুলো মৃতদের স্তূপে রুদ্ধ। তারপরে ঘরগুলো খুলে যায় এবং বিকারগ্রস্ত শিকারেরা, তাদের মনে ভিড় করে আছে ভয়াবহ দৃশ্য, রাস্তাগুলো দিয়ে আর্তনাদ ছড়িয়ে দেয়। রোগটি যা তাদের ভিসেরাতে গেঁজিয়ে ওঠে এবং তাদের সমগ্র অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে তার নিঃসরণ ঘটায় সাঙ্ঘাতিক মস্তিষ্ক-সংক্রান্ত বিস্ফোরণে। অন্য শিকারেরা, বুবো বা প্লেগের লিম্ফ নোডের প্রদাহজনক ফোলা ছাড়া, প্রলাপ, যন্ত্রণা, অথবা ফুসকুড়ি ছাড়া, নিজেদের গর্বিতভাবে আয়নায় পরীক্ষা করে দেখে, দারুণ সুস্বাস্থ্যে আছে, এমনটাই তারা ভাবে, এবং তারপরে মরে পড়ে যায় তাদের দাড়িকামানোর মগটি হাতে নিয়েই, অন্য শিকারদের প্রতি অবজ্ঞা নিয়েই।
বিষাক্ত, ঘন, রক্তাক্ত ধারাদের (যন্ত্রণা এবং আফিমের রং) ওপর দিয়ে যা নিঃসৃত হয় শবদেহগুলো থেকে, আশ্চর্য লোকজন চলে যায়, মোমের পোশাক পরা, সসেজের মতন লম্বা নাক এবং কাচের মতন চোখগুলো, জাপানি চটির মতন বস্তুতে চড়ে যা দুটি কাঠের ট্যাবলেট দিয়ে তৈরি, একটি অনুভূমিক, সুকতলার মতন অনেকটা, অন্যটি উল্লম্ব, সংক্রামিত তরলদের থেকে তাদের দূরে রাখতে, আজব খ্রিষ্টীয় মন্ত্রগীতি গাইতে গাইতে যা তাদের তাদের সময়ে চুল্লিতে প্রবেশ থেকে নিবারণ করতে পারে না আসলে। এই অজ্ঞ ডাক্তাররা শুধুমাত্র নিজেদের ভয় এবং শিশুসুলভতাকে প্রতারণা করে।
জনসংখ্যার তলানি অংশটা, আপাতভাবে তাদের উন্মত্ত লোভের দ্বারা যেন আপাতভাবে টিকাকৃত, খোলা বাড়িগুলোতে প্রবেশ করে এবং তাদের চেনা ধনীদের লুঠ করে যা কোনও উদ্দেশ্য সিদ্ধ করবে না বা লাভ ঘটাবে না। এবং ঠিক সেই সময় থিয়েটারের জন্ম হয়। থিয়েটার, যা হল, একটি তাৎক্ষণিক অহেতুকতা যা কিছু ক্রিয়াকে উস্কে দেয় যা কোনও উদ্দেশ্য সিদ্ধি বা লাভ ছাড়া।
জীবিতদের মধ্যে শেষাংশটি একটি উন্মত্ততায় বাঁচে: বাধ্য এবং উন্নত চরিত্রের পুত্র পিতাকে হত্যা করে; সৎ চরিত্রবান পুরুষেরা পশ্বাচার প্রয়োগ করে তার প্রতিবেশীর ওপর। লম্পট শুদ্ধ হয়ে ওঠে। কৃপণ তার সোনা মুঠি ভরে ছুড়ে দেয় জানালার বাইরে। যোদ্ধা নায়ক সেই নগরে আগুন ধরিয়ে দেয় যে নগর রক্ষা করতে একদা সে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিল। ফুলবাবুটি নিজেকে সবচেয়ে ভাল পোশাকে সজ্জিত করে এবং মৃতদেহ সংরক্ষিত বাড়ির বাইরে বেরিয়ে বেড়ায়। নিষেধাজ্ঞা না থাকার কিংবা আসন্ন মৃত্যুর ধারণা না-থাকা সেই কাজেদের অনুপ্রাণিত করতে যথেষ্ট হয় যা অযৌক্তিকভাবে অদ্ভুত সেই সব মানুষদের পক্ষে যারা বিশ্বাসই করেনি মৃত্যু কোনও কিছুকে শেষ করে দিতে পারে। এবং কেমন করে কামজ্বরের উত্থানকে ব্যাখ্যা করা যায় যা সুস্থ হয়ে আসা শিকারদের মধ্যে আসে যারা, নগর ছেড়ে না-পালিয়ে, যেখানে ছিল সেখানেই থাকে, অপরাধীসুলভ আনন্দ মোচড় দিয়ে নিতে চায় মুমূর্ষুদের অথবা এমনকী মৃতদের থেকেও, যারা শবেদের নিচে আদ্ধেক থ্যাঁতলানো যেখানে পরিস্থিতি তাদের এনে ফেলেছে।
কিন্তু যদি একটি বিপুল আঘাতের প্রয়োজন হয় এই উন্মত্ত অযৌক্তিকতাকে দৃশ্যমান করতে, এবং যদি এই আঘাতকে প্লেগ বলা হয়, তাহলে সম্ভবত আমরা নির্ধারণ করতে পারি এই অযৌক্তিকতার মানের আমাদের সামগ্রিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে। সেই শিকারের অবস্থা যিনি কোনও বস্তুগত ধ্বংস ছাড়াই মারা গেলেন, একটি পরম এবং প্রায় অ্যাবস্ট্রাক্ট রোগের কলঙ্ক নিজের ওপর নিয়ে, সেই অভিনেতার অবস্থার সঙ্গে এ একইরকম যিনি অনুভূতি দ্বারা সম্পূর্ণ গ্রস্ত যা তাঁর আসল অবস্থাতে লাভ ঘটায় না অথবা তার সঙ্গে সম্পর্কিতও নয়। অভিনেতার শারীরিক বৈশিষ্ট্যের সবকিছু, প্লেগের শিকারের মতোই, দেখায় জীবন আকস্মিক প্রচণ্ড আক্রমণের প্রতিক্রিয়া দিয়েছে, এবং তথাপি কিছুই হয়নি।
প্লেগের শিকার যে তার দর্শনের চিৎকৃত পশ্চাদ্ধাবনে চলেছে তার এবং অভিনেতাটি যে তার অনুভূতির পেছনে চলেছে তাদের মধ্যে; সেই মানুষটি যে নিজের সত্ত্বাগুলি আবিষ্কার করে যা সে প্লেগ ছাড়া কিছুতেই পেতে পারত না, তাদের সৃষ্টি করে শবরূপী এবং প্রলাপাশ্রয়ী উন্মাদদের দর্শনের সামনে এবং কবিটি যে অপ্রাসঙ্গিকভাবে চরিত্রদের আবিষ্কার করে, সঁপে দেয় সেই জনতার কাছে যারা সমানভাবেই জড় অথবা উন্মত্ত, এছাড়াও অন্যান্য উপমারা আছে যা নিশ্চিত করে একটিমাত্র সত্য যার মূল্য আছে এবং থিয়েটারের ক্রিয়াকে চিহ্নিত করে প্লেগের মতোই একটি প্রকৃত প্রাদুর্ভাবের স্তরে।
কিন্তু প্লেগের ইমেজদের মতন, যা শারীরিক বিশৃঙ্খলার একটি শক্তিশালী অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে উপস্থিত হয়, আধ্যাত্মিক শক্তিদের শেষ গোলাগুলির মতন যা নিজেই ক্লান্তিকর, কাব্যের ইমেজগুলি থিয়েটারে হল একটি আধ্যাত্মিক শক্তি যা তার গতিপথ শুরু করে অনুভূতিদের মধ্যে এবং তা বাস্তবতা সম্পূর্ণ বাদ দিয়েই করে। নিজের ক্রিয়ার প্রতি উন্মত্ততা থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে, একজন অভিনেতার প্রয়োজন হয় আরও অসীম শক্তির একটি অপরাধ করা থেকে রক্ষা পেতে যা একজন খুনির নিজের কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় সাহসের চেয়ে বেশি, এবং এটি এখানে উপস্থিত, এর আত্যন্তিক অযৌক্তিকতার মধ্যে, এই যে একটি অনুভূতির ক্রিয়া এবং ফলাফল মনে হয় অসীম অবধি ন্যায্য সেই অনুভূতির চেয়ে যা জীবনে পরিপূর্ণ হলে হয়।
খুনির উন্মত্ততা যা নিজেকে ক্ষইয়ে গেলে তার সঙ্গে তুলনা করলে, একজন ট্র্যাজিক অভিনেতা একটি নিখুঁত বৃত্তে ঘেরা থাকে। খুনির উন্মত্ততা একটি কাজ শেষ করেছে, নিজের নিঃসরণ ঘটিয়েছে এবং সেই শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়েছে যা তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল কিন্তু এখন তাকে আর ধরে রাখতে পারছে না। অভিনেতার ক্ষেত্রে উন্মত্ততা একটি চেহারা নিয়ে নিয়েছে যা নিজেকে সেই বিন্দু অবধি নস্যাৎ করে যেখান অবধি এটি নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছে এবং বৈশ্বিকতার মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।
প্লেগের আধ্যাত্মিক ইমেজকে বাড়ালে, আমরা বুঝতে পারি শিকারের সমস্যাগ্রস্ত শরীরের তরলদের কথাকে একটি বিশৃঙ্খলার বস্তুগত চেহারা বলে যা, অন্য প্রেক্ষিতে, দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ, আকস্মিক বিপর্যয় এবং পতনদের সমান যা আমাদের জীবনগুলো পেয়ে থাকে। এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে এইটাও অসম্ভব নয় যে উন্মত্ততাগ্রস্ত নিষ্ফল হতাশার আর্তনাদ একটি মানসিক সহায়তা কেন্দ্রে প্লেগ ঘটাতে পারে অনুভূতিদের এবং ইমেজদের কোনও একধরনের বিপরীতমুখিতার মাধ্যমে, কেউ একথাও একইভাবে স্বীকার করতে পারে যে, বাইরের ঘটনাগুলো, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, প্রাকৃতিক আকস্মিক বিপর্যয়, বিপ্লবের শৃঙ্খলা এবং যুদ্ধের বিশৃঙ্খলা, থিয়েটারের প্রেক্ষিতে ঘটে, দর্শকদের সংবেদনশীলতায় নিজেদের নিঃসরণ ঘটায় মহামারীর সমস্ত শক্তি নিয়েই।
সিটি অফ গড-এ সন্ত অগাস্টিন অভিযোগ করেছেন, প্লেগের ক্রিয়া যা অঙ্গদের ধ্বংস না করে হত্যা করে এবং থিয়েটারের এই সাদৃশ্যের যা, না হত্যা করেই, সবচাইতে রহস্যজনক মানসিক পরিবর্তন উস্কে দেয় শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির নয় বরং একটি গোটা জনতার।
‘জানো’, তিনি বলছেন, ‘তোমরা যারা অজ্ঞ, যে এই নাটকগুলো, পাপজনক প্রদর্শনী, রোমে মানুষদের পাপে স্থাপিত হয়নি বরং তোমাদের দেবতাদের আদেশে হয়েছিল। এইসব দেবতাদের দৈবী সম্মান দেবার চাইতে অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য স্কিপিওকে (স্কিপিও নাসিক, রোমের গ্র্যান্ড পন্টিফ, যিনি আদেশ দিয়েছিলেন রোমান থিয়েটারগুলিকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে এবং তাদের সেলারগুলিকে মাটি দিয়ে ভর্তি করে দিতে) সম্মান জানানো; নিশ্চিতভাবেই, তারা তাদের পন্টিফের যোগ্য ছিল না!…’
‘প্লেগকে সন্তুষ্ট করতে যা শরীরকে হত্যা করে, তোমাদের দেবতারা আদেশ দিয়েছিলেন তাঁদের সম্মানে এই নাটকগুলি করার, এবং তোমাদের পন্টিফ, যে প্লেগ আত্মাকে দূষিত করে তাকে এড়াতে, মঞ্চ তৈরিরই বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন। যদি তোমাদের মধ্যে এখনও বুদ্ধিমত্তা যথেষ্ট পরিমাণে থাকে আত্মাকে শরীরের চাইতে বেশি পছন্দ করার, তাহলে বাছো কোনটা তোমাদের শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য; কারণ শয়তানি প্রেতদের কৌশল হল, শরীরেই সংক্রমণ শেষ হয়ে যাবে আগেই দেখতে পেয়ে, আনন্দের সঙ্গে এই উপলক্ষকে দখল করে আরও বিপজ্জনক আঘাত তোমাদের মধ্যে নামিয়ে আনার, সেইটি যা শরীরকে নয় প্রথাকে আক্রমণ করে। বস্তুত, এমনই অন্ধত্ব, এমনই দুর্নীতি আত্মার মধ্যে তৈরি হয়েছে নাটকে যে, এই শেষ সময়েও যাদের এই বিধ্বংসী আবেগগ্রস্ত করেছে, যারা রোম লুণ্ঠন থেকে পালাতে পেরেছে এবং কার্থেজে আশ্রয় নিয়েছে, প্রতিদিন থিয়েটারে ব্যয় করে নিজেদের গর্বিত বোধ করে অভিনেতাদের জন্য উন্মত্ত উদ্দীপনায়।’
এই সংক্রামক উন্মত্ততার নির্দিষ্ট যুক্তি দেওয়া অর্থহীন। এইটা অনেকটা সেই কারণ খোঁজার মতো হবে যে, কেন আমাদের স্নায়ুতন্ত্র কিছু সময় পর সূক্ষ্ম সুরের কম্পনগুলিতে সাড়া দেয় এবং ঘটনাক্রমে যেমন করেই হোক তাদের দ্বারা চিরস্থায়ীভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রথমত আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, থিয়েটার, প্লেগের মতোই, একটি উন্মত্ততা এবং যোগাযোগক্ষম।
মন যা দেখে তা বিশ্বাস করে এবং যা বিশ্বাস করে তা করে: এটাই মুগ্ধতার গোপন কথা। সন্ত অগাস্টিনের টেক্সট এক মুহূর্তের জন্যও এই মুগ্ধতার বাস্তবতাকে প্রশ্ন করে না।
যদিও, কিছু শর্ত আছে যা পুনরাবিষ্কার করতে হয় মনের মধ্যে মনকে মুগ্ধ করার মতো একটি দৃশ্য উৎপন্ন করতে: এবং এটি সামান্য শিল্পের বিষয় নয়।
যদি থিয়েটার প্লেগের মতো হয়, তা এই কারণে শুধু নয় যে, এটি গুরুত্বপূর্ণ সমবায়িকতাতে প্রভাব ফেলে এবং তাদের একইরকমভাবে বিপর্যস্ত করে। থিয়েটারে প্লেগের মতোই এমন কিছু আছে যা উভয়তই বিজয়ী এবং প্রতিশোধপ্রবণ: আমরা সচেতন যে প্লেগ যেমন স্বতঃস্ফূর্ত অগ্নিকাণ্ড তৈরি করে যেখান দিয়ে সে যায় সেখানে তা অত্যন্ত বিশাল আকারের ব্যবসা গুটিয়ে গেলে ধার শোধের পরিস্থিতির মতন ছাড়া আর কিছু নয়।
একটি সামাজিক দুর্যোগ যা বহুদূরগামী, একটি জৈব বিশৃঙ্খলা যা অত্যন্ত রহস্যজনক– পাপের এই উপচে পড়া, এই সামগ্রিক ভূত তাড়ানোর প্রক্রিয়া যা চাপ দেয় এবং আত্মাকে বাধ্য করে তার সর্বোচ্চ অবস্থা অবধি– সমস্তটাই সেই অবস্থার উপস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে যা তৎসত্ত্বেও চূড়ান্ত শক্তিমত্তা দ্বারা প্রকাশিত এবং যার মধ্যে প্রকৃতির সব শক্তিকে টাটকাভাবে আবিষ্কার করা যায় সেই মুহূর্তে যখন কোনওকিছু অত্যাবশ্যককে লাভ করার সময়।
প্লেগ সেইসব ইমেজগুলি নেয় যারা সুপ্ত, একটি সুপ্ত ব্যাধি, এবং অকস্মাৎ তাদেরকে সবচেয়ে চূড়ান্ত অঙ্গভঙ্গিমায় বাড়িয়ে তোলে; থিয়েটারও অঙ্গভঙ্গিমাকে নেয় এবং তারা যতদূর যেতে পারে ততদূর ঠেলে: প্লেগের মতোই এও যা হয় এবং যা হয় না তাদের মধ্যে শৃঙ্খল পুনর্গঠন করে, সম্ভাব্যতার বাস্তবিকতার এবং যা বস্তুগত প্রকৃতিতে উপস্থিত আছে তাদের মধ্যেও। চিহ্নদের ধারণাগুলিকে এ পুনরুদ্ধার করে এবং আর্কিটাইপদের যা নিঃশব্দ আঘাতের মতো কাজ করে, বিশ্রাম নেয়, হৃদয় আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, লসিকার আহ্বান, উত্তেজক ইমেজগুলিকে আমাদের আচমকা দুর্বল হওয়া মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেয়। থিয়েটার আমাদের পুনরুজ্জীবিত করে আমাদের সুপ্ত দ্বন্দ্বদের মতো করে এবং তাদের সমস্ত শক্তিতে, এবং সেই শক্তিদের নাম দেয় যাদের আমরা সাদরে চিহ্নগুলি বলে থাকি: এবং দেখো! আমাদের চোখের সামনে চিহ্নদের যুদ্ধ হচ্ছে, একটি আর-একটির বিরুদ্ধে ধেয়ে যাচ্ছে এক অসম্ভব দাঙ্গায়; কারণ থিয়েটার সেখানে হয় শুধু সেই মুহূর্ত থেকে যখন সত্যিই অসম্ভব শুরু হয় এবং যখন কাব্য যা মঞ্চে উপস্থিত হয়েছে ধরে রাখে এবং চিহ্নদের অতি-উত্তপ্ত করতে থাকে।
এই চিহ্নগুলি, পাকা ক্ষমতাদের চিহ্ন আগে দাসত্বে আবদ্ধ থাকত এবং বাস্তবতায় অনুপলব্ধ থাকত, অবিশ্বাস্য ইমেজেদের বেশে বিস্ফোরিত হল যা নগরে স্বাধীনতা দিল এবং অস্তিত্ব দিল সেই সব কর্মের যা প্রকৃতিগতভাবে সমাজদের জীবনযাত্রার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন।
সত্যিকারের থিয়েটারে একটি নাটক ইন্দ্রিয়দের শান্তি নষ্ট করে, অবদমিত অচেতনকে মুক্ত করে, একটি বাস্তবিক না হলেও কার্যত বিদ্রোহকে উস্কে দেয় (যা শুধুমাত্র তার সম্পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে পারে যদি তা বাস্তবিক না হয়েই কার্যত থাকে তাহলে), এবং জড়ো হওয়া সমবায়ের মধ্যে এমন একটি মনোভাব তৈরি করে যা মুশকিলের এবং নায়কোচিত।
এইভাবে ফোর্ডের ‘Tis Pity She’s a Whore’-এ, যখন থেকে পর্দা উঠেছে, আমরা দেখি আমাদের চূড়ান্ত হতবাক হওয়ায় যে, একটি জীব ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে অজাচারের সমর্থনে নিজেকে প্রক্ষিপ্ত করে, তার তরুণ চৈতন্যের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে এই ঘোষণা করতে এবং একে ন্যায্য প্রমাণ করতে।
সে একমুহূর্তও দোদুল্যমান থাকে না, একমুহূর্তও সংশয়িত হয় না, এবং এভাবে দেখায় যে, সমস্ত বাধা কত ছোট্ট তার কাছে যা তার বিরোধ করতে পারে। সে নায়কোচিতভাবে অপরাধী এবং স্পর্ধিতভাবে, দাম্ভিকভাবে নায়কোচিত। সমস্তকিছু তাকে এইদিকে ঠেলে দেয় এবং তার উদ্দীপনাকে প্রজ্জ্বলিত করে; সে মর্ত্য অথবা স্বর্গকে চিনতে চায় না, শুধু তার আক্ষেপ-পীড়িত আবেগকে চেনে, যার প্রতি বিদ্রোহী এবং সমান নায়িকাচিত অ্যানাবেলা সাড়া দিতে ব্যর্থ হয় না।
‘আমি কাঁদি’, সে বলে, ‘অনুশোচনায় নয় বরং ভয়ে যে আমি আমার আবেগকে তৃপ্ত করতে পারব না।’ তারা দুজনেই জালিয়াত, ভণ্ড এবং মিথ্যাবাদী তাদের অতিমানবিক আবেগের জন্য যাকে আইন বাধা দেয় এবং নিন্দা করে কিন্তু যাকে তারা আইনের উপরে স্থাপন করবে।
প্রতিহিংসার জন্য প্রতিহিংসা, অপরাধের জন্য অপরাধ। যখন আমরা বিশ্বাস করি তাদের ভয় দেখানো হয়েছে, শিকার করা হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে তারা, যখন আমরা তাদের শিকার হিসেবে করুণা করার জন্য তৈরি, তখন তারা নিজেদের নিয়তিকে ভয়ের বিরুদ্ধে ভয় এবং ধাক্কার বিরুদ্ধে ধাক্কা দেবার চেহারায় প্রকাশ করে।
তাদের সঙ্গে আমরা এগোই বাড়াবাড়ি থেকে বাড়াবাড়িতে এবং সত্যায়ন থেকে সত্যায়নে। অ্যানাবেলা ধরা পড়ে, পরকীয়া এবং অজাচারের জন্য বন্দি হয়, তাকে থ্যাঁতলানো হয়, অপমান করা হয়, চুল ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং আমরা আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করি যে, পালানো দূরের কথা, সে তার দণ্ডাজ্ঞাপ্রদানকারীকে আরও বেশি উস্কে দেয় এবং অবাধ্য নায়িকাচিতভাবে গেয়ে ওঠে। এইটা বিদ্রোহের পরিপূর্ণ রূপ, এইটা প্রেমের উদাহরণজনক বিষয় যা দম না নিতে দিয়ে আমাদের বাধ্য করে, দর্শকদের, এই ধারণার মনস্তাপে খাবি খেতে যে কিছুই কোনওদিনও একে থামাতে পারবে না।
যদি আমরা বিদ্রোহে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার উদাহরণ চাই, ফোর্ডের অ্যানাবেলা আমাদের এই কাব্যিক উদাহরণ দেয় যা পরিপূর্ণ বিপদের ইমেজের সঙ্গে সংযুক্ত।
এবং যখন আমরা আমাদের বলি যে, আমরা ভয়াবহতার, রক্তের, এবং আইন ভাঙার, এবং যে কাব্য বিদ্রোহকে পবিত্র বলে তার আকস্মিক প্রচণ্ড আক্রমণের শীর্ষে পৌঁছেছি আমরা বাধ্য তখন অন্তহীন মাথা ঘোরার দিকে আরও এগোতে।
কিন্তু শেষত, আমরা আমাদের বলি, প্রতিহিংসা আছে, অমন স্পর্ধার এবং অমন অপ্রতিরোধ্য অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড আছে।
কিন্তু এমন কিছুই নেই। জিওভান্নি, প্রেমিকটি, একজন মহৎ কবির আবেগ দ্বারা উদ্দীপ্ত, নিজেকে প্রতিহিংসার আয়ত্তের বাইরে নিয়ে যায়, অপরাধের বাইরে, আর-একটি অপরাধের দ্বারা, এমন একটি যার আবেগ বর্ণনা করাই অসম্ভব; ভীতিপ্রদর্শনের বাইরে, ভয়াবহতার বাইরে আরও এক বেশিমাপের ভয়াবহতায়, যাকে সে ছুড়ে দেয় আর-একজনের প্রতি এবং একই সময়ে আইন, নৈতিকতা, এবং সেই সব যা নিজেদের ন্যায়ের প্রশাসক হিসেবে উপস্থিত করতে চায় তাদের প্রতি।
বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে একটি ফাঁদ পাতা হয়েছে, একটি বিরাট ভোজসভার আয়োজন হয়েছে যেখানে, অতিথিদের মধ্যে, ভাড়া করা গুন্ডা এবং চরেরা লুকোনো, প্রথম সংকেতেই তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত তারা। কিন্তু এই নায়ক, কোণঠাসা, পরাজিত, এবং প্রেম দ্বারা উদ্দীপিত, কাউকে এই প্রেমের বিষয়ে বিচার জানাতে দেবে না।
তোমরা চাও, সে যেন বলছে বলে মনে হয়, আমার প্রেমের মাংস এবং রক্ত। বেশ তো, আমি এই প্রেমকে তোমাদের মুখে ছুড়ে মারব এবং তোমাদের তার রক্তে স্নান করাব– কারণ তোমরা এর উচ্চতায় পৌঁছোনোর অনুপযুক্ত!
এবং সে তার প্রিয়াকে হত্যা করে এবং তার হৃৎপিণ্ড উপড়ে বের করে যেন ভোজসভার মধ্যে তা খেয়ে উৎসব করতে যেখানে সে নিজেই ছিল সেইজন যাকে অতিথিরা ভক্ষণ করবে বলে আশা করেছিল।
এবং খুন হবার আগে, সে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করে উঠতে পারে, তার বোনের স্বামীকে, যে তার এবং তার প্রেমের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়াবার সাহস করেছিল, এবং তাকে শেষ যুদ্ধে প্রেরণ করে যা তখন হয়ে দাঁড়ায় তার নিজের যন্ত্রণার খিঁচুনি।
প্লেগের মতোই, থিয়েটারও শক্তিদের দুর্দান্ত আহ্বান যা মনকে তাড়না করে উদাহরণ সহযোগে দ্বন্দ্বের মূলে পৌঁছোতে। এবং এটা স্পষ্ট যে ফোর্ডের আবেগগত উদাহরণ স্রেফ আরও বড় এবং আবশ্যকভাবে জরুরি কাজের সংকেত।
মন্দের ভীতিজনক যে অনুপ্রেরণা এলেউসিসের রহস্যে প্রযোজিত হয় তার পরিশুদ্ধ, সত্যিকারের প্রকাশিত চেহারায় তা মেলে বিশেষ কিছু প্রাচীন ট্র্যাজেডিদের অন্ধকার সময়ের সঙ্গে যা সব সত্যিকারের থিয়েটারকে পুনরুদ্ধার করতে হয়।
যদি অপরিহার্য থিয়েটার প্লেগের মতো হয়, তা এই কারণে নয় যে এটি সংক্রামক, বরং এইজন্য যে প্লেগের মত এটি উদ্ঘাটন, সামনে এগিয়ে আনা, সুপ্ত নিষ্ঠুরতার গভীরতার বহিঃকরণ যার দ্বারা মনের সকল বিকৃত সম্ভাবনার, সে একজন ব্যক্তির হোক কিংবা এক জনতার, স্থানীকরণ ঘটে।
প্লেগের মতোই থিয়েটার হল মন্দের সময়, অন্ধ শক্তিদের বিজয় যা পুষ্ট হয় একটি শক্তির দ্বারা যা আরও প্রগাঢ় বিলুপ্ত না-হওয়া অবধি।
প্লেগের মতোই থিয়েটারে এক আশ্চর্য সূর্যের মতো আছে, অস্বাভাবিক তীব্রতার একটি আলো যার দ্বারা এটা মনে হয় যে কঠিন এবং এমনকি অসম্ভবও আচমকাই আমাদের স্বাভাবিক বিষয় হয়ে যায়। এবং ফোর্ডের নাটক, সমস্ত সত্যিকারের নাটকের মতো, এই আশ্চর্য সূর্যের তেজের মধ্যে পড়ে। তার অ্যানাবেলা প্লেগের স্বাধীনতা সদৃশ যার ব্যবহারের দ্বারা, ডিগ্রি থেকে ডিগ্রিতে, ধাপ থেকে ধাপে, শিকার তার ব্যক্তিত্বকে ফুলিয়ে তোলে এবং বেঁচে থাকা মানুষ ক্রমশ আড়ম্বরপূর্ণ এবং দুর্বার সত্ত্বা হয়ে ওঠে।
আমরা এখন বলতে পারি, সমস্ত সত্যিকারের স্বাধীনতা হল অন্ধকারাচ্ছন্ন, এবং অমোঘভাবে যৌন-স্বাধীনতার সঙ্গে এক যা নিজেও অন্ধকারাচ্ছন্ন, যদিও আমরা সঠিকভাবে জানি না কেন। কারণ প্লাটোনিক ইরোস থেকে দীর্ঘসময় চলে গেছে, প্রজননশীল চেতনা, জীবনের স্বাধীনতা মিলিয়ে গিয়েছে লিবিডোর নিদারুণ বাহ্যাবরণে যা যা কিছু নোংরা, পতিত, বেঁচে থাকার পদ্ধতিতে কুখ্যাত তার সঙ্গে চিহ্নিত এবং নিজেকে হঠকারীর মতো ছুড়ে দেওয়ার একটি প্রাকৃতিক এবং অশুচি শক্তির দ্বারা, অবিরামভাবে পুনর্গঠিত শক্তিতে, জীবনের ওপর।
এবং এই কারণে সব মহান মিথেরা অন্ধকারাচ্ছন্ন, যাতে কেউ কল্পনা করতে না পারে, কেবলমাত্র গণহত্যা, অত্যাচার, এবং রক্তপাতের পরিবেশ ছাড়া, সমস্ত দুর্দান্ত রূপকথাদের বহু মানুষের কাছে পুনরায় যারা মনে করায় প্রথম যৌন-পার্থক্য এবং অনুভূতিদের প্রথম গণহত্যার যা সৃষ্টিতে জন্মেছিল।
থিয়েটার, প্লেগের মতনই, এই গণহত্যার ইমেজে এবং তার পৃথকীকরণে উপস্থিত। এটি দ্বন্দ্বকে মুক্ত করে, ক্ষমতাদের বিচ্ছিন্ন করে, সম্ভাবনাদের মুক্ত করে, এবং যদি এই সম্ভাবনাগুলো এবং ক্ষমতাগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়, এটি প্লেগের ত্রুটি নয় অথবা থিয়েটারেরও ত্রুটি নয়, জীবনের ত্রুটি।
আমরা জীবন যেমন তেমন করে তাকে দেখি না এবং যেভাবে একে আমাদের জন্য তৈরি করা হয় তা উল্লাসের বহু কারণ দেয়। প্লেগের দ্বারা এটি আবির্ভূত হয়, একটি বিরাটাকার ফোঁড়া, যেমন নৈতিক তেমনই সামাজিক, যৌথভাবেই তা শূন্য করা হয়; এবং প্লেগের মতনই, থিয়েটারও যৌথভাবে ফোঁড়াগুলিকে ফাটিয়ে বইয়ে দেবার জন্য সৃজিত।
হয়তো থিয়েটারের বিষ, সামাজিক শরীরে সূচিপ্রয়োগ করিয়ে, একে ভাঙে, যেমন সন্ত অগাস্টাইন বলেন, কিন্তু অন্তত এ প্লেগের মতো করেই তা করে, একটি প্রতিশোধাকাঙ্ক্ষী আঘাতের মতো করে, একটি ক্ষতিপূরক মহামারী যার মধ্যে সহজবিশ্বাসী যুগেরা ঈশ্বরের অঙ্গুলি দেখা বেছে নেয় এবং যা প্রকৃতির নিয়ম ছাড়া কিছুই নয় যার দ্বারা প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিমা প্রতিভাসিত হয় অঙ্গভঙ্গি দ্বারা এবং প্রত্যেকটি ক্রিয়া তার প্রতিক্রিয়া দ্বারা।
থিয়েটার প্লেগের মতোই একটি সমস্যা যার মৃত্যু দ্বারা অথবা সেরে ওঠা দ্বারা সমাধান করা হয়। এবং প্লেগ একটি উচ্চপদস্থ রোগ কারণ এটি একটি সম্পূর্ণ সমস্যা যার পরে মৃত্যু অথবা চূড়ান্ত বিশুদ্ধকরণ ছাড়া কিচ্ছু থাকে না। একইভাবে থিয়েটারও একটি রোগ কারণ এটি সর্বোচ্চ ভারসাম্য যা ধ্বংস ছাড়া অন্য কিছু দিয়েই লাভ করা যায় না। এটি মনকে একটি বিকার ভাগ করতে আমন্ত্রণ করে যা তার এনার্জিকে মহিমান্বিত করে; এবং আমরা দেখতে পাই, সিদ্ধান্তে আসার জন্য, যে মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে, থিয়েটারের ক্রিয়া, প্লেগের মতোই, উপকারী, এই জন্য যে, মানুষকে বাধ্য করে তারা যেমনতেমনভাবে দেখতে, মুখোশের পতন ঘটাবার কারণ হয়, মিথ্যাকে পরিস্ফুট করে, শৈথিল্য, নীচতা, এবং আমাদের বিশ্বের ভণ্ডামিকেও; এটি বস্তুর শ্বাসরোধকারী জড়তাকে ঝাঁকিয়ে দেয় যা আক্রমণ করে এমনকি অনুভূতিদের পরিষ্কার সাক্ষ্যকে; এবং মানুষদের যৌথতায় তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন শক্তির প্রকাশ ঘটায়, তাদের গোপন শক্তির, এটি তাদের নিতে আমন্ত্রণ করে, নিয়তির সম্মুখে, একটি উন্নত এবং নায়কোচিত ভাব যা এ ছাড়া তারা কখনও নিতে পারতো না।
এবং আমাদের অবশ্যই সেই প্রশ্ন করতে হবে এখন যে, এই পিচ্ছিল বিশ্ব যা আত্মহত্যা করছে তা না দেখেই, সেখানে মানুষদের একটি নিউক্লিয়াস পাওয়া যাবে কি না যারা তাদের থিয়েটার সম্বন্ধীয় উচ্চতর ধারণাকে চাপিয়ে দিতে পারে, মানুষেরা যারা পুনরুদ্ধার করতে পারে আমাদের সবার কাছে সেই প্রাকৃতিক এবং মতবাদদের সমান জাদু যাতে আমরা আর বিশ্বাস করি না।
চিত্রণ: ক্রিস্তিনা সাহা






