অরুণাচলের মেচুকা
অবতরণ
১৯৯৬ সালের অক্টোবর। ডিব্রুগড়ের কাছে চাবুয়া সামরিক বিমানবন্দর থেকে এএন-৩২ বিমানে উড়ে পড়লাম। গন্তব্য মেচুকা। তখনও পর্যন্ত মেচুকা সড়কপথে অরুণাচলের কোনও শহরের সঙ্গে যুক্ত নয়। আকাশপথেই তখন আসা-যাওয়া, যে-কোনও প্রয়োজনে। রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে কিংবা পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের হস্টেলে পৌঁছনো, এমনকি রেশন-খাদ্যসামগ্রী পৌঁছনো এমন যাবতীয় কাজে একমাত্র সহায় ওই ভারতীয় সেনার এএন-৩২ বা এম আই-১৭ হেলিকপ্টার। আমাদেরও কী ভাগ্যি, এসব চাল ডাল নুন চিনির বস্তার পাশে বসে পড়ার অনুমতি মিলে গেল। চাবুয়ার সেনা বিমানবন্দরের হালহকিকত ভালই জানা ছিল। কেননা অরুণাচলের অনন্য রূপের উপত্যকা আর অরণ্যগুলো নয়ের দশকের শুরু থেকেই আমাদের প্রিয় গন্তব্য।
হালকা মালপত্র নিয়ে সকাল দশটাতেই চাবুয়া পৌঁছে গেছি। এরপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কর্ণপটহে বিগ ড্রাম বাজিয়ে একের পর এক ছোট ছোট যুদ্ধবিমান মহড়া উড়ানে ওঠা-নামা করছে। আমাদের আর ডাক আসে না! তবে সেনার কোনও অফিসারকে জিজ্ঞেস করতেই বুঝিয়ে দিলেন যে, হিমালয়ের দুর্গম উপত্যকায় যে-সব পাহাড়ি গ্রাম সেখানে নানান সাহায্য পৌঁছে দিতেই সেনার এইসব এয়ার সর্টি সার্ভিস। নিচু উড়ানে নদীর গতিপথ ধরে কিংবা পাহাড়চূড়ার অবস্থান বুঝে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়। উড়ানের কিছু পরেই আর কোনও গ্রাউন্ড কন্ট্রোল থাকে না। তাই আকাশে মেঘ না কমলে, কুয়াশার চাদর না সরলে প্লেন বা হেলিকপ্টার ওঠা-নামা করতে পারে না। আবার অপেক্ষা অপেক্ষা আর অপেক্ষা। বেলা গড়িয়ে দুপুরে পৌঁছতে আমরা ডাক পেলাম। লম্বা লম্বা প্রপেলার মেলে দাঁড়িয়ে মাঝারি মাপের সেই প্লেন। আমাদের সামনেই, প্রায় দুশো গজের মধ্যে আমাদের মতোই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল সেই প্লেন। দরজা থেকে অ্যালুমিনিয়ামের ছোট্ট এক টুকরো মই বেয়ে সোজা প্লেনের পেটের মধ্যে প্রবেশ। পেটের মধ্যে সমান্তরাল এক জোড়া লাইনের ওপর পরপর ট্রলিতে নানান মাপার নানা ছাঁদের বস্তা শক্তপোক্ত করে বাঁধা। কোনও বসার সিট তো দেখছি না; বসব কোথায়! এসব ভাবছি যখন, তখনই সহকারী ক্যপ্টেন ককপিট থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি বলে দিলেন কী করে প্লেনের দেওয়ালের ফোল্ডিং ক্যাম্বিসের সিট খুলে বসতে হবে। হিমাংশুদা, বৌদি, অর্ঘ্য, আমি, সর্বাণী আর কিঞ্জল একেকটা গোল কাচের জানালার কাছাকাছি ফোল্ডিং সিটে বসে পড়লাম।
ককপিট থেকে আবার বেরিয়ে এলেন সহকারী ক্যাপ্টেন। বেশ মজার নির্দেশ কিঞ্জলের জন্য। জানালার কাচের পাশে যে হাতলটি ধরে কিঞ্জল বসেছিল, সেটি দেখিয়ে তাঁর সংক্ষিপ্ত হুঁশিয়ারি, “ইয়ে ল্যাচ খিঁচো মৎ, ভর্না খিড়কি আন্দর তুম বাহার।’’ বলেই তিনি আবার ককপিটে। আমরা বুঝলাম এ উড়োজাহাজের মতিগতি বেশ অন্য রকম। খুব নীচুতেই উড়ছি; নিচের খেলনার মতো ঘর-গেরস্থালি, পথঘাট, খেলনার মতো গাড়ি, রেলপথ সব নিমেষেই পার করে অরণ্যে ঢাকা পাহাড়ের সারির মধ্যে দিয়ে উড়তে থাকলাম। এত রকম যে সবুজ রং হতে পারে, আষ্টেপৃষ্ঠে অরণ্যে মোড়া অরুণাচলের পাহাড়ের সারি না দেখলে আন্দাজ করা শক্ত। আরও খানিক ওড়ার পরেই দেখি, নিচে সরু ফিতের মতো নদী পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলেছে। সিয়ম নদী। আর ওই সায়ম নদী বেয়ে আকাশপথে উড়তে উড়তে মিনিট চল্লিশের মধ্যেই মেচুকার মাটিতে। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, আমরা এবার ল্যান্ড করব, সবাই সিটগুলো শক্ত করে ধরে বসবেন। সিটবেল্টের কোনও চিহ্ন নেই তাই এই হুঁশিয়ারি। যাহোক নির্বিঘ্নে অবতরণ পর্ব শেষ হল। নেমে ক্যাপ্টেন আর তাঁর সহকারীকে ধন্যবাদ দিতে দিতে আবার একপ্রস্থ গল্প হল। জানা গেল মেচুকার এই ল্যান্ডিং-গ্রাউন্ড চীন সীমান্তের খুব কাছেই। তাই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তবে ১.৫ কিমি টারম্যাকের বেশ খানিকটা ভেঙে গেছে; এখন ১.৩ কিমি ব্যবহার্য। শীঘ্রই সারানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কিন্তু ততদিন বিমানের নামা-ওঠা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা ভাবছি, ফিরতে পারব তো!

এ-এন৩২ চেপে চাবুয়া এয়ারপোর্ট থেকে মেচুকার এয়ার স্ট্রিপে অবতরণ।লেমন ভ্যালির প্রথম রাত
বিমান থেকে নামতে নামতে দেখি, তখনি জনা পঁচিশ তিরিশ নানান বয়সে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে মেচুকার সেই ভাঙাচোরা ল্যন্ডিং গ্রাউন্ডে। বেশ কিছু ছোট ছোট ঠেলাগাড়ি আর একটা লড়ঝড়ে ট্রাক। বুঝলাম প্লেনের পেট থেকে বস্তাগুলো স্বস্থানে নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থা প্রস্তুত। প্লেনের ক্যাপ্টেন রানওয়ের কাছেই ইন্সপেকশন বাংলোটা দেখিয়ে দিলেন। রানওয়ের মাঝামাঝি পুব দিকে পশ্চিম-মুখো দোচালা কাঠের বাংলো। দূর থেকে দেখতে বেশ লাগল। ক্যাপ্টেন খানিক কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা হঠাৎ এই মেচুকায় বেড়াতে এলাম কেন! নামটাই বা জানলাম কীভাবে! আমরাও সবিস্তারে জানালাম আগের বছর পুজোয় আমরা রোয়িং থেকে আনিনি পৌঁছেছিলাম সিয়াচেন টাইগার নামের এম আই-১৭ হেলিকপ্টারে। সিয়াচেন টাইগারের সেই ক্যাপ্টেন বলেছিলেন আপনারা অরুণাচল ঘুরতে ভালবাসেন, আপনারা নিশ্চয়ই একবার লেমন ভ্যালি ঘুরে আসুন। অক্টোবর থেকেই ঢেউ খেলানো মেচুকা উপত্যকা উজ্জ্বল সবুজমেশা-হলদে রঙের ঘাসে ছেয়ে যায়। সেই সৌন্দর্যের টানেই এবছর এখানে। ক্যাপ্টেনদের টাটা বাইবাই করে গুটিগুটি পাহাড়ি ঢাল বেয়ে আইবির দিকে চললাম।

কেয়ারটেকার-কাম-কুক মানুষটি বেশ হাসিখুশি আর চটপটে। সে আমাদের দুটো ঘর খুলে দিল। আইবিতে ঘর অবশ্য দুটিই। এছাড়া খাবার ঘর আর রান্নাঘর। আমাদের কেয়ারটেকার ছেলেটি অতি বিনীতভাবে জানাল, আজ সন্ধেয় এক বিয়েবাড়িতে তার নাচ-গান করার নিমন্ত্রণ আছে; সে চটপট তার অনুষ্ঠান শেষ করে এসে আমাদের জন্য রাতের খাবার বানিয়ে দেবে। অগত্যা। দূর থেকে আইবি যতটা ভাল লেগেছিল, ঘরে ঢুকে আমরা তেমনই হতাশ। অনেকটা সুকুমার রায়ের বুড়ির বাড়ির দ্বিতীয় সংস্করণ। মেঝে-দেয়াল সবখানেই কাঠের তক্তাগুলোর মধ্যে বিস্তর ফাঁক। বিকেল থেকেই এই চারপাশ খোলা উপত্যকার মধ্যে হুহু কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। রাতে যে কী হবে কে জানে। তবে এসব ভাবার কি এখন সময় আছে! এই পুব হিমালয়ে সন্ধে নামবে তাড়াতাড়ি। আমাদের দেখা করতে হবে ইএসির সঙ্গে। আগামী দুদিনে ঘোরাঘুরির স্থানীয় ছাড়পত্র জোগাড় করতে হবে। দুদিনের খাবার রসদ জোগাড় করতে হবে। অনেক কাজ। আমরা সদলে হৈহৈ করে বেরিয়ে পড়লাম।
মেচুকা অরুণাচলের চীন-সীমান্তবর্তী আর হাজার ছয়েক ফুট উঁচুতে। অরণ্য আর তৃণভূমি ঢাকা উপত্যকায় ছোট্ট একটি গ্রাম। জনসংখ্যা সাকুল্যে তিন হাজার। সকলেই আদিবাসী। বেশিরভাগই মেম্বা আর লিবো উপজাতি। এসব জায়গায় হেঁটে ঘুরতেও তখন প্রথম কাজ ছিল একটা স্থানীয় ছাড়পত্র জোগাড় করা। ওই তো ছোট্ট একটা গ্রাম; আইবি থেকে একটু এগোতেই চোখে পড়ল অরুণাচল সরকারের অফিস অফ দ্য এক্সট্রা অ্যাডিশনাল কমিশনার। সেই নয়ের দশক থেকে এখনও পর্যন্ত অরুণাচলের যত অরণ্য-উপত্যকায় ঘুরছি, সবখানেই সরকারি আধিকারিকদের অনেক সাহায্য-সহযোগিতা, উৎসাহ পেয়েছি। তাঁদের সাহায্য ছাড়া এমন দুর্গম জায়গাগুলোয় ঘোরা অসম্ভব ছিল। আমরা ইএসিকে আমাদের মনবাসনা জানালাম। মেচুকার উত্তরে তিরিশ কিমি গেলেই ভারত ও চীনের মধ্যে সীমা নির্ধারণের ম্যাকমহন লাইন। অরুণাচল সরকারের সাপ্লাই অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট বিভাগের ডিরেক্টর মি. ডি কে ভট্টাচার্য সাহেব বলেছিলেন, মেচুকা থেকে উত্তরে হাঁটা পথে একটা গুরুদুয়ারা আছে। কথিত আছে, তার কাছেই একটা পাথরে পাশে বসে গুরু নানক তপস্যা করেছিলেন। তপস্যার সময় একটা ভাল্লুক এসে বারবার তাঁকে বিরক্ত করছিল। তিনি তখন মস্ত এক পাথর দিয়ে সেটির আসার পথ দিলেন বন্ধ করে। আর তপস্যা শেষে সেই বিরাট পাথর ভেদ করে তিনি অনায়াসে বেরিয়ে এলেন। আজও সেই বিশাল পাথর পথ আগলে রয়ে গেছে; তার মাঝামাঝি লম্বা এক ফাটল, যার মধ্যে দিয়ে একজন কষ্টেসৃষ্টে গলে যেতে পারে। সব শুনে ইএসি সাহেব বললেন, সে পাথর আর গুরুদুয়ারা সেখানেই আছে বটে, তবে সে তো বিস্তর হাঁটা। যাওয়া-আসায় চব্বিশ কিমি হাঁটতে হবে। আমরা সমস্বরে তাঁকে আশ্বস্ত করতে শুরু করলাম। অর্ঘ্য তখন সবে উত্তর কাশী থেকে পাহাড়ে চড়ার বেসিক কোর্স করে ফিরেছে; হিমাংশুদা তো অ্যাডভান্স কোর্স করা রীতিমতো মাউন্টেনিয়ার, আমরাও পিন্ডারি-কাফনি, মিলাম এমন আরও বেশ কিছু গ্লেসিয়াল পয়েন্ট অবধি হিমালয়ে হেঁটে ফেলেছি। আর এই ভ্যালি ট্রেকে দিনে আসা-যাওয়া চব্বিশ কিমি আমরা বেশ পারব। ইএসি সাহেব বললেন তবে তো একটা ব্যবস্থা করতেই হয়। নিজের সহকারীর সঙ্গে পরামর্শ করে জানালেন আমাদের সঙ্গে একজন পলিটিকাল ইন্টারপ্রেটার দেওয়া হবে। আমাদের হাঁটতে হবে আদি, লিবো, মেম্বাদের ছোট ছোট গ্রামের মধ্যে দিয়ে। আমাদের মতো শহুরে লোক দেখে তাঁরা সন্ত্রস্ত হতে পারেন, তাই তাঁদের নিজেদের উপজাতীয় ভাষায় আশ্বস্ত করার কাজটিই করবেন ওই পলিটিকাল ইন্টারপ্রেটার মশাই। আমরা অবশ্য আগে থেকেই জানি, তাঁর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ; আমরা কোনও দেশদ্রোহী কাজ করছি কি না সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। যাক, আমরা নিশ্চিন্ত, আগামী কাল হাঁটার প্রোগ্রাম নিশ্চিত। ফেরার পথে কিছু চাল-ডাল, আটা, নুন-চিনি, কিছু অদ্ভুতদর্শন বেগুন আর আলু কিনে আইবির পথ ধরলাম।

আইবির দরজা হাট করে খোলা। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটা মোমবাতি জ্বালতে মনে হল হ্যালোজেন বাল্ব জ্বলে উঠল। এতক্ষণে সবার মনে হল একটু চা খেলে প্রাণ জুড়োত। রান্নাঘরে কিছু বাসনপত্র দেখলেও চুলা জ্বালানোর কোনও বন্দোবস্ত দেখলাম না। আবার অপেক্ষা আর অপেক্ষা; কখন নাচ-গান শেষে আমাদের কেয়ারটেকার মশাই উদয় হন! আমরা খানিক নিরুপায় হয়ে নিজেদের ঝোলার কিছু শুকনো খাবার নিকেশ করতে লাগলাম। আটটা নাগাদ গান গাইতে গাইতেই কুক ছেলেটি এসে পৌঁছল। এসেই সে হৈহৈ করে কখনও নেচে কখনও গেয়ে, আজ বিয়ে বাড়িতে তার দারুণ পারফর্ম্যান্স, অনেক তারিফ, হাজার সাবাশ, এসব ভাঙা হিন্দিতে সবিস্তারে আমাদের বোঝাতে লাগল। সে-সব শোনাচ্ছে আর টলোমলো পায়ে অথচ চটপটে হাতে কাঠ জ্বেলে আলু-বেগুনের একটা লালরঙা তরকারিও সে চটপট বানিয়ে ফেলল। এত খুশি হয়ে সে সদাই নাচছে আর গাইছে যে, আমরা সবাই খুব মশগুল। মেয়েরা অবশ্য তাকে বিরক্ত না করে কড়ায় ফুটন্ত তরকারিটা খুন্তি দিয়ে খানিক নাড়িয়ে দিচ্ছিল; তারা নিশ্চয় শঙ্কিত, নাচ দেখতে গিয়ে তরকারি না পুড়ে যায়! এরপর রুটির পালা। আমরা রুটি বেলে দিলেই সে একটা করে তাওয়ায় সেঁকতে দিয়েই পাহাড়ি গানের অদ্ভুত এক ঘোর লাগা সুরের দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। বারবার ঘুরে ঘুরে যে লাইনটা সে গাইছিল তার শুরুর ‘আজ মনো…’-টুকুই বুঝতে পারছিলাম। বাকিটা সব ঝাপসা। তবে সন্ধেটা তার নাচ-গান-গল্প আমাদেরও এমন মাতিয়ে রেখেছিল যে, সবাই সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে গিয়েছি।
রুটি বানানোর কাজটা আমরাই শেষ করে ফেলেছি। গনগনে আঁচের চারপাশে বসে রাতের খাওয়া শেষ। রান্নাঘরে উনানের তাতে আর তরকারিতে ভূত-জালোকিয়ার তেজে আমাদের তখন ঘাম ঝরছে। বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোধহয় সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎই সকলেই জাগ্রত। বুকের ভেতর, হাড়ের মজ্জায় কনকনে ঠান্ডার গুড়গুড়ানি থামতেই চায় না। উনানের আঁচের তাপে আর লঙ্কার ঝালে গরম শরীর তখন জমে হিমঠান্ডা। ছ’জন মানুষের জন্য মোটে পাঁচটি কম্বল। যার কাছে যা কিছু গরম কাপড়-জামা ছিল সেই সব গায়ে চাপিয়ে কোনওক্রমে আধো ঘুমে-আধো কাঁপায় রাত কাটাল। স্যাঁতসেঁতে হিমঠান্ডা বিছানায় অকারণ পড়ে না থেকে সকলেই দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম। তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে, আজ অনেক পথ হাঁটতে হবে। ঠিক সকাল সাতটা। পুব হিমালয়ে সকাল হয়েছে অনেক আগেই। আজ চমৎকার রোদ ঝলমলে সকাল। তবে সিয়ম নদী তখনও ঘন কুয়াশার চাদরের নিচে ঘুমন্ত। জল থেকে ওঠা জলীয় বাষ্প জমে মেঘ হয়ে এঁকেবেঁকে শুয়ে আছে সিয়ম নদীর ওপর। কী অসাধারণ সেই মেঘের নদী সকালের সোনালি রোদ্দুরে! আর ঠিক সেই ‘সাত-সকালে’ই আমাদের নতুন সঙ্গী নাকসাঙের, ‘সালাম সাব, আপলোগ রেডি! চলিয়ে।’ শুরু হল মেচুকা উপত্যকায় আমাদের একটা নতুন ঝকঝকে দিন।

আলো ঝলমল দুটো দিন
ঝলমলে আলোর দিনে কনকনে পুব হিমালয়ের উপত্যকায় হাঁটার মজাই আলাদা। আসমানি আকাশ, যেন পোলারাইজিং ফিল্টার দিয়ে দেখছি! উপত্যকা বেয়ে হাঁটলে কখনওই খুব চড়াই উঠছি কিংবা উৎরাইয়ে নামছি মালুম হয় না। খানিক হাঁটার পরে দেখা যাবে নদী কোথায় নিচে পড়ে আছে, তেমনি বেশ কিছু অনায়াস হাঁটার পর আবার সেই নদীটির পাশটিতে। সিয়মের পাশ দিয়ে বেশ খানিক পথ পেরোলাম। কত ছোট ছোট ঝোরা এসে নদীতে মিশছে। আমরা পার হয়ে চলেছি কোথাও প্রায় হাঁটুসমান জল, কোথাও পায়ের পাতা ভেজা। পাদুকা পায়ের চেয়ে হাতেই রইল বেশি। নাকসাঙের কথা কম কাজ বেশি। সে ঠিক লক্ষ্য রাখছে, কে পিছিয়ে পড়ছে, কার হাত ধরে খরস্রোতা ধারাটি পার করে দিতে হবে। নাকসাঙই জানাল, আদি উপজাতীয় ভাষায় এ জায়গার নাম মেনচুখা, আর মেনচুখা থেকেই মেচুকা। ‘মেন’ অর্থে ঔষধি, ‘চু’ হল নদী বা জল আর ‘খা’ মানে বরফ। ঔষধি বরফ-গলা নদীই তো এই সিয়ম। জলই যে মানুষের বড় শুশ্রূষা, সহজ নিরাময়, এই আদিবাসী সমাজের কাছে কত স্পষ্ট জেনে আমরা হতবাক।

নদীকে নিচে ফেলে আমরা এখন অনেকটা উপরে চলে এসেছি। উদার ঘাসজমির মধ্যে দিয়ে পায়ে-চলা পথ। কিন্তু এরই মধ্যে কত যে ছোট-বড় খরস্রোতা জলধারা পার হলাম! সেই ছোট ছোট নদীর উপধারাগুলির ওপরে নড়বড়ে সব সাঁকো। যেন তারের ঝোলানো দোলনায় কিছু অশক্ত কাঠের তক্তা ফাঁক-ফাঁক করে সাজানো। প্রায় দশ-বিশ ফুট নিচে ছুটন্ত পাগুলে জলস্রোত। অতি সন্তর্পণে সেই সব সাঁকো পার হয়ে চলেছি। মাঝেমধ্যেই পাহাড়ে গায়ে সেনাদের বাঙ্কার। খুব ইচ্ছে ছিল ছবি তুলি, কিন্তু নাকসাঙের বারণ। পথ কখনও ছোট ছোট গ্রামের মধ্যে দিয়ে চলেছে, কখনও বা আসাম রাইফেলস-এর ছোট ছাউনির পাশ ঘেঁষে। গ্রামগুলো এলেই নাকসাঙ আর আমাদের পোয়া বারো। নাকসাঙ তার নিজের ভাষায় খানিক কথা বলে নিতে পারছে আর আমাদের ভাগ্যে জুটে যাচ্ছে অমৃতসমান তাজা শশা, গরম সেঁকা ভুট্টা, এমন কত কিছু। সেদিনের দীর্ঘ পথ চলায় আমরা কোনও খাবার সঙ্গে নিয়ে আসিনি। নাকসাঙ কেন বারণ করেছিল, এখন বুঝছি। পানীয়জল আর চা অনায়াসে মিলছিল সেনা ছাউনিগুলোয়। প্রায় প্রতিটি সেনা ছাউনিতে আমাদের চা খেতে হয়েছে। এত আন্তরিক তাঁদের আমন্ত্রণ যে, খানিকক্ষণ বসে জিরিয়ে জল কিংবা চা বা কফি না খেয়ে এগোনো যায় না। সব ছাউনি থেকেই ছিল ফেরার পথে যেন আবার আমরা সেই ডেরায় বসে গল্প করে যাই, এমন আদরের আহ্বান। ‘চলি চলি চলি চলি, পথের যে নাই শ্যাষ।’

আরও পাঁচ কিমি পথ বাকি। নাকসাঙ দেখিয়ে দিল দূরে কিছুটা নিচে গুরুদুয়ারা আর সংলগ্ন সেনা ছাউনি। আমাদের জন্য আরেক অবাক অভিজ্ঞতা দাঁড়িয়ে ছিল গুরুদুয়ারার গেটে। এই উপত্যকায় মানুষের উপস্থিতি ও চলাচলের ওপর যে সবার লক্ষ্য থাকে, বেশ বোঝা গেল। গুরুদুয়ারায় পৌঁছে দেখি একজন শিখ সেনা একটা বড় থালার ওপর চকচকে সাতটি নতুন স্টিলের গ্লাসে জল নিয়ে আমাদের পৌঁছনোর অপেক্ষায়। এমন চমৎকার সাদর ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। গুরুদুয়ারাটি আড়ম্বরহীন একটি ছাউনি মাত্র। অদ্ভুতদর্শন এক পাথর, আর তার নিচে গুরু নানকের ছবি। বসে ধর্মাচরণের জন্য মোটা কম্বল পাতা, পাথর বিছানো মেঝের ওপরে। সামনে কাঠের তক্তা দিয়ে লম্বা টেবিল-বেঞ্চি বানানো। সেখানে বসে সেনাদের সঙ্গে বসে রুটি-আলুচোখা আচারের অনাস্বাদিত লঙ্গর। বেশ কিছু সময় কাটিয়ে আমরা এবার ঘরমুখো। ফেরার সময় পথে আবার অনেক প্রীতি বিনিময়, আবার আসার নিমন্ত্রণ, আরও কিছু শশা-মকাই উপহার। তবে আরও এক বড় চমক আমাদের জন্য তোলা ছিল।

তখন বোধহয় সাড়ে-চারটে বাজে। উপত্যকায় আলো কমে প্রায়ান্ধকার। আইবি পৌঁছতে আর তিন-চার কিমি বাকি। সেখানেই সিয়ম নদীর ওপর অনেকটা লম্বা পায়ে-চলা সেতুটার সামনে পুরোদস্তুর সেনা পোশাকে এক ভদ্রলোক আমাদের পথ আটকালেন। প্রথমটায় একটু অস্বস্তিতে পড়লেও লহমায় সেটি দূর হয়ে গেল। মুখের হাসি ও দোস্তির হ্যান্ডশেকে নিমেষে আমাদের বন্ধু হয়ে উঠলেন। ভি পর্মানন্দ্। সেনার সিগন্যাল অফিসার। সিয়ামের ওপারে উঁচু যে টিলাটিকে ঘিরে সর্টির বিমান অ্যাডভান্স ল্যান্ডিং গ্রাউন্ডে নেমে আসে, সেই টিলাটার ওপরে পর্মানন্দের ডেরা। তিনি ওপর থেকে সকালে আমাদের দেখেছেন। অপেক্ষায় ছিলেন ফেরার সময় আমাদের পাকড়াও করবেন। তাঁর দাবি, আমরা যখন মেচুকায় তখন আমরা মেচুকার মেহমান। আগামী কাল সকালে চারশো বছরের পুরোনো বৌদ্ধমন্দির দেখতে আমাদের এই টিলার মাথায় উঠতেই হবে; তাই সেসব দেখার পর আমরা যেন তাঁদের সঙ্গে দুপুরে খেয়ে তবেই নেমে আসি। এই নিমন্ত্রণ জানানোর জন্যেই তিনি পাহাড়-চুড়ো থেকে নেমে সেতুর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন! আমরা আবার হতবাক।

পরের দিন সকালটাও রোদ্দুরে ঝলমল করছে। আগের রাতে ঠান্ডায় আমাদের দুর্দশার কাহিনি শুনে নাকসাঙ বেশকিছু মোটা মোটা কম্বল দিয়ে গেছে। পথশ্রমে শ্রান্ত আমরাও সন্ধের পরেই ডিনার সেরে লম্বা ঘুম দিয়ে বেশ চাঙ্গা। একটু বেলা করেই নাকসাঙ আজ আমাদের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছে। আজ আসা-যাওয়া কমবেশি ষোলো কিমি হাঁটা। খানিক হেঁটে আমরা সেই লম্বা নড়বড়ে সেতুর সামনে পৌঁছলাম। এপারে আর ওপারে দুটো করে পেল্লায় লম্বা লম্বা মোটা কাঠের গুঁড়ি থেকে ঝোলানো তারের সঙ্গে বাঁধা তক্তা দিয়ে বানানো প্রায় আধ কিমি লম্বা সেই সেতু। পূর্ব হিমালয়ের চীন-তিব্বত সীমানায় নানান জায়গায় এমন অস্থায়ী সেতুর বন্দোবস্ত আছে। শত্রুর আক্রমণে যেন সহজেই এসব সেতু ভেঙে দিয়ে আগুয়ান শত্রুদের আটকানো যায়। গতকাল এই সেতুর চেয়ে অনেক বিপজ্জনক সাঁকো আমরা পার হয়েছি। তাই এই সেতুও আমরা সন্তর্পণে পার হয়ে গেলাম। তার পরে বেশ খানিক হাঁটার পর পায়ে-চলা পথ দেখি সটান উপর দিকে উঠতে শুরু করল। মোটামুটি পাঁচ-ছ’শো ফুট উঁচু একটা টিলা। এটির অবস্থানই বিমানের পাইলটকে আকাশ থেকে মেচুকা উপত্যকা চিনে নিতে সাহায্য করে।

পথ সোজা আমাদের নিয়ে ঊর্ধ্বমুখে ছুটল। হাঁফাতে হাঁফাতে ওপরে পৌঁছে কিন্তু মন ভরে গেল। সমস্ত মেচুকা উপত্যকা এখন টিলার পায়ের নিচে ছড়ানো। ক্যামেরার চোখে সেই লেমন ভ্যালিকে ধরে রাখা আমার কম্মো নয়। খেলনার মতো সেই পারাপারের সেতুটি। সরু কালো সুতোর মতো রানওয়ে। খুব ভাল লাগল। ইতিমধ্যেই পর্মানন্দ্ আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সেই আমাদের ভাঙাচোরা বৌদ্ধমন্দিরটি দেখাল। সামতেন ইয়োঙচা গোম্পা। চারশো বছরের পুরোনো কাঠের ভাঙাচোরা গুরুত্বহীন হীনযান বৌদ্ধ গোম্পা। অরুণাচলের পশ্চিমে ১৬৮০-৮১-র তাওয়াঙ বৌদ্ধ গোম্পা থেকে একেবারে পূর্বে ডিচু যাবার পথে লোহিত নদীর ধারে অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে উজ্জ্বল কাহো গোম্পা। সবগুলোই বেশ সাজানো গোছানো ঝকঝকে। এমন হতশ্রী গোম্পা আগে দেখিনি। জানি না এখন এই দু’দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত করে যদি তার শ্রী ফিরে থাকে! দোতলা কাঠের গোম্পায় কত পাথরের মূর্তি, লিপি খোদাই করা পাথর চারিদিকে ছড়ানো। ভেতরে ভীষণদর্শন সব রঙচঙে ছবি আর মূর্তি।

গোম্পায় ঘোরা শেষ করেই আমরা পর্মানন্দের সিগন্যাল পোস্টের ছাউনিতে হাজির। দেখি প্রাইমাস স্টোভে সগর্জনে কিছু রান্না হচ্ছে। আমরা সেই টিলার চুড়োয় খোলা আকাশের নিচে রোদ্দুরের আঁচ গায়ে মেখে গল্প করতে করতেই খাবার এসে হাজির। গরম ভাত, মুসুর ডাল, আলু-টমেটো-ধনেপাতা দিয়ে এক স্বর্গীয় শুকনো তরকারি আর টিনে প্রিজার্ভ করা মাছ দিয়ে ঝাল। রান্নায় পরিষ্কার অসমীয়া ছাপ। পর্মানন্দ্ আমাদের অতি তৃপ্তির ভোজ খাওয়ালেন। এবার ফিরতে হবে। আমাদের ঠিকানা বিনিময় হল। মেচুকায় থাকাকালীন সময়ে পর্মানন্দ্ নাগপুরে তাঁর দেশে ফেরার সময়ে বার তিনেক আমাদের বাড়ি এসেছেন। আমরা অনেক গল্প শুনেছি, অরুণাচলে দুর্গম এলাকায় তাঁর থাকার নানান অভিজ্ঞতার। আজ হেঁটে এই পাহাড়-চুড়োয় পৌঁছতে যে সময় লেগেছিল, ফিরে এলাম তার অর্ধেক সময়ে। নাকসাঙের বায়না, এখন তার বাড়িতে যেতেই হবে। আমরা বললাম, নাকসাঙ আজ আর নয়। কাল আমাদের ফেরার দিন। দুপুর দুটোর আগে কিছুতেই সর্টি সার্ভিসের বিমান এসে পৌঁছবে না। আমরা বরং ব্রেকফাস্ট সেরে কাল সকালে আটটা-ন’টা নাগাদ তোমার বাড়ি যাব। নাকসাঙ রাজি হল। আমরাও তাই ইএসি সাহেবের অফিসে ঢুকে আমাদের বেড়ানোর গল্পসল্প করলাম। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে, ছোট্ট বাজারটায় আবার কিছু চক্কর দিয়ে বিকেল বিকেল আইবি-র পথ ধরলাম। আজ কেয়ারটেকারকে পাকড়াও করে খানিকক্ষণ তার সুরেলা খোলা গলায় পাহাড়িয়া মিঠে গান শুনতেই হবে।

এবার ফেরার পালা
ঠিক সকাল আটটায় নাকসাঙ আইবিতে হাজির। আমরাও তৈরি। গত দু’দিন আমরা যেদিকে হেঁটেছি, আজ ঠিক তার উল্টো মুখে চললাম। মেচুকার কেন্দ্রীয় অফিস-দোকান-বাজারের ছোট্ট জটলাটাকে পিছনে রেখে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আরো সামনের দিকে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই নাকসাঙের ছিমছাম বাড়িতে। পাহাড়ের কোলে সেই বাড়ি আর তার চারপাশে অনেকটা সমতল জায়গা। একটা ছোটখাটো ফুটবল মাঠের মতো। সামনের দিকে সেই মাঠ খাড়া নেমে গেছে সিয়ম নদীর ধারে। মেচুকা অঞ্চলে সব বাড়িরই মোটামুটি একই ধাঁচ। পুব অথবা পশ্চিম মুখে একটা লম্বা টানা বারান্দা আর তার কোলে তিন-চারটি পাশাপাশি সাজানো ঘর। নাকসাঙের বারান্দার একপাশে অতিথিদের বসার সুবন্দোবস্ত। নাকসাঙ আর তার গিন্নি, ছেলে, বৌমা এমনকি নাতিটিও আমাদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে তাদের চমৎকার সাজানো-গোছানো বাড়িটি। শোবার ঘরগুলি ছোট ছোট কিন্তু রান্নাঘরটি মস্ত। সারা দেয়াল জুড়ে তাকে নানান ঝকঝকে বাসনপত্র সারি সারি সাজানো। মাঝখানে উনান আর তার চারপাশে কার্পেটের মতো মোটা কম্বল পাতা। দিনের খাওয়া-বসা-ঘুম অনেকটাই যে রান্নাঘরে উষ্ণতার আরামে সে বেশ বোঝা যায়। হিমালয়ে সব পাহাড়ি অঞ্চলেই এমন বড় রান্নাঘর-কাম-বসার ঘর দেখেছি। লাদাখে যেমন, মককচুঙেও তেমন। পশ্চিম থেকে পুবে একই ছবি। নাকসাঙের রান্নাঘরের লাগোয়া একটু ছোট ঘরে সারি পাত্রে ঢিমে আঁচে আপং তৈরি হচ্ছে। চমৎকার চেহারার সব ডিস্টিলেশান পাত্র। আপং নিতান্তই নির্দোষ রাইস বিয়ার। ‘এবার ফেরার পালা’ বললেই তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিমে পাপাঙ্গুলের পরের পঙক্তি ‘সবার জন্যে ডাম্পুলি একথালা’ মনে পড়ে। নাকসাঙের গিন্নি ততক্ষণে ছোটখাটো পাহাড়ের মতো থালা ভরা ঝাল-নোনতা মকাই ভাজা আর সুদৃশ্য কাচের গ্লাসে হালকা হলুদ রঙের মৃদু গরম আপং এনেছেন। সকালের সেই হৈচৈ গল্পগাছা আড্ডা যখন সপ্তমে, হঠাৎ খেয়াল হল বাইরে আলো কেমন ম্রিয়মাণ আর আকাশটাও মেঘলা। আমরা একযোগে শঙ্কিত। এএন-৩২ উড়বে তো! নাকসাঙ ভরসা দিয়েছে, কোনও চিন্তা নেই, সর্টি আজ আসবেই। শীতের আগে অনেক সামান আনতে হবে। সপ্তাহে দুটো সর্টিতে সে-সব আসছে। চাবুয়ায় আমাদের নাম এন্ট্রি করানো আছে। কিন্তু মেঘ যদি বাড়তে থাকে! বলা তো যায় না! নাকসাঙের বাড়ি থেকে এবার আইবি ফিরতে হবে। জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে হবে। নাকসাঙের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি যখন, মনে হল যেন কোনও আত্মীয়ের বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি।

ওই তো ক’টা জামা-কাপড় আর টুকিটাকি। সেসব গুছিয়ে নিতে কত আর সময় লাগে! খানিক শুয়ে বসে সময় কাটিয়ে শেষে বিরক্ত হয়ে গেলাম। যে যার রাকস্যাক কাঁধে তুলে ল্যান্ডিং গ্রাউন্ডে পৌঁছে গেলাম। তখন মোটে দেড়টা। চারপাশ চুপচাপ। মেঘলা আকাশ। বেশ কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। বেশ কিছু ছাগল ল্যান্ডিং স্ট্রিপে ঘুরেফিরে কীসব খুঁটে খাচ্ছে। সর্টি থেকে চাল ডাল গমের বস্তা নামানো সময় নিশ্চয় কিছু ছড়িয়ে পড়ে। শান্ত প্রায় নিশ্চুপ দুপুরে ঘুমন্ত সেই এয়ার স্ট্রিপে আমরাই কিছু কলরব। স্ট্রিপের মাঝামাঝি একপাশে কাঠের মোটাসোটা কয়েকটা গুঁড়ির মাথায়, মাটি থেকে ফুট পনেরো উপর কাচের জানালা দিয়ে ঘেরা ছোট একখানা ঘর। ওটাই নিশ্চয় কন্ট্রোল টাওয়ার। হিমাংশুদা চটপট কাঠের লম্বা মই বেয়ে সেই টাওয়ারে। খবর পাওয়া গেল, কোনওই খবর নেই। বসে আছি, বসেই আছি। আমরাও ক্রমশ চুপচাপ হয়ে গেছি। এরই মধ্যে হিমাংশুদা বেশ কয়েকবার ‘কোনও খবর নেই’ সংবাদ এনে দিয়েছেন। তখন প্রায় আড়াইটে বাজে, দেখি একজন ওই টাওয়ার থেকে নেমে আসছেন। হাতে তাঁর লম্বা লম্বা সরু সরু লাঠি। তিনি আমাদের ডাকলেন। কী ব্যাপার কে জানে! কন্ট্রোল টাওয়ারের কর্মী মানে ইনিও নিশ্চিত বায়ুসেনার কর্মী। পকেট থেকে চার খণ্ড লাল কাপড়ের টুকরো বের করে চারটে লম্বা লাঠির মাথায় লাগিয়ে দিলেন। দুটো লাঠি আমাদের চালান করলেন আর একটা ফুট তিনেকের লিকলিকে বেত। নীরবে এই কাজগুলো সেরে উনি আমাদের নির্দেশ দিলেন, এয়ার স্ট্রিপ থেকে ছাগলগুলো তাড়িয়ে ওই দিকে রানওয়ের প্রান্তে দুকোণে দুটো লাল ফ্ল্যাগ পুঁতে দিতে। ফুটবল মাঠের কর্নারে যেমন থাকে আর কী! আমরা সকলে একসাথে ঘোর আশ্চর্য। কেউ কোনওদিন ভেবেছি, ছাগল তাড়িয়ে, ফ্ল্যাগ দেখিয়ে আকাশ থেকে প্লেন নামিয়ে সেটিতে উঠতে হবে! বিস্ময়ের ঘোর কাটতে বুঝলাম, জীবনে এ এক অক্ষয় অভিজ্ঞতা জমে উঠল। আমরা জেতেতে মাস্টার তাই বেত হাতে ছাগল তাড়ানো মোটেই কঠিন কম্মো নয়। সেই সেনানী আমাদের নির্দেশ দিয়েই দুটো লাঠির আর একটা বেত হাতে ছুটলেন এক প্রান্তে আর আমরা উল্টো দিকে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই সব জেদি অনিচ্ছুক ছাগলদের চারণভূমি থেকে বিদায় করে ফ্ল্যাগ পুঁতে ফিরতে ফিরতেই দেখি গোঁ-গোঁ শব্দে আমাদের প্লেন মাথার উপরে। নিমেষেই সেটি দূরে পর্মানন্দের ডেরা আর বৌদ্ধ গোম্পার পাহাড়টাকে পাক দিয়ে রানওয়ের ওপর নেমে এল।

দেখতে দেখতে সেই নিশ্চুপ এয়ার স্ট্রিপ এখন নানান কলরবে মুখর। মালপত্র নামানো চলছে। আমরা যে ক্র্যাফ্টে এসেছিলাম সেই একই এন্টোনভ বিমান আর আমাদের পূর্বপরিচিত ক্যাপ্টেন আর তাঁর সহকারী। হাসি-করমর্দন-কুশল বিনিময়। মেচুকায় আমাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্পসল্প। তার মধ্যেই উদয় হল তিনটি ছেলেমানুষ ছেলে। পিঠে একটা করে ছোট স্যাক। চেহারায় পষ্ট মালুম হচ্ছে কলেজপড়ুয়া। তাঁরা তিনজনে ডিব্রুগড়ে কলেজ হস্টেলে ফিরতে চায়। ক্যাপ্টেন বেশ কড়া। এখন তো পুজোর ছুটি চলছে, হস্টেল যাবে কেন! নিজের বাড়ি ছেড়ে পুজোয় আড্ডার জন্যে হস্টেল ফেরা? ক্যাপ্টেনরা কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না; আর ছেলে তিনটি ততই ঢের পঢ়াই-এর ফর্দ শোনায়। শেষে ক্যাপ্টেন এক রফা চুক্তিতে পৌঁছলেন। আজ তোমাদের মধ্যে একজনকে নিয়ে যাব। অন্যেরা পরের দুটো সর্টিতে। তোমরা কেমন পড়াশোনা করছ সেটা বড়া মাস্টারসাব পরীক্ষা করবেন; তিনি যাকে বলবেন সেই আজ যাবে। কত কী যে ঘটে! আমরা আর কত অবাক যে হব! সেই বিকেলে এয়ার ফিল্ডে হিমাংশুদা ক্যুইজ মাস্টার। প্রথম ও দ্বিতীয় প্রশ্ন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল। তিনজনেই আকাশে তাকিয়ে। এমনকি পরের প্রশ্ন ভারতের স্বধীনতা দিবস কোনটি, সেটিতেও দুজনের দৃষ্টি আকাশচারী। একজনেরই সঠিক জবাব। সেই ছেলে প্রয়োজনীয় ফর্ম ভরে তৈরি। আমাদের ফিরতি পথের নতুন সঙ্গী। এন্টোনভ বিমানও তৈরি। সবাই নিজের নিজের সিট আঁকড়ে বসেছি আর প্লেনটা বিকট গোঁ-গোঁ শব্দে থ্রটল চূড়ান্ত বাড়িয়ে অল্প একটু দৌড়েই যেন ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মতো ভাঙাচোরা রানওয়ের মায়া কাটিয়ে গগনচারী।

আমার সাফাই
এখন প্রশ্ন হল, প্রায় তিরিশ বছর পরে এই লেখা লিখছি কেন? কেন না এই এত কর্মহীন সময় কখনও আগে হাতে পাইনি। ক্যাবিনেট সাফ করার সময় হঠাৎ খুঁজে পাওয়া মেচুকা বেড়ানোর গোটা কুড়ি-বাইশ পুরোনো রংচটা প্রিন্ট এই লেখার দ্বিতীয় উৎসাহ। না হলে এই চব্বিশ বছর পর কেন আর এসব লেখা! তখন বেশি ছবি তুলতাম ট্রান্সপ্যারেন্সি/স্লাইডে। সেসব ছবি বাক্স-বন্দি পড়ে আছে। সেগুলিকে ডিজিটাইজ করার সহজ উপায় এখনও আমার অজানা। ইতিমধ্যে অরুণাচলে ট্যুরিস্ট প্রোমোশনের বন্দোবস্ত হয়েছে। মেচুকাও এখন ট্যুরিস্ট নেটেই আছে। এখন জায়গা পাল্টে মস্ত আইবি তৈরি হয়েছে। একটি-দু’টি হোটেলও। বহু দুর্ঘটনা, বহু শ্রমিকের প্রাণের বিনিময়ে মেচুকা এখন সড়কপথে যাতায়াতের জন্য সুগম হয়েছে। শহুরে সভ্যতার অতি উজ্জ্বল আলো নিশ্চয় এখন মেচুকার আদিবাসীদের সরল জীবনের নিজস্ব প্রভাকে ম্লান করেছে। আমি সেই কোমল প্রভার হদিস দিতেই এই লেখা তৈরি করলাম। আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রয়াত ডা. পানুচন্দ্র সেনের কাছে; তাঁর সারাজীবন অরুণাচলে ডাক্তারি করার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার গল্পে আমাদের অনেক মশগুল সন্ধ্যা কেটেছে। অনেকটা সেই সব গল্প খোঁজার জন্যেও আমরা সেই গত আটের দশকের শেষ থেকে আজ অবধি বারবার ছুটে যাই অরুণাচলে। উদার নিষ্কলুষ প্রকৃতি আর সহজ জীবনের আনন্দ খুঁজে নিতে।
চিত্র: লেখক








3 Responses
নস্টালজিক! ইদানীং সড়ক পথে যোগাযোগ হওয়ার দরুন দলে দলে পর্যটক মেচুকায় পৌঁছে যাচ্ছেন শুনেছি। তবে এ মেচুকা সে মেচুকা নয়। খুউব সুন্দর লেখা।
অসাধারণ অভিজ্ঞতার অপূর্ব বিবরণ , একসাথে অনেককিছু জানতে পারলাম – Adventure, History, Natural beauty এবং সেখানকার সহজ সরল মানুষের ব্যবহার আর তোমাদের মনের জোর ও জেদ । খুব ভাল লাগল।
দারুন অভিজ্ঞতা । আর লেখার সাথে প্রাণবন্ত সব ছবি। লেখক সব অভিজ্ঞতা পাঠককে উজাড় করে দিয়েছেন ।