বড়দিনের ছুটিতে প্রকৃতির হাতছানিতে ছুটে গিয়েছিলাম লাভা, লোলেগাঁও, রিশপ। আমরা ছয়জন, দুই পরিবার শিয়ালদা থেকে রাতের দার্জিলিং মেলে সকালে এনজেপি স্টেশন। স্টেশনের বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল নেপালি ড্রাইভার বিধান রাই, বয়স তিরিশের কোঠায়। গাড়িতে মালপত্র বেঁধে চললাম সুন্দরী রিসপের উদ্দেশে। বিধান ভীষণ ভদ্র, মিশুকে। গাড়িতে কত অজানা গল্প। সমতল রাস্তা থেকে আস্তে আস্তে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। ঘন সবুজ গাছের সারি আর মাঝে মাঝে সুসজ্জিত চা বাগান– চোখ জুড়িয়ে যায়। স্বচ্ছ নীল আকাশ। এক জায়গায় পাহাড়ি ছাগলের মাংস পাওয়া যাচ্ছে। ৫০০ টাকা কেজি। একদম টাটকা। লোভ সামলাতে পারলাম না। রাতের ব্যবস্থা। মাংস নিয়ে আবার গাড়িতে। যত উপরে উঠছি ঠান্ডার আমেজ তত বাড়ছে। পাহাড়, জঙ্গল আর আকাশজুড়ে শুধুই নিঃস্তব্ধতা। ধাপে ধাপে পাইনের গগনচুম্বী অরণ্য আর ঝুল ঝাড়ু, এলাচের চাষ। কোথাও কোথাও পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সরু জলের ধারা, কোথাও বা ছোট্ট ঝর্না। গাড়ি চলেছে ধীরে রহস্যময় অসংখ্য পাহাড়ি বাঁকের মধ্যে দিয়ে, প্রত্যেক বাঁকেই নতুন নতুন দৃশ্য। কোথাও মেঘের ভিতর দিয়ে পথ, পরক্ষণেই আবার রৌদ্রোজ্জ্বল প্রকৃতি।

লাভা পৌঁছলাম দুপুরে। লাভা পর্বত আর পাইন জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট মনোরম জায়গা। উচ্চতা ৭২০০ ফুট। হাঁটা পথে লাভা মনেস্ট্রি, তিন কিমি দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউ পয়েন্ট। দশ কিমি দূরে নেওরাভ্যালি জাতীয় উদ্যান, ছ্যাংগি ফলস। প্রচুর বন্য জীবজন্তু আছে।
লাভাতে গাড়ি থেকে নামতেই ঠান্ডায় শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল, তাড়াতাড়ি গরম পোশাক পরে হাঁটা শুরু করলাম। লাঞ্চ সারতে হবে। লাভা ঘনবসতিপূর্ণ জায়গা। অনেক বাড়ি, হোটেল, বেশ বড় মার্কেট। এক বাঙালি হোটেলে ডিম ভাত ডাল আলুভাজা, তাতেই সই। লাঞ্চ সেরে বাজারের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ বাজারের পাশে একফালি ফাঁকা জায়গায় বেশ কিছু স্থানীয় গোর্খা আবালবৃদ্ধবনিতা বছরের প্রথম দিন উপলক্ষে নাচ গান মোজমস্তি করছে। অদ্ভুত মাদকতা। সাথে দেদার পানীয়। ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়ে পড়ছে। একদিকে কাঠের আগুন। আগুনের পাশে এক মধ্যবয়সী মহিলা গ্লাসে বিয়ার পরিবেশন করছে, আর সবাই গোল হয়ে নেপালি গানের তালে তালে শরীর দোলাচ্ছে। আমরাও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম। কাছে যেতেই আমাদের সাদর আমন্ত্রণ, আবদার পা মেলানোর। কখন যে তাদের সাথে মিশে গিয়ে কোমর দোলাচ্ছি বুঝতেই পারিনি। ওদের চোখেমুখে পোশাকে দারিদ্রের ছাপ, কিন্তু আজকের দিনে সব ভুলে আনন্দ মজা আর খানাপিনা। পয়লা জানুয়ারি উপলক্ষে আজ লাভা উৎসবে মেতে উঠেছে। পশ্চিমদিকে পাইন গাছের সারির মধ্যে দিয়ে সূর্য ঢলে পড়ছে। বিদায়মুহূর্তে এক গোর্খা ভাই আমার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মুঝে ইঁয়াদ রাখনা”। এবার আমাদের গন্তব্য লাভা মনেস্ট্রি। অসাধারণ সুন্দর। চারপাশে পাইনের ঢল, মাঝে এই মনেস্ট্রি, খুব বড়। মনে হচ্ছে শিল্পীর তুলি দিয়ে আঁকা ক্যানভাস। আপনা থেকেই মনে আসে এক অনাবিল প্রশান্তি।

লাভা থেকে রিশপ গাড়ি পথে সাত কিমি। রাস্তার কোনও চিহ্ন নেই। বড় নুড়িপাথরে ভর্তি। দুপাশে ঘন জঙ্গল। বিধান ভাই বলছিলেন– এই জঙ্গলে হিংস্র ভালুকও আছে। ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে গেল। চারিদিক শুনশান, অদ্ভুত এক নিঃস্তব্ধতা। কেমন যেন গা ছমছম করছে। অন্ধকারের বুক চিরে সামনে শুধু গাড়ির হেডলাইট।
ঘণ্টাখানেক পর পৌঁছলাম হোমস্টের সামনে, হিমালয়ান হাট, রিশপ। হোমস্টের মালিক বিমল তামাং সহাস্যে অভ্যর্থনা জানালেন। রবি নামে এক ভোলেভালা বিহারি কেয়ারটেকার। দুটো ঘর, কাঠের। ঘর লাগোয়া বাথরুম টয়লেট। কোমোডও আছে। টিভি নেই। কনকনে ঠান্ডা। জলের অপচয় করবেন না– বাথরুমে লেখা। এখানে জলের খুব কষ্ট। কাঠের আগুনে গরম করা জলে হাত-পা-মুখ পরিষ্কার করে গরম চা আর বিস্কুট। রবির হাতে মাংস দিয়ে বললাম– রাতে কষা মাংস আর রুটি, সাথে পেঁয়াজ। পরিষ্কার আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত দিগন্ত বিস্তৃত সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা। চোখধাঁধানো অপরূপ দৃশ্য! চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর বিচ্ছুরণে কাঞ্চনজঙ্ঘার যেন এক মায়াবী রূপ। হোমস্টের সামনের লনে দোলনায় বসে প্রকৃতির এই অপার্থিব দৃশ্যের সাক্ষী হতে পেরে নিজেদের খুব ধন্য মনে হচ্ছে। এ অনুভূতি বর্ণনাতীত।

কিছুক্ষণ পর রবি জ্বালানি কাঠ দিয়ে “বন ফায়ারের” ব্যবস্থা করে দিলেন। আকাশে পূর্ণিমার আলোয় প্রজ্জ্বলিত কাঞ্চনজঙ্ঘা, আর আমরা সবাই গোল করে কনকনে ঠান্ডায় আগুন পোহাচ্ছি। শ্যালিকার কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত– ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে…’। এ রোমান্টিক অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। চারিদিকে অজানা জংলি পোকার ডাক আর দূর বন থেকে নিশাচর পাখির ডাক। তাপমাত্রার পারদ হু হু করে নামছে। বিমল তামাংয়ের গৃহিণী কাঠের উনুনে রুটি করছেন অদ্ভুত দক্ষতায়। ডিনারে পাহাড়ি ছাগলের কষা মাংস আর গরম গরম রুটি, সাথে পেঁয়াজ। ওহ! মজাই আলাদা!
রাত এগারোটা। ঘরের ভেতর থেকে কাচের জানালা দিয়ে বাইরের নয়নাভিরাম দৃশ্য। দুটো কম্বল, পায়ের মোজা থেকে মাথার টুপি সমেত বিছানায়। মনে হচ্ছে বিছানা যেন বরফ-জল। বাইরে তাপমাত্রা মাইনাস দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। পাশের ঘরে ভায়রাভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। সকাল ছ’টা। দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই চোখের সামনে দিগন্তবিস্তৃত কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর সূর্যের প্রথম রক্তিম আলো। অনন্য সুন্দর! অপার্থিব দৃশ্য। প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। এত কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, পুরো ১৮০° দৃশ্যমান। মনে হচ্ছে রক্তিম গলিত সোনা কে যেন পর্বতের চূড়ামালায় ঢেলে দিয়েছে। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে, এত কাছে।

বেলা বাড়ার সাথে সাথে কাঞ্চনজঙ্ঘার মায়াবী রূপেরও পরিবর্তন হতে থাকল। হোটেলের লনে বসে গরম গরম কফির পেয়ালায় চুমুক। চারদিকে আলো ঝলমল করছে। গাছে গাছে পাখির কলতান। এক নৈসর্গিক পরিবেশ। গরমজলে স্নান করে সুস্বাদু মোমো খেয়ে সকাল সকাল গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। যাচ্ছি লোলেগাঁও।
চিত্র: লেখক








One Response
kanika