Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

থাম গ্রামের বৌদ্ধমঠ

পাহাড়ের কাছে কী-ই বা চাওয়ার থাকতে পারে! শান্তি, নির্জনতা, গাম্ভীর্য? কোনও এক দার্শনিক পাহাড়কে পৃথিবীর ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। সেই ‘স্মৃতিস্তম্ভে’র এক কোলে থাম গ্রাম। গ্রামের কাছে আপার ঘাইলেটার। জায়গাটি পশ্চিমবঙ্গের সিটং-১-এ। প্রাচীন এক বৌদ্ধবিহার রয়েছে ওই গ্রামে। স্থানীয়রা বলেন, এর বয়স ২০০ বছরেরও বেশি।

মাটি ও বাঁশ দিয়ে তৈরি এই বৌদ্ধবিহার। লাট মহলদিরাম রোডের পাহাড়ি রাস্তার পাশে হাঁটার পথ, সবুজ গাছপালা ঘেরা। পথের বাঁ ধারে এক্কেবারে নাকবরাবর মান্দার বা পারিজাত ফুল ফুটে। লাল ‘স্বর্গীয়’ পারিজাতে বসে মধুপান রুফাস সিবিয়া পাখির। মেরুন-কালো-নীল রঙের মিশেলের সুন্দর পাখিটি আমাদের দেখে বিচলিত হল না। দূরে আরও একটি মান্দার গাছেও সমান তালে পাখিদের আনাগোনা।

রুফাস সিবিয়া পাখি।

এ দিকে, মেঘলা দিন যায় যায়। গোধূলির আলোও প্রায় বের হয়নি। এলিয়ে পড়ছে সন্ধ্যা। ১০০ মিটার ছোট্ট হাঁটার পর নজরে পড়ে বৌদ্ধমঠটি। প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না, মঠ কোনটা। মঠটি বাইরে থেকে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরের মতো। এর প্রকৃত নাম আপার ঘাইলেটার লংহো লেপচা বৌদ্ধমঠ। অনেকেই এই নাম জানেন না। কেউ কেউ একে লেপচা মনাস্ট্রি ডাকেন। কেউ-বা মানা গ্রামের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে মানা মঠও বলেন। অনেকের কাছে থাম মনাস্ট্রি নামেও পরিচিত।

মঠটি বাইরে থেকে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরের মতো।

মঠের সামনে কয়েকটি চোরটেন বা স্তূপ। চারিদিকে অসংখ্য বৌদ্ধ মন্ত্র লেখা পতাকা। হঠাৎই এক বৃদ্ধা আমাদের বললেন, ‘ভিতর নেহি জায়েঙ্গে?’ আমরা, মানে আমি আর স্ত্রী ‘বিলকুল জায়েঙ্গে’ বলে জুতোজোড়া খুলে আগুয়ান। মাটির মেঝে ধরে ভিতরে যেতেই কে যেন অস্ফুটে জিজ্ঞেস করলেন, ধর্মের কাছে কী খোঁজো? এর উত্তর শান্তি— হ্যাঁ, শান্তি খুঁজি। এই শান্তি মানে কিন্তু সংঘাতের অনুপস্থিতি নয়, এই শান্তি বৈষয়িক বিষধর ছোবলের মলম। এত নির্মল ও শান্ত জায়গা বহুদিন পর দেখছি। নির্মল দিনে, যেদিন রোদের সরগম লেখে সূর্য, এই মঠ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়াগুলি দেখা যায়। তবে, সেখানে ‘গাভীর মতো মেঘ’ চরতে দেখাও কম সৌভাগ্যের নয়।

এটিই সিটং-এর একমাত্র বৌদ্ধবিহার।

জানলাম, বৌদ্ধমঠে রূপান্তরিত হওয়ার আগে এটি লেপচা রানি মহল (লেপচা রানির প্রাসাদ) ছিল। এটিই সিটং-এর একমাত্র বৌদ্ধবিহার। লেপচা বৌদ্ধ সম্প্রদায় যার পরিচালনার দায়িত্বে।

Advertisement

মঠের ভিতরে কেবল একটিই প্রার্থনা-ঘর। সামনে একটি বড় কাচের কেস। ভিতরে প্রধান সোনার মূর্তিটি গুরু রিনপোচের। জানিয়ে রাখি, এই রিনপোচেই কিন্তু গুরু পদ্মসম্ভব। তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ৭৪ খ্রিস্টাব্দে আবির্ভূত হয়ে ৫৪ বছর অতিবাহিত করেন। পদ্মসম্ভব তান্ত্রিক বৌদ্ধ বজ্রযান। এই লেপচা মঠের পদ্মসম্ভবের পাশে একটি ছোট বুদ্ধের মূর্তি। নীচে বিভিন্ন বৌদ্ধ দেবতার আরও কয়েকটি ছোট মূর্তি রয়েছে। জ্বলন্ত ধূপকাঠি। আলো-আঁধারি ঘেরা পরিবেশ যেন গভীর ধার্মিকতার অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলেছে।

মঠের সামনে কয়েকটি চোরটেন বা স্তূপ।

প্রার্থনা-ঘরের ভিতরে দুটি প্রধান স্তম্ভ। একটিতে অদ্ভুত এক মূর্তি। দেবী কালীর মতো দেখতে। অবাক হয়েছি। ধর্মীয় সংস্কৃতি হয়তো এভাবেই মিশে যায়। অন্য স্তম্ভেও শক্তির প্রতীক। চারপাশেও অনেক দেবদেবী। দেওয়ালে কিছু প্রাচীন ম্যুরাল, রংচটা, আঁকা বা মূর্তি রয়েছে শয়তান বা অসুরেরও। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা লাগ-না (এক ধরনের বাদ্য, ডাফলির মতো দেখতে), রোলমো (এক ধরনের করতাল)-সহ আরও কিছু। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির উৎসবে এসব ব্যবহার করেন। জায়গাটি কিন্তু আদর্শ পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।

অদ্ভুত এক মূর্তি। দেবী কালীর মতো দেখতে।

শুনেছি, মঠে কিছু ধাতব ট্রাঙ্ক বাক্সের কথা। সেখানে লেপচা রানির শাসনামলের কিছু দুর্লভ জিনিসপত্র এবং শিল্পকর্ম সংরক্ষিত। মনে হয়, সংরক্ষিত জিনিসপত্রগুলি রানির আমলেরও বহু আগের। এর মধ্যে রয়েছে সেই যুগের একটি পুরনো তলোয়ার এবং একটি বর্ম। বর্মটিকে ভারী দেখালেও আসলে বেশ হালকা এবং একই সঙ্গে এতটাই শক্তিশালী যে, এটি আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে অনায়াসে ব্যবহার করা যায়। ওই বৃদ্ধা সংরক্ষিত ষাঁড়ের শিং আমাদের দেখালেন। পুজোয় ব্যবহার হত। বললেন, এখানে পাথরের শিলালিপিও রয়েছে। এভাবেই বেলা ফুরায়। মঠের ভিতরে রাখা দানবাক্স। সেখানে সাধ্যমতো দিয়ে মূল ফটকে পা দিয়েছি, বেরোব, একদল পর্যটক ঢুকলেন। তাঁদের মধ্যে এক মাঝবয়সি মহিলা দীর্ঘকেশী। তাঁর গলায় ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’। বুদ্ধের চরণে প্রণাম প্রণাম। তাঁর কাছে পর্যটক নয়, পরিব্রাজক যাপন কি আমরা চাইতে পারি?

চিত্র: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × five =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »