Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

গুলজারের একগুচ্ছ কবিতা

গুলজার

ভাষান্তর : সঙ্গীতা দাস

কবর

কুয়ো বোজানো হচ্ছিল
দম আটকে আসছিল কুয়োর
কয়েক মণ মাটি ফেলা সারা
বহু তক্তা কাটা হয়েছে

দুধার থেকে লোহার রড সাজিয়ে
প্রবীণ মিস্ত্রি ডেকচিতে সিমেন্ট গুলে ছড়িয়ে দিচ্ছে চারধারে
কুয়ো বোজানো হচ্ছিল।

ডানা ঝাপটিয়ে কুয়োর জলে স্নান সারত
চিন্তিত সে আজ…
পিপুল শাখায় উড়ে বেড়িয়েছে সারা দুপুর
বড় অস্থির হয়ে আছে ঘুঘু।
সংবিগ্ন পাখি বুঝতে পারে না
একটা জ্যান্ত কুয়োকে মানুষ কেন কবর দিচ্ছে!

নদী

নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে বয়ে যায় নদী
ছোট ছোট স্বপ্নে বুনে রেখেছে মন…
বালি তীরে আছড়েপিছড়ে তো জীবন কাটল,
এখন ব্রিজের উপর উঠে বইতে চায় সে।

শীতকালে যখন কুয়াশা এসে ঢেকে দেয় ওর মুখ
আর হাওয়া ধুতির খুঁটে মুছে দিয়ে যায় অবয়ব,
কোন একবার সেও উড়ে যাবে ওই হাওয়ার সাথে
আর উধাও হয়ে যাবে এই অরণ্য ছেড়ে।

কখনও এমন হয়
ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রেন চলে যায় আর এই বহতা নদী থেমে যায় মুহূর্তকাল
একটি অভিলাষ নিয়ে…
হয়তো এক দিন আর একবার দেখতে পাবে সেই মেয়েটির মুখ
যে ফুল তুলসীতে পুজো দিয়ে নিজের বর কামনা করেছিল নদীর কাছে।

সেই মেয়েটিকে ধরে রেখেছে নদী
তার প্রতিবিম্বে।
আমিও রেখে দিয়েছি তার ছবি মনের অতলে।

সেপ্টেম্বর

সেপ্টেম্বরের আকাশ
অসুস্থ থাকে প্রত্যেক বছর
কী যেন এলার্জি আছে সম্ভবত…

সেপ্টেম্বর আসতেই বৃষ্টির জল শুকোতে থাকে আর
মেঘের টুকরো, ময়লা ন্যাকড়ার মত
পড়ে থাকে সারাদিন, শুষ্ক, খিটখিটে রোদ্দুরে…

ফুস্কুড়ি দেখা দেয় সন্ধে হতেই আকাশের সারা পিঠে
আর লাল হয়ে ওঠে আকাশের একটা কোণ
বিষাক্ত এক বিছে কামড়েছে যেন।

অনেক দিন ধরে কাশতে থাকে আকাশ আর
লাল, কালো ঝড় বয়ে যায়।
সেপ্টেম্বরে বড় অসুস্থ থাকে আকাশ আমার।

জাদুকর মেঘ

আসো মেঘেদের পরত খুলে খুলে দেখি
এদের আলখাল্লার ভিতরে
লুকোনো পকেট আছে নিশ্চয়

আসো পকেটগুলো সব হাতড়ে খুঁজি
কোথায় জলের ফোঁটা?
কোথায় শিলাবৃষ্টি লুকোনো আছে?
কোথায় যে রাখে ডমরু!
বাজালেই চমকে ওঠে বাচ্চারা

কোনও একটা বেল্টে
বিজলির চাবুকও লুকোনো আছে
হাওয়ার ঝাপটা ভরা সব বেলুন… তাও পাবে
তোমাদের মনে হয় না এই মেঘ আসলে
চতুর জাদুকর!

নদীর গল্প শুনি

এক নদীর গল্প শুনি…
কবির কাছে তার প্রশ্ন ছিল,
রোজ দুটি তীর দুই হাত ধরে আমার,
সিধে পথে বইয়ে দেয়।
রোজই তো আমি
বোঝাই নৌকা পিঠে নিয়ে
পার করে আসি কত মানুষ

রোজ অবুঝ শিশুর মত ঢেউ
এসে হিজিবিজি লিখে যায় আমার বুকে

এমন কি হতে পারে
যে কিছু হল না
কিছুই না…
আর আমি নিজের তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে
এক সন্ধ্যা থেমে থাকি
বসে থাকি।
যেভাবে পাঠ শেষে কবিতা পড়ে থাকে স্থির।
আমি পড়ে থাকি।

অরণ্য

অরণ্যের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয়
আমার পূর্বপুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন,
আমি এক নবজাতক
এই গাছেদের গোষ্ঠী
উঠে এসে আমাকে দোলায় তাদের শাখায়

একজন ফুলের ঝুমঝুমি বাজায়, তো আরেকজন
চোখের পাতায় ছিটিয়ে দেয় সুঘ্রাণের পিচকারি
শ্মশ্রুময় অতিবৃদ্ধ বট, আমায় কোলে নিয়ে
অবাক হন, বলেন:
এখন তুমি হাঁটতে পারো!
একসময় আমাদেরই মত ছিলে তুমিও,
শিকড় ছিল মাটিতে
সূর্য ছোঁয়ার আশায় সর্বশক্তি ব্যয় করতে তুমি
তোমার আগে এসেছি পৃথিবীতে
টলমল পায়ে হাঁটতে দেখলাম তোমায়…
আমাদের শাখায় চড়তে, ঝাঁপ দিয়ে পড়তে
লাফালাফি করতে অনেক
কিন্তু দুপায়ে স্থির হয়ে যেদিন দৌড়লে, আর ফিরলে না
পাথর আর পাহাড়ের অংশ হয়ে গেলে তুমি!

কিন্তু সে যাই হোক…
তোমার শরীরে জল আছে
তোমার শরীরে মাটি আছে
আমাদেরই একজন…
আমাদের মধ্যেই আবার বপন করা হবে তোমায়
ফিরে আসবে আবার!

বৃক্ষ

বৃক্ষ যখন স্থির হয়ে ভাবে তখন ফুল ফোটে।
রোদ্দুরে আঙুল ডুবিয়ে সে
ভাবনা লিখে রাখে আনত শাখায়।
রংবেরং শব্দ কুড়োয়
সুঘ্রাণে সুঘ্রাণে কথা বলে আর ডাক পাঠায়।

আর আমাদের শখ দেখুন…
কোথাও কেউ যখনই জেগে ওঠে সুবাসে
তার গলা কেটে নিই আমরা!

হেমন্তের পাতা

হেমন্তে যেদিন পাতা ঝরে যায়
কী বলে যায় গাছের শাখাকে?

‘আমরা তো নির্ধারিত ঋতুচক্র যাপন করে
ফিরে যাই
তুমি ভালো থেকো—
তোমাকে তো আসন্ন ঋতুর সন্তান
লালন করতে হবে
তারপর তাদেরও বিদায় দিতে হবে’

এবার ডালপালা ছাঁটার সময় এল
শাখা বলে গেল গাছকে…
আমার আয়ু তোমার হোক…
তোমাকে তো বড় হতে হবে,
উচ্চে উঠে যেতে হবে আরও
নতুন ডালপালা নিয়ে সবুজ হবে আবার,
আমাকে মনে রেখো না!

বৃক্ষ কী বলবে মাটিকে,
যখন খুঁড়ে খুঁড়ে ছিঁড়ে ফেলল শিকড়ের সেলাই
আর বিচ্ছিন্ন করল ভূমি থেকে!

উলটে মাটিকেই তো বলতে হল…
মনে আছে, একটা ছোট বীজ থেকে
তুমি উঁকি দিয়ে দেখেছিলে
যেদিন প্রথম পাতা বেরোয়!
আবার এসো, আর আমার গর্ভ থেকে জন্ম নিয়ো
যদি আমি নিজে বেঁচে থাকি!

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

One Response

  1. বেশ ভালো লাগলো । আগে কখনও গুলজারের অনুবাদ পড়িনি ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 + sixteen =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »