চিল্পা
ছুটি আমার কাছে অভিশাপ। দীর্ঘ কোনও ছুটি পেলেই মন তাই আনন্দে ভরে ওঠার পরিবর্তে কেঁপে ওঠে। এই কোনও অঘটন ঘটল। অঘটন ঘটেও। তবে অঘটনের আশঙ্কায় তো আর একটু বেড়ুবেড়ু করার সুযোগ হেলায় হারাতে পারি না।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে অখিলেশের চিঠি এল। চিঠি এসেছে বিহারের সুরগডিহি হতে। আমার বন্ধু অখিলেশ সুরগডিহির রেঞ্জার। সে যখন গ্রামে আসে, ওই পাণ্ডববর্জিত এলাকা সম্বন্ধে অনেক গল্প বলে। মুগ্ধ হয়ে যাই। আজ যখন তার চিঠি এল, তখন সে চিঠির মধ্যে সদ্যপ্রস্ফুটিত কুর্চির সুবাস পেলাম যেন। অখিলেশ লিখেছে–
প্রিয় বন্ধু সজল,
আশাকরি কুশলে আছ। বহুদিন তোমাদের কোনও খবর পাই নাই। এখানে এত কাজ যে ছুটিছাটাও মিলছে না। মন তাই কেঁদে মরছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি ছুটে যাই গ্রামে, তোমাদের সাথে কিছু সময় কাটাই। এদিককার যা অবস্থা দেখছি তাতে বড়দিনের আগে গ্রামে ফিরতে পারব না। আর কয়েকদিন পরেই তো তোমার ছুটি পড়ছে, চলে এসো না এখানে। দুই বন্ধু মিলে আনন্দফুর্তিতে কাটাই কয়েকটা দিন।
মোবাইল নেটওয়ার্ক এখানে নেই বললেই চলে। তাই কখন আসছ পত্র লিখে জানাবে। আমি তোমার জন্য কোডার্মা জাংশনে অপেক্ষা করব।
ইতি তোমার বন্ধু
অখিলেশ সরখেল
সুরগডিহি, বিহার
অখিলেশ ডেকেছে আর আমি যাব না, এ হয় না। এদিকে পুজোর ছুটিও পড়ে গেছে। সুতরাং শুভস্য শীঘ্রম। ব্যাগপত্তর গুছিয়ে রওনা দিলাম সুরগডিহির উদ্দেশে।
সুরগডিহি বিহারের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল। বিহার-ঝাড়খণ্ডের সীমান্ত বরাবর যে পাহাড়-জঙ্গল, অখিলেশ সেখানকারই একটা ছোট্ট রেঞ্জের রেঞ্জার। মাঝে মাঝে গ্রামে এলে ওর মুখে সুরগডিহির গল্প শুনি। সৌন্দর্যের খনি সেই বনপাহাড়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে যাই। এতদিন পর সেই স্বপ্ন বাস্তব হতে চলেছে ভেবেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল।
যে ভ্রমণে যত উৎসাহ জাগে তাতে উপদ্রবও হয় তত বেশি। আর সেটা টের পেলাম ট্রেনে উঠেই। আমার বার্থ অলরেডি দখল হয়েই আছে। শুয়ে আছে মোটাসোটা কালো মিশমিশে একটা হুলো। যাত্রীবাহী ট্রেনে পশুপাখি নিয়ে ওঠা নিষিদ্ধ বলেই জানতাম। তবে কে আর নিয়ম মানে।
হুলো বাবাজি উঠতে চায় না। সে আমার দিকে লাল লাল চোখ করে থাবা মারতে আসে। আমি রণে ভঙ্গ দিলাম। মেঝেতে লাগেজ রেখে লোয়ার বার্থে বসে পড়লাম। কৃতকর্মের অনুশোচনায় কিনা জানি না, হুলোটা নেমে এল। তারপর খোলা জানালা দিয়ে মারল ঝাঁপ। চলন্ত ট্রেন থেকে ওভাবে ঝাঁপ দেওয়ার পর হুলোটার পরিণতি ভেবে শিউরে উঠলাম।
নিজের বার্থের দখল পেলাম বটে কিন্তু হুলোটার কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল। রাত গভীর হয়ে আসছে। কামরার সবাই যে-যার মতো সুখনিদ্রা দিচ্ছে। আমারও দু’চোখ জুড়ে তন্দ্রা নেমে এল। ঘুমের ঘোরে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলাম। সেই কালো বিড়ালটা আমার বুকের ওপর বসে আছে। ওর সামনের একটা পাঞ্জা হতে তীক্ষ্ণ ছুরির মতো নখ বেরিয়ে আছে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, আমার কণ্ঠনালি ছিন্ন করতে চায় ও। দেহের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে উঠে বসলাম। ছুড়ে ফেললাম ওই শয়তানটাকে। ওর গরগরানিতে চারপাশের নিস্তদ্ধতা খানখান হয়ে গেল।
ঘুম ভেঙে গেল। দরদর করে ঘামছি। ওপাশের আপার বার্থটার দিকে নজর যেতেই দেখলাম হুলোটা বসে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে লাল লাল চোখ নিয়ে। এরপর একসময় আগের মতোই জানালা দিয়ে লাফ মেরে চলে গেল ও। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
আর ঘুম হল না। ট্রেন এমনিতেই লেট, তার ওপর ধানবাদের পর এক নির্জন প্রান্তরে দাঁড়িয়ে গেল। ওভারহেডের তার ছিঁড়ে গেছে। অর্থাৎ দুর্ভোগ শুরু। অবিশ্বাস্যভাবে হুলোটাকে এখানেও দেখলাম। ট্রেনের মাথায় যেখানে ওভারহেডের তারের সাথে সংযোগ হয়, সে জায়গায় বসে আছে। আমি এখন সম্পূর্ণ নিশ্চিত ওটা বিড়াল নয়, কোনও অশুভ কিছু।
কোডারমা পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেল। তবে স্বস্তি একটাই, স্টেশনে নামতেই পরিচিত মুখটা নজরে পড়ল। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, ‘তুই যে বুনো হাতি আর হাড়িবাঘের সেবাশুশ্রূষা ছেড়ে আমাকে নিতে আসবি, জাস্ট ভাবতেও পারিনি। তাছাড়া ট্রেন যে পরিমাণ লেট করল, তাতে আমি ভেবেছিলাম তুই ফিরে গেছিস।’
মুচকি হেসে অখিলেশ বলল, ‘অন্তরের টান বন্ধু। তোকে না নিয়ে ফিরে যাব একথা ভাবলি কী করে! মাঝরাত হয়ে গেলেও তোর জন্যে বসে থাকতাম।’
ঠিক এজন্যই অখিলেশকে আমার ভাল লাগে। ও কথা দিলে, কথা রাখতে জানে। সত্যি বলতে কী, ওর জায়গায় আমি হলেই পেরে উঠতাম না। বিরক্ত হয়ে ফিরে যেতাম। ওর ধৈর্য আছে।
স্টেশনের বাইরে অখিলেশের জংলি কালারের জিপখানা দাঁড়িয়ে। এই জিপটার কথা ওর মুখে বহুবার শুনেছি। জিপখানার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে বলত, ‘ডিপার্টমেন্টের গাড়ি। বহুকাল পড়ে ছিল। আমিই উদ্যোগ নিয়ে রেস্টোরেশন করিয়েছি। এই বন-পাহাড়ে জিপে চড়ে ঘোরার মজাই আলাদা।’
আজও সেরকমই প্রশংসা করে চলেছে ও। তবে আমার চোখ আটকে আছে জিপের পেছনের সিটে। ওখানে বসে আছে মুশমুশে কালো রঙের সেই হুলোটা। আমার দিকেই হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অখিলেশ নিজেই ড্রাইভ করে এসেছে। ওর পাশের সিটেই বসলাম। হুলোটাকে পাত্তা না দিয়ে অখিলেশের সাথে খোশগল্প শুরু করলাম। হুলোটা একরকম বিরক্ত হয়েই লাফ মারল গাড়ি হতে।
করতে আমরা চলেছি রাঁচি-পাটনা সড়ক বরাবর। বাগিটাঁড়ের পর থেকে দু’পাশের চিত্র পাল্টে যেতে লাগল। কেবল সবুজ আর সবুজ। সবুজের এত সমারোহ দেখিনি কখনও। প্রকৃতিমাতা তার সবুজ আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে। আমাকে প্রকৃতির রূপে এমন বিভোর দেখে অখিলেশ বলল, ‘কী রে সম্মোহিত হয়ে গেলি? হওয়াটাই দস্তুর। প্রথম যখন আসি, আমিও প্রকৃতির রূপে বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম। স্নেহময়ী জননী বলে ভেবেছিলাম। কিছুদিন কাটতেই সে ভ্রম দূর হল। বুঝলাম, ওই রূপ আসলে একটা ছদ্মবেশ আর তার আড়ালে লুকিয়ে আছে নিষ্ঠুর এক চেহারা। প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করে না, ভালবাসে না।’
‘আরে দাঁড়া দাঁড়া, গ্রামে গেলে তো সুরগডিহির প্রশংসায় ভরিয়ে দিতিস, এখন সুর বদলালি কেন? এনি প্রবলেম?’
কেমন যেন উদাস হয়ে গেল অখিলেশ, বলল, ‘সমস্যা তো সব জায়গাতেই আছে। বন্ধুদের সাথে বসে কর্মক্ষেত্রের গল্প করলে প্রশংসাই করতে হয়। নেগেটিভগুলো যত টেনে আনবি ততই মনের ওপর চাপ বাড়বে। কয়েকদিনের জন্য গ্রামে গিয়ে আনন্দফুর্তি করব, না সমস্যার কথা বলে মন ভারাক্রান্ত করব?’
কথাটা শেষ হতে না হতেই জিপের সামনে এসে পড়ল একজন। বৃদ্ধ আদিবাসী। চোয়াল ভেঙে গিয়েছে, মাথার কোঁকড়ানো চুল যেন সাপের লকলকে ফণা, মুখে বিচিত্র আলপনা। লোকটাকে দেখেই মনে ভয়ের সঞ্চার হয়। লোকটা গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই স্পিড বাড়িয়ে দিল অখিলেশ। আমি চিৎকার করে বললাম, ‘এ কী করছিস অখিলেশ, লোকটা মরে যাবে যে! স্টপ অখিলেশ স্টপ!’
আমার কোনও কথা শুনল না অখিলেশ, লোকটার ওপরেই চালিয়ে দিল গাড়ি। লোকটা বোধহয় আর বেঁচে নেই। এদিকে গাড়ি হতে নেমে যে লোকটার কাছে যাব, তারও উপায় নেই। গাড়ি চলেছে ঝড়ের গতিতে। পাগল হয়ে গেছে অখিলেশ। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। বেড়াতে আসার আনন্দটা আর রইল না। এরকম নিষ্ঠুর খুনি একটা লোকের সাথে ছুটি কাটানো জাস্ট অসম্ভব। না, ফিরেই যাব। তবে এখন এসব কথা বলা যাবে না। যে ঠান্ডামাথায় একজনকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে পারে, সে আমাকেও রেয়াত করবে না। অতএব সাবধানে কথা বলতে হবে।
কিলোমিটার দুয়েক এগিয়ে যেতেই চমকে উঠলাম। সেই লোকটা। সেই বুড়ো আদিবাসী। কিন্তু তা কী করে হয়। ও তো দু’কিলোমিটার দূরে পড়ে আছে আহত বা নিহত হয়ে। অখিলেশ কিন্তু নির্বিকার। সে আবারও ওই লোকটার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিল। আমার বুক কাঁপছে। এবার আর অখিলেশের নৃশংসতায় নয়, অজানা ভয়ে। আর ভয়টা আরও লাগছে ওই লোকটার চোখদুটোর কথা ভেবে। লোকটার চোখদুটো একদম সেই হুলো বিড়ালটার চোখের মতো।
এ ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটল। প্রথমে কালো হুলো বিড়াল আর তারপর এই লোকটা, আমার ওপর কি কোনও অশুভ শক্তির বদনজর পড়েছ? না না, এ নিয়ে বেশি কৌতূহল দেখানো যাবে না। ওই অশুভ শক্তি যে আমার সাথে এসেছে, তা অখিলেশকে বুঝতে দিলে হবে না।
এদিকে অখিলেশও চিন্তিত। সারা রাস্তা আর একটিও কথা বলল না ও। তবে বনবাংলোর সামনে এসে গাড়ি থামতেই আবার মুখর হল।
‘এখানে এমন কিছু ঘটনা আকছার ঘটে, যার কোনও ব্যাখ্যা হয় না। অথবা হয়তো হয়। ওদের সাথে মানিয়ে নিলে সমস্যা নেই, কিন্তু কৌতূহলী হলেই বিপদ। যে বিপদে আমি পড়েছি। আয় ভেতরে আয়, আছিস যখন, তখন সব বলব। নিজেও অনুভব করতে পারবি।’
ওসব অলক্ষুণে অনুভব করতে বয়েই গেছে আমার। সেই ট্রেনে ওঠা অব্দি অশান্তিতে অশান্তিতে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেল। ট্রেনের ঘটনা অখিলেশকে বলা যাবে না। আমি এসেছি বনপাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আর দেশি মোরগের রোস্ট খেয়ে জিহ্বার সন্তুষ্টিবিধান করতে। নিরাপদে যখন পৌঁছে গেছি, তখন ওসব অলক্ষুণে ব্যাপার নিয়ে আর মাথা ঘামাব না।
অখিলেশ অবশ্য হতাশ করল না আমাকে। প্লেটের উপর কাঁচা শালপাতার পাতায় এল গরম ভাত, লাল করে মাখা আলুসেদ্ধ, আর তার সাথে দেশি মুরগির ঝোল। প্রাণ জুড়িয়ে গেল।
রাত হলেই তাপমাত্রা অনেকটা নেমে যায় এখানে। সাথে আছে ঝিঁঝিঁপোকার অবিশ্রান্ত ডাক। ঘুম আসছে দু’চোখ জুড়ে। অখিলেশ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তার নাকের ডাক মিশে যাচ্ছে ঝিঁঝির ঐক্যতানের সঙ্গে। হঠাৎ জানালার দিকে নজর গেল। জানালার ওপারে দুটো চোখ। না, বাঘ-ভাল্লুক নয়, ওই চোখ আমি চিনি। কালো মুশমুশে হুলোটা বসে আছে। ভয়ে চোখ বুজলাম।
সকালবেলা বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে উঠল সেই আদিবাসী লোকটার প্রসঙ্গ। অখিলেশেই প্রসঙ্গ তুলল। ওর কথায় বুঝলাম, লোকটা সম্বন্ধে অনেককিছু জানে ও। আমারও কৌতূহল হল। আর সে কৌতূহল প্রকাশ করতেই আনমনা হয়ে গেল অখিলেশ। সে কী ভাবতে লাগল।
এরপর চায়ের কাপে সুরুৎ করে একটা চুমুক দিয়ে বলল, ‘শুনবি তা হলে… শোন। বছর তিনেক আগের কথা, সবেমাত্র ট্রান্সফার পেয়ে এসেছি এই সুরগডিহিতে। এরকমই এক বিকেলে এসে নামলাম কোডার্মা স্টেশনে। সঙ্গে একগাদা লটবহর, ট্রেন হতে নামতেই কুলি এসে ধরল। ওর মাথায় বাক্সপ্যাটরা চাপিয়ে দিয়ে বললাম, ‘সুরগডিহি যাব, অটোফটো কিছু পাওয়া যাবে তো?’
‘সুরগডিহি? যাতে যাতে আঁধেরা হো যায়েগা। না বাবু, ইস সময় সুরগডিহি যানেকা গাড্ডি নেহি মিলেগা।’
‘সেকী! তা হলে তো ভারি সমস্যা হয়ে যাবে। তোমার চেনাজানা কেউ নেই? দেখো না, পয়সা যা লাগে দেব।’
চেষ্টার ত্রুটি করল না ও। কিন্তু কোনও গাড়িই সুরগডিহি যেতে চাইল না। তাদের একটাই কথা, রাস্তা জনহীন এবং বিপজ্জনক। অতএব লাখ টাকা দিলেও এত রাতে তারা ও পথে যাবে না। কী আর করার, মালপত্র নামিয়ে রেখে বসে পড়লাম ওখানেই। দেখতে দেখতে অন্ধকার নেমে এল। শেষ ট্রেন চলে গেলে ভাড়া গাড়িগুলোও একে একে চলে গেল। আর কোনও উপায় নেই। স্টেশনে বসে থাকলেও কাজের কাজ হত, কিন্তু কীই বা করার! এখানেই রাতটুকু কাটিয়ে দেব। সকালে নিশ্চয়ই একটা না একটা উপায় হবে।
‘ও বাবু… বাবু…।’
ডাকটা শুনেই পেছন ফিরলাম। লণ্ঠন হাতে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণিমার রাত হলেও আকাশে মেঘ করে আছে। ফলে আলোআঁধারিতে মুখটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে মোটামুটি একটা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে। লোকটা সামনে এসে দাঁড়াতেই চেহারা স্পষ্ট হল। ওর লণ্ঠনের আলোয় ওকে দেখলাম। চল্লিশোর্ধ আদিবাসী, পরনে খাটো ধুতি আর মাথায় বাঁধা ময়লা একখান গামছা। চোখদুটো যেন জ্বলছে।
‘সুরগডিহি যাবি?’
বেশ অবাক হয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কীভাবে জানলে?’
‘কী জি বলিস বাবু, অতক্ষণ ধরে গাড়িগুলার সঙ্গে কথা বলছিলিস। আমি সব শুনেছি। যাবি ত আয়। আমি লিয়ে যাব। উরা সব ভয়পুকটে, কলজের জুর নাই।’ বলেই হাসল লোকটা। হাসির সাথে সাথে ওর হলদেটে দাঁত বেরিয়ে পড়ল। লণ্ঠনের আলোয় যেন ঝকমক করছে। তা করুক, আমার সুরগডিহি পৌঁছনো নিয়ে কথা, সে যেভাবে যার সাথেই হোক।
মালপত্র তুলে নিল লোকটা। আমি ওর লণ্ঠনটা ধরলাম। বেশ কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখলাম, একখানা টোপর লাগানো গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মালপত্র গাড়িতে তুলে দিতেই উঠে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। নিঃশব্দে গাড়ি ডাকাচ্ছে লোকটা। আমিই আগ বাড়িয়ে কথোপকথন শুরু করলাম।
‘ভয়েডরে যেখানে কেউ এ রাস্তায় একা যেতে রাজি নয়, সেখানে তুমি একাই গরুর গাড়ি হাঁকিয়ে চলেছ, ভয় করে না?’
‘ডর করলে কি চলে বাবু? প্যাটে খিদে লাগলে ডর লাগে না। যার প্যাটে আগুন জ্বলে, তাকে দেখে সুবাই ডরায়। প্যাটে আগুন জ্বলছে বাবু, আগুন। ই আগুন লিভে না ক্যানেলে? সিই কতকাল হতে যি খিদে…।’
আহা রে, গরিব মানুষ পেটভরে খেতেও পায় না। ব্যাগ হতে পাউরুটি বের করলাম। জ্যামের কৌটো বের করে জ্যাম লাগাতেই যাব, এমন সময় একটা হাত এগিয়ে এসে শুকনো পাউরুটি ছিনিয়ে নিয়ে গেল। বুঝলাম খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু লোকটার বসার জায়গা হতে আমার বসার জায়গার আনুমানিক মাপ নিয়ে ধন্দে পড়ে গেলাম। এতবড় হাত হয়!
এমনও হতে পারে লোকটা এগিয়ে এসে রুটিটা নিয়ে গেছে। একে অন্ধকার রাত, তাতে চারপাশে জঙ্গল, একা অচেনা আদিবাসী লোকের গরুর গাড়িতে বসে আছি, মনের এরকম বিকার হওয়াই স্বাভাবিক। সহজ কিছুকেও জটিল লাগছে। স্বাভাবিক জিনিসকেও অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এটাই হিউম্যান সাইকোলজি।
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে জলের মতো। যদিও সে সময় মাপার উপায় নেই। ঘড়ি বিকল, গরুর গাড়িতে ওঠার পর হতেই বন্ধ হয়ে গেছে। কোনওভাবেই চালু করা যাচ্ছে না। ফোন ডেড। তবে আন্দাজ বলছে, কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। রাস্তা আর কতটা কে জানে।
‘ও কাকা আর কতটা পথ? রাস্তা যে শেষই হয় না। এতটা পথ তো নয়। রাতের অন্ধকারে পথ ভুল করো নাই তো?’
লোকটা বাঁদিকের গরুর লেজ মলে দিল, ‘হুররর্ হ্যাট… সবাই তাই বলে বাবু। আমরা নিকি ভুল রাস্তার গেইছি। ভুল আর ঠিকের বিচের কি উরা করবে বাবু? আপনিই বলেন। আর রাস্তার কথা যদি বলিস, উয়র কি শ্যাষ আছে বাবু। জেবনেরও জ্যামন শ্যাষ লাই, রাস্তারও শ্যাষ লাই।’
কী যে বলছে লোকটা, মাথায় ঢোকে না। এ ধরনের লোকের সাথে যতবার মোলাকাত হয়েছে, এই একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এরা না শুনবে অপরের কথা আর না নিজে বলবে যৌক্তিক কিছু। এদের কথার তালে তালে হ্যাঁ দিয়ে যাও শুধু। বললাম, ‘জীবনের শেষ নাই মানে? জীবনের পরেই তো মৃত্যু। আর মৃত্যু মানেই তো সব শেষ। মরার পরে কী হয় তা কি কেউ দেখেছে?’
‘কী যি বলিস বাবু, মরা মানেই কি জ্যাবনের শ্যাষ, শ্যাষ লয় বাবু। অই অই চলে এসেছি। হুররর হ্যাট…।’ বলেই গাড়ি ঢুকিয়ে দিল একটা ঝোপের ভেতরে। গরুদুটো ঝোপঝাড় ভেদ করে এগিয়ে যেতে থাকে। একটা সরকারি বনবাংলো যেটাতে ফরেস্ট অফিসার থাকবে, তার রাস্তা কখনও এরকম হতে পারে না। লোকটা কি মাতাল? নচেৎ মাথাখারাপ নিশ্চয়ই।
‘করছ কী… এদিকে যাচ্ছ কোথায়?’ চিৎকার করে উঠলাম। ততক্ষণে গাড়ি এসে থেমেছে একটা বাংলো টাইপের বাড়ির সামনে। আবছা আলোয় বাড়িটাকে দেখেই মনে স্বস্তি এল। আর যাই হোক অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো গেছে। লোকটা গাড়ি হতে নেমে বড় লোহার দরজাটি খুলল। ক্যাঁচ করে বিশ্রী একটা আওয়াজ উঠল। কাছাকাছি কোথাও একটা রাতচরা পাখি বসেছিল সেই বিশ্রী আওয়াজে উড়ে গেল সে।
বাংলোতে বিদ্যুৎ নেই। লণ্ঠনের আলোয় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায় না। যেটুকু জানা গেল, আদিবাসী লোকটার নাম চিল্পা। সে এই বনবাংলোর কেয়ারটেকার। নতুন বাবু আসছে, এই খবরটা সে জানত।
‘তা হলে এতটা রাস্তা ওভাবে না-জানার ভাব করে এলে কেন? বললে না কেন যে, আমাকেই নিতে গিয়েছিলে।’ বেশ ক্ষোভের সাথেই বললাম। এতটা রাস্তা যেভাবে উল্টোপাল্টা বকতে বকতে এসেছে আর নিপুণ অভিনয় করে গেছে, তাতে চিল্পার প্রতি আমার আর কোনও ভালবাসা জাগছে না। হচ্ছে রাগ। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেও পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।
তবে চিল্পার মধ্যে কোনও বিকার লক্ষ্য করলাম না। সে নির্বিকারভাবে বলল, ‘রাতে কিছু খাবেন বাবু?’
মনে পড়ে গেল, গাড়িতে ওর পাউরুটি খাওয়ার দৃশ্যটা। বললাম, ‘বাংলোতে কি খাওয়ার মতো কিছু আছে? থাকলে ওভাবে গোগ্রাসে পাউরুটি চেবাতে না। নাকি সেটাও নাটক?’
চিল্পার ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে গেল। সে বলল, ‘আছে বাবু, আছে। তবে অ্যাত রাতে ভাত ত হবে না, দেখি কী করে দিতে পারি।’
চলে গেল ও। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। গা এলিয়ে দিলাম বিছানার ওপর। কাত হয়ে শুয়ে আছি, একটা কান বালিশে চাপা দেওয়া। হুলোর গরগরানি শুনলাম যেন। শব্দটা আসছে খাটের তলা হতে। এসব জায়গায় সাধারণ বিড়াল পাওয়া যায় না, এ নিশ্চয়ই বনবিড়াল। ব্যাটাকে না তাড়ালে অতিষ্ঠ করে মারবে।
বেশ বিরক্ত হয়েই উঠলাম। লণ্ঠন হাতে খাটের তলায় চোখ রাখতেই দেখলাম, একটা কালো মুশকো হুলো জ্বলন্ত চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরের কোণে একটা লাঠি ছিল, সাপ ধরার লাঠি। সেটা দিয়েই খোঁচা মারলাম। লাঠির খোঁচা লাগতেই ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেল হুলোটা।’
এতটা বলেই থামল অখিলেশ। ওর গল্পেও দেখছি হুলোটা রয়েছে। এবার আর থাকতে না পেরে ট্রেনের সব কথা অখিলেশকে বললাম। শুনে অখিলেশ বলল, ‘তোর প্রশ্নের উত্তর আমার গল্পেই রয়েছে। শুনলেই বুঝতে পারবি। হ্যাঁ, কতদূর বললাম যেন, ওই বিড়াল।
বিড়ালটা অদৃশ্য হয়ে যেতেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ও আমাকে কিছু বলার জন্য এসেছিল। বলতে পারল না। বা হয়তো বোঝাতে পারল না। ঠিক তখনই চিল্পা এল। টেবিলের ওপর একটা বাটি এনে রাখল। এরপর যেমন নিঃশব্দে এসেছিল, তেমনি বেরিয়ে গেল।
এত তাড়াতাড়ি কী খাবার বানাল চিল্পা! বাটিটা তুলে নিলাম। লালচে একটা তরলের কিছু ভাসছে। নাকের কাছে আনতেই আঁশটে গন্ধ পেলাম। সন্দেহ হতেই লণ্ঠনটা কাছে এনে ধরলাম। একী! টাটকা রক্ত টলটল করছে। আর সেই রক্তের মধ্যে ভাসছে মাংসের টুকরো। আমি আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠলাম।
আমার চিৎকার শুনে ছুটে এল চিল্পা। আমার মুখে সব শুনে বলল, ‘দেখি দেখি। ই মা, এত ডরপোক হলে চলে বাবু, ই রক্ত কুথা? ছাতুর সুপ করেছি। আগের বাবু খুব ভালবাসত। পাঁচ-সাত রকমের বুনো জড়িবুটি আর পরবি-ছাতু দিয়ে ই সুপ হয়। খ্যাতে তো মন্দ লাগে না।’
ছাতু মানে মাশরুম। মাশরুমের স্যুপ বানিয়েছে চিল্পা। আর সেটা একটু লালচে হলেও রক্তের মতো লাল নয় মোটেও। আতঙ্কে ভুলভাল দেখেছি। একেই বোধহয় হ্যালুসিনেশন বলে। বিব্রত হয়ে বললাম, ‘তুমি এখন যাও। আমি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ব।’
সুপটা দেখলেই যেন বমি আসছে। বাটিটা নামিয়ে রেখে শুয়ে পড়লাম। ক্লান্ত শরীর ঘুমিয়ে পড়তে দেরি হল না। ঘুম ভাঙল খুটখাট শব্দে। শব্দটা বোধহয় জংলি ইঁদুরের। লণ্ঠনের শিখাটা বাড়িয়ে দিতেই আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। আর তখন আবার সেই হুলোটা নজরে পড়ল। ও গুলগাল গুলুগুলু করে নিজস্ব ভাষায় কী যেন বলছে আর মাঝে মাঝেই দরজার দিকে তাকাচ্ছে।
ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। লাঠিটা তুলে নিলাম আবার। তাড়ালাম হতভাগাকে। শুয়ে পড়লাম। কিন্তু চোখ বুজতে না বুজতেই আবার সেই শব্দ। আবার উঠলাম। ঘুম আজ আর হবে না। চিল্পাকে ডাকতে হবে। পারলে ওই কিছু ব্যবস্থা করতে পারবে।
দরজা খুলে বেরোতে গেলাম। বাইরে থেকে বন্ধ। চিল্পার ওপর রাগ হল খুব। চিৎকার করে ডাকলাম, ‘চিল্পা…।’
চিল্পার কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। অগত্যা বিছানায় ফিরে এলাম। ইতিমধ্যে একটা জিনিস আমার চোখে পড়েছে। ঘরটা একটু বেশিই আলোকজ্জ্বল লাগছে। ঘরটাও যেন একটু পাল্টে গেছে। বিছানার সামনে থাকা যে টেবিলটার ওপরে লণ্ঠনটা রাখা ছিল, সেটা দেওয়ালের দিকে সরে গেছে। টেবিলের ওপর সুদৃশ্য কেরোসিন ল্যাম্প। আর তার পাশেই একটা যন্ত্রচালিত পাখা।
এরকম যন্ত্রচালিত পাখা কেরোসিনে চলে। বিদ্যুৎ আসার পূর্বে রাজামহারাজা সাহেবসুবোদের ঘরে এর বেশ কদর ছিল। টেবিল লাগোয়া একটা ড্রেসিং টেবিল। সেই ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দামি পারফিউম, সুগন্ধি পাউডার আর লোশনের বোতল। এছাড়াও রয়েছে মেয়েদের মেকআপের আরও বিভিন্ন উপকরণ। এ কোথায় এসে পড়লাম? মাত্র কয়েকটা মিনিটে সব পাল্টে গেল কীভাবে?
সহসা দরজা খুলে গেল। তোয়ালে জড়িয়ে যিনি ভেতরে এলেন তার শরীর হতে ল্যাভেন্ডারের মিষ্টি সুবাস আসছে। এই নির্জন বনবাংলোয় কে ইনি? চিল্পার আত্মীয় কেউ? না, তা তো হতে পারে না। মেয়েটি ককেসিয়ান। সোনালি চুল আর মোহময় নীল চোখ দেখে তো তাই মনে হয়।
‘এক্সকিউজ মি…।’
আমার ডাকে চমকে উঠল মেয়েটি। গায়ের তোয়ালেটা আরও একটু ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘হু আর ইউ? আপনি কে? আমার ঘরে এলেন কীভাবে? গার্ড… গার্ড…।’
আমার কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই ঘরের মধ্যে আরেকজনের আবির্ভাব হল। খাঁকি পোশাক পরা বন্দুকধারী একটা লোক। ফরেস্টগার্ড। তবে ওর কাঁধের তবকটা আমার পরিচিত নয়। ওতে অশোকচক্র নেই। তা হলে কী…।
গার্ডটি আমাকে বিন্দুমাত্র সময় দিল না, চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল বাইরে। আমি চিৎকার করে ডাকলাম, ‘চিল্পা… চিল্পা…।’
চিল্পা এল না। গার্ড আমাকে পাশের একটা ঘরে ভরে শেকল তুলে দিল। আমার একটা কথাও শুনল না ও। অন্ধকার সেই ঘরে একেবারেই দৃষ্টি চলছে না। হাতড়ে হাতড়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম, ঘরে কী আছে। ঘরটা পুরো ফাঁকা। অগত্যা বসে পড়লাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম সকাল হওয়ার।
কিন্তু কীসের ওপর বসলাম, একটা শক্ত কিছু। ছোট্ট একটা পকেট ডায়েরি বোধহয়। ডায়েরিতে কী আছে আলোর অভাবে পড়া সম্ভব নয়। ডায়েরিটাকে পকেটে রেখে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করতে লাগলাম। ঘুম এল। তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। দরজা খোলার শব্দে চোখ খুললাম। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে এল সেই গার্ড।
গার্ড আমাকে নিয়ে চলল বাংলোর পেছন দিকে। সেদিকে জীর্ণ পরিত্যক্ত একটা গ্রেভইয়ার্ড। গ্রেভইয়ার্ডের ঠিক মাঝামাঝি একটা সমাধিমন্দির। আর সেই সমাধিমন্দিরের মাথার ওপর লেখা একটা নাম– এমিলি জর্জ। নিচে জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ লেখা। সমাধিমন্দিরের সামনে বেদিতে সার দিয়ে উল্টো ক্রসের আকারে মোমবাতি জ্বলছে। এই উল্টো ক্রসের মানে আমি জানি। শয়তান। ঈশ্বরের বিপরীত চিহ্ন।
বেদির সামনে যে লোকটা নতজানু হয়ে বসে আছে, তার পরনে মাথাঢাকা কালো জোব্বা। মুখটাও ঢাকা। সে মোমবাতি ধরে বলছে, ‘হে পরম শয়তান, তুমি আমাদের প্রার্থনা স্বীকার করো। তোমার জন্য আনা বলি গ্রহণ করে আমাদের মালকিনকে তোমার শক্তিতে পরিপূর্ণ করে দাও।’
পেছনে দাঁড়ানো লোকগুলো বলে উঠল, ‘তাই হোক পরম শয়তান, তাই হোক।’
পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে জনা দশেক লোক। ওদের পরনে একই পোশাক। তবে সামনের লোকটার গলায় ঝুলছে যে লকেট, সে লকেট বাকিদের থেকে আলাদা। সামনের লোকটার গলায় লকেটের ক্যাটস আইয়ের চোখ। চোখটা যেন জীবন্ত। বাকিদের গলার লকেটে উজ্জ্বল সবুজ পান্না। আর সেই পান্নার মাঝখানে শয়তানের চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে। ওদের সবার হাতে বিশেষ মুদ্রা। কনিষ্ঠা আর অনামিকা মোড়া অবস্থায়, বৃদ্ধাঙ্গুলি অনামিকার ডগা স্পর্শ করছে। মধ্যমা আর তর্জনী উদ্ধত অবস্থায় বিদ্রোহ ঘোষণা করছে।
আমার যে আজ শেষ দিন, তা আমি বুঝে গেছি। ওরা আমাকেই শয়তানের সামনে বলি দেবে। গার্ডের হাতে একটা সেরামিক্সের পেয়ালা। সেই পেয়ালাখানা আমার সামনে ধরে ও বলল, ‘খেয়ে নাও।’
পেয়ালাটা হাতে নিয়ে নাকের কাছে ধরতেই গা গুলিয়ে গেল। দেশি মদের সাথে কোনও আঁশটে কিছু মেশানো হয়েছে। মুখ বিকৃত করে বললাম, ‘কী এটা?’
‘পানীয়। গলা শুকিয়ে গেছে তোমার। এটা খেলে স্বস্তি পাবে।’
আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম। ও তরল আমি খাব না। কিন্তু কে কার কথা শোনে। জোর করে কিছুটা তরল খাইয়ে দিল। কী বদখত স্বাদ! এরকম কিছু এ জীবনে পান করেছি কি না মনে পড়ছে না।
ইতিমধ্যেই সেই ক্যাটস আইয়ের লকেট পরা দলপতি লোকটা আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গার্ডের উদ্দেশে বলল, ‘ফরেস বাবুকে বেদির কাছে লিয়ে আয়। লগন বয়ে যেছে।’
গলার আওয়াজটা চেনা চেনা লাগল। চিল্পা? তা কীভাবে হয়, ওর মতো সাধারণ একটা লোক… সব হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে। আমাকে নিয়ে চলল বেদির দিকে। আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিনা প্রতিবাদে চলেছি নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার জন্য। ভেতরের একটা সত্ত্বা বলছে পালিয়ে যেতে, কিন্তু পারছি না।
আমাকে চিৎ করে শুইয়ে দেওয়া হল। বেদির মধ্যে কোনও আকর্ষণী ক্ষমতা আছে, তা না হলে আমি শত চেষ্টা সত্ত্বেও উঠে পালাতে পারছি না কেন? মনে হচ্ছে, অদৃশ্য কোনও দড়ি দিয়ে বেদিটার সাথে বাঁধা আছি। দলপতি তার জোব্বার কোমরবন্ধ হতে একটা তীক্ষ্ণ শানিত ছুরি বের করল। আর ঠিক তখনই মেঘ সরিয়ে বেরিয়ে পড়ল পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের আলো ছুরির ওপর পড়ে চকচক করতে লাগল ।
ও এগিয়ে আসছে আমার দিকে। একটু পরেই আমার কণ্ঠনালি ছিন্ন করবে ওই শানিত ছুরির আঘাতে। আমি ভয়ে চোখ বুজলাম। আর ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল মায়ের কথা। কোনও এক গ্রীষ্মের দুপুরের ভাত বেড়ে অপেক্ষা করছেন তিনি। আমি তখন মনের আনন্দে বন্ধুদের সাথে পদ্মবিলে সাঁতার কাটছি । আমাকে ফেলে একা একা খেতেও পারছেন না।
হঠাৎ মায়ের মন চঞ্চল হয়ে উঠল। কোনও অজানা বিপদের আশঙ্কায় ভাত ফেলে ছুটলেন তিনি। আর আমি তখন সাঁতার কাটতে কাটতে পৌঁছে গেছি পুকুরের মাঝখানে সেই জায়গাটাতে, যেখানে গিয়ে ফিরে আসেনি কেউ। একটা অদৃশ্য শক্তি আমাকে জলের গভীরে টানছে। আমি আর পারছি না। আর ঠিক সে সময় মা ঝাঁপ দিলেন জলে। আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুললেন ডাঙায়।
দলপতির ছুরিও আমার গলার একদম কাছে চলে এসেছে। আমি ‘মা’ বলে চিৎকার করে উঠলাম। সহসা অদৃশ্য সব বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল। দলপতির বুকে মারলাম এক লাথি। দলপতি ছিটকে পড়ল। ওর মুখের মুখোশ ততক্ষণে সরে গেছে। চিল্পা!
আর নয়, বেদি হতে উঠেই ছুটতে লাগলাম। আমার পেছনে ওরা ছুটে আসছে। যেভাবেই হোক শয়তানের উদ্দেশে আমাকে উৎসর্গ করবেই। ছাড়বে না। আমার শরীরে তখন অমানুষিক শক্তি, জীবন বাঁচানোর প্রচেষ্টাতেই হয়তো। মৃত্যুর আগে যেমন শরীর অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ করে শেষ চেষ্টা করে, সেভাবেই হয়তো এখন দ্রুতহারে নিঃসরণ হচ্ছে সেই জৈবামৃত।
বেশ কিছুক্ষণ করে দৌড়াই আর উপযুক্ত জায়গা পেলে বিশ্রাম নিই। তারপর দেখি ওই শয়তানগুলো কোথায়। আবার দৌড় দিই। এভাবেই একসময় ওদের নাগালের বাইরে এসে গেলাম। বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও কাউকে দেখতে পেলাম না। শরীরও অবসন্ন হয়ে এসেছে। আর পারছি না। একটা কুসুমগাছের তলায় এলিয়ে দিলাম শরীর।
ঘুম ভাঙল অপরিচিত গলার ডাকে।
‘ও স্যার, ও স্যার…।’
চোখ খুলে দেখলাম আমার সামনে দাঁড়িয়ে একজন ফরেস্ট গার্ড। ওকে দেখেই রাতের বিভীষিকার কথা মনে পড়ে গেল। চারপাশে চেয়ে দেখলাম, আমি শুয়ে আছি একটা স্রোতার পাশে। আমার সামনেই বড় একটা পাথরের গা হতে কলকল করে জল বের হচ্ছে। সেই জল ধারার আকারে চলে যাচ্ছে বনস্থলী ভেদ করে। আর তার ওপারেই একটা বনবাংলো। বনবাংলোটা রাতে দেখা বনবাংলোর মতো নয়। বেশ নতুন। আমার সসেমিরা অবস্থা দেখে গার্ড বলল, ‘আপনি কি নতুন বনবাবু?’
‘হ্যাঁ কিন্তু আমার লাগেজপত্র…।’ বলেই রাতের সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। সব শুনে গার্ড বলল, ‘খুব বাঁচা বেঁচে গেছেন স্যার। ওখানে গেলে কেউ ফিরে আসে না। আর এই ভয়েই অন্ধকার নামলে এ পথে কেউ আসে না স্যার। সে যাইহোক ভগবানের আশীর্বাদে এ যাত্রা বেঁচে গেছেন, এই অনেক।’
বাংলোতে এলাম। বিদায়ী অফিসারের সাথে পরিচয় হ’ল। তিনি আমাকে আস্বস্ত করে বললেন, ‘চিন্তার কোনও কারণ নেই অখিলেশবাবু, আমি ভটকাকে পাঠিয়েছি, ও আপনার লাগেজ নিয়ে আসছে।’
ভটকা বাংলোর কাজের লোক। সে এসব ব্যাপারে তুখোর। পুরোনো অভিজ্ঞতা হতে সে এটা জানে যে, আমি গিয়েছিলাম কোথায় আর আমার লাগেজ কোথায় আছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই লাগেজপত্র নিয়ে এল ভটকা। আর ঠিক তখনই মনে পড়ল রাতে পাওয়া ছোট্ট পকেট ডায়েরিটার কথা। ওটা বের করে বিদায়ী বনবাবুর সামনে রাখলাম।
ডায়েরিটা কোনও এক টিমোথি সাহেবের। তবে সময়ের সাথে সাথে লেখা অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। ধেবড়ে গিয়েছে। একমাত্র নামটা ছাড়া পাঠোদ্ধার করা দায়। বিদায়ী বনবাবু স্মিত হেসে বললেন, ‘হতাশ হওয়ার কিছু নেই। টিমোথি সাহেবের গল্পটা আমি জানি।’
শুরু করলেন টিমোথি সাহেবের গল্প।
সে ব্রিটিশ আমলের কথা, তখন এই বিটের বনবাবু ছিলেন টিমোথি জর্জ। টিমোথি সাহেব ছিলেন যেমন ধর্মপ্রাণ, তেমনই উদার। প্রকৃতির প্রতি ছিল অনাবিল ভালবাসা। আর ঠিক এজন্যই এই বনজঙ্গল ছেড়ে যেতে চাননি কোথাও। টিমোথি সাহেবের মেয়ে এমিলি বাপের ঠিক উল্টো। সে যেমন একগুঁয়ে, তেমনি বদরাগী-হিংস্র। বাপের চোখের আড়ালে শয়তানের পুজো করে সে।
লন্ডনে থাকাকালীনই শয়তানের পূজারিদের সান্নিধ্যে আসে এমিলি। শয়তানের পূজারিদের যিনি প্রধান, সেই ব্লেক ট্যাগার্ট এমিলিকে জানায় ভারতের কথা। ভারতের বনে-পাহাড়ে অসীম শক্তি লুকিয়ে আছে। গরম জায়গায় যেমন আগুন ধরানো সহজ, তেমনই যেখানে শক্তির স্ফুরণ সেখানে শয়তানের উপাসনা সহজ। ব্লেকের পরামর্শেই বাপের কাছে আসে এমিলি। স্থানীয় লোকজনকে হাত করে তৈরি করে গুপ্তচক্র। প্রতি পূর্ণিমার রাতে বসে তাদের গোপন জমায়েত। নরবলি দিয়ে সেই রক্তে করে শয়তানের আহ্বান।
গোপন কথা আর গোপন রইল না। সুরগডিহি আর তার আশপাশের লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। প্রতি পূর্ণিমার আগে হতে একজন করে নিখোঁজ হচ্ছে। হিংস্র পশুর কাজ নয় এ। হিংস্র পশুতে নিয়ে গেলে ওই হতভাগ্যদের দেহ অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায় কীভাবে?
খুঁজে পাওয়া দেহগুলোতে কোনও হিংস্র পশুর দাঁত বা নখের দাগ নেই। পড়ে থাকা দেহ স্পর্শ করেনি কিছুতেই। একমাত্র কণ্ঠনালিতে ধারালো অস্ত্রের আঘাত। আর দেহ রক্তশূন্য। টিমোথি সাহেব ইংল্যান্ডে বড় হয়েছেন, শয়তানি কাল্ট সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা আছে তার। আর এ হতেই বুঝেছেন যে এসবের পেছনে এমন কেউ আছে, যে শয়তানের পুজো করে। ঈশ্বরের নামে শপথ করে টিমোথি বললেন, ‘যে বা যারা এই কাজ করেছে তাদের খুঁজে বের করবই। আর তাদের শাস্তি হবে মৃত্যু।’
নিয়তি কেন বাধ্যতে। আর নিয়তির খেলাতেই মুখোমুখি হল বাপ-মেয়ে। তবে তখন আর কিছু করার ছিল না। সে রাতটা ছিল পূর্ণিমা। আর-পাঁচটা পূর্ণিমার রাতের মতোই সে রাতেও টিমোথি সাহেবের খাবারে মেশানো হয়েছিল ঘুমের উদ্রেক করে এমন জড়িবুটি। বাংলোর পরিচারক চিল্পার অসতর্কতায় জড়িবুটির পরিমাণটা কম হয়ে গিয়েছিল সে রাতে। ঘুম ভেঙে যেতেই উঠে বসলেন সাহেব। পশ্চিমের জানালাটা খোলা আছে। জানালা দিয়ে কবরখানাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জোছনামথিত রাতে মোহময় লাগছে।
কবরখানার নৈঋত কোণে বিশালাকায় প্রাচীন জিঁয়াপুতি গাছ। ওর তলায় মুখঢাকা ওরা কারা? মশাল হাতে কী করছে ওখানে? কৌতূহলী সাহেব এগিয়ে গেলেন জানালার দিকে। মিনিট খানেকের ক্যালকুলেশন, আর তারপরেই বুঝে নিতে অসুবিধা হল, না ওরা ওখানে কী করছে। দেওয়ালে ঝোলানো বন্দুকটা উঠিয়ে নিলেন। আজ হয় এস্পার নয় ওস্পার। এ অন্যায় আর হতে দেবেন না।
সেদিন নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিলেন টিমোথি সাহেব। তবে সকালবেলা যখন দেখলেন ওদের মধ্যেই শুয়ে আছে তার আদরের মেয়ে এমিলি। আর সহ্য করতে পারলেন না। বন্দুকের নলটা নিজের থুতনির নিচে রেখে ট্রিগার দাবলেন।
‘সেই থেকে ওই বনবাংলো পরিত্যক্ত। এরপর বহুবছর পাশের একটা গ্রামে অফিসিয়াল কাজকর্ম হত। বনবাবু থাকতেন কোডার্মায়। আসতেন সপ্তাহে একবার। বছর দশেক হল এই নতুন বাংলোটা তৈরি হয়েছে। ভয়ের কিচ্ছু নেই, তবে ওপাশটা এড়িয়ে চলবেন।’ বলেই উঠে পড়লেন বিদায়ী বনবাবু। কিছু গোছগাছ বাকি আছে তার।
উনি তো ট্রান্সফার নিয়ে বাঁচলেন, আর আমি? আমি পড়লাম এমিলি আর চিল্পার নজরে। ওই কালো বিড়াল, উনিই টিমোথি সাহেব। যার কপালে চিল্পা নামের বিপদ নাচে, তাকে বাঁচানোর সাধ্যমতো চেষ্টা করেন। তবে চিল্পার সঙ্গে পেরে ওঠেন না। চিল্পার প্রেতাত্মা টিমোথি সাহেবের চেয়েও শক্তিশালী।
সময় পাল্টেছে বন্ধু, এখন শিকার পাওয়া অতটা সহজ নয়। তাই ফসকে যাওয়া শিকারকে এখনও নজরে রেখেছে চিল্পা। আগে কেবল পূর্ণিমার রাতে দেখা দিত, এখন সুযোগ হলেই আসে। তারা আমাকে ছাড়বে না, শুধু দরকার সময় ও সুযোগ। বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল অখিলেশ।
সেবারে বেশ কয়েকদিন ছিলাম সুরগডিহিতে। না চিল্পা আর আসেনি। অখিলেশ আর আমি ঘুরে বেড়িয়েছি জঙ্গলের আনাচেকানাচে। ওই পরিত্যক্ত বনবাংলোয় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, যদিও অখিলেশের অনুমতি জোটেনি।
এরপর কেটে গেছে বেশ কতগুলো বছর। আমিও গ্রাম্য হতে শহুরে হয়েছি। তবে গ্রামের খবর রাখি। বছর খানেক আগে অখিলেশের বাড়িতে বিহার সরকারের কিছু অফিসার এসেছিল। এসেছিল অখিলেশের মৃতদেহ নিয়ে। সেই একইভাবে খুন হয়েছে অখিলেশ। গলায় তীক্ষ্ণ কিছু দিয়ে কাটার দাগ আর দেহ রক্তশূন্য।
আমার গল্প এখানেই শেষ হয়ে যেত, যদি না মেট্রোতে ওকে দেখতাম। রবীন্দ্র সরোবর স্টেশনে উঠল লোকটা। অখিলেশের বর্ণনার মতোই চেহারা। অবিকল। তফাৎ শুধু পোশাক-পরিচ্ছদে। পরিচয় হতেই নাম জানা গেল। চিল্পা। কলকাতাতেই থাকেন। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েকে বিয়ে করেছেন বলে আত্মীয়স্বজন সম্পর্ক রাখে না। পরের স্টেশনেই নেমে গেলেন ভদ্রলোক। তাড়াহুড়োয় পকেট হতে রুমালখানা পড়ে গেল। রুমালে দামি ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধ। আর কোনার কাছে ছোট্ট করে লেখা এমিলি।
চিত্রণ: মনিকা সাহা






