বিষকন্যা
কাঁটায় কাঁটায় রাত ন’টা। রাজীবকে বারাসত স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে ভোটের গাড়ি ফিরে গেল।
চারপাশে বেশ ভিড়। রাজীব টিকিটঘরের দিকে চলল। এমন সময় মাইক্রোফোনে ঘোষণা শুনল, প্যান্টোগ্রাফ ভেঙে আপ বনগাঁ লোকাল বিরাটি স্টেশনে দাঁড়িয়ে। বনগাঁয় কোনও রেক না থাকায় ডাউন ট্রেনও আসবে না।
এখন কী করবে রাজীব? ওর বাড়ি বনগাঁয়। রাজীব মোবাইলটা অন করে টাইম দেখল। প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। একেই ভোটের দিন, এই সময় যানবাহন পাওয়া অসম্ভব। ভোটের কাজে সব হুকুম-দখল হয়ে গেছে। রাতটা কাটানোর জন্য হোটেলের খোঁজ করতে করতে তিন রাস্তার মোড়ে পৌঁছে গেল রাজীব। রাস্তায় মানুষজন সামান্যই। যান-বাহন আরও কম। অন্য সময় এইসব জায়গা ঝলমল করে। দোকানপাট সবই প্রায় বন্ধ। দু’-একটা চায়ের দোকান খুলেছে মাত্র।
রাজীব খুবই সমস্যায় পড়ল। বড় রাস্তার ওপর ওষুধের দোকানগুলো খোলা রয়েছে দেখে। হোটেলের খোঁজ করতে যাবে বলে দোকানগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে মেয়েলি কণ্ঠের ডাক, ‘আরে রাজীব না!’
বহুদিনের পরিচিত গলা পেয়ে রাজীব ফিরে তাকাতে নজরে এল, তৃণা! হ্যাঁ, তৃণাই তো! ওষুধের দোকান থেকে বেরিয়ে আসার সময় তাকে দেখতে পেয়েছে।
বহুদিন পর দু’জনে মুখোমুখি। তৃণার নিতম্বস্পর্শী বেণী আজ আর নেই। কপালের ওপর পড়া উড়ো চুলগুলোও আজ উধাও। এখন বয়-কাট চুল। দিঘির টলটলে জলের মতো মুখের ঢলঢল লাবণ্যও মুছে নিয়েছে সময়। বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঘাম লেগে আছে সারা মুখে।
খঞ্জন-চোখের দৃষ্টিতে একরাশ খুশির আলো ছিটিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিল তৃণা, ‘তুমি এখানে?’
‘ভোটের ডিউটি সেরে ফিরছি। ট্রেন বন্ধ। যান-বাহন নেই ফেরার মতো। অগত্যা হোটেলের…।’
‘আমার ফ্ল্যাট থাকতে তুমি হোটেলে থাকবে কেন?’
‘তোমার অসুবিধা হবে না?’ দ্বিধাগ্রস্ত রাজীব।
‘আমার আবার অসুবিধা কী! চলো, কাছেই কলোনি মোড়ে আমার ফ্ল্যাট।’ আন্তরিকভাবেই বলল তৃণা।
কলোনির মোড় থেকে যে রাস্তাটা পশ্চিম দিক বরাবর চলে গেছে, একটু এগিয়েই দোতালায় মাঝারি মাপের ফ্ল্যাট। পাশাপাশি দুটো বেডরুম। মুখোমুখি কিচেন আর টয়লেট। মাঝে ড্রয়িং কাম ডাইনিং। একটা ঝুলবারান্দাও নজরে এল।
রাজীবকে একটা ঘরে নিয়ে এল তৃণা। আলো জ্বালাল। পাখা চালাল।
লেমন-ইয়েলো রঙের দেওয়াল। উত্তরের দেয়ালে ভ্যান গঘের সূর্যমুখীর প্রিন্ট। দক্ষিণের দেয়ালে হুসেনের ধাবমান অশ্ব। ফ্লোরাল টাইলসে ঢাকা মেঝে। কোথাও একফোঁটা মলিনতা নেই। দক্ষিণে জানালা-ঘেঁষে একটা ইংলিশ খাট। খাদির বেড-কভার দিয়ে ঢাকা পুরু বিছানা। মাথার কাছে মেহগনি কাঠের ছোট টেবিল। সেখানে কাচের বাটিতে জলে রাখা একমুঠো বেলিফুল।
খাটে বসল রাজীব। চিন্তামুক্ত আরামসূচক ছোট্ট শব্দটি বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে, ‘আঃ!’
‘একটু রেস্ট নিয়ে নাও। আমি চেঞ্জ করে আসি। ও ভালকথা স্নান করবে তো?’
‘অবশ্যই, যা ভ্যাপসা গরম!’
‘চেঞ্জ করবার কিছু আছে?’
‘যা আছে, সেগুলো গায়ে তুলতে ইচ্ছে করছে না?’
‘দেখছি, ছোট্টুর দু’একটা পাজামা-পাঞ্জাবি ওয়ার্ডরোবে থাকলেও থাকতে পারে।’
‘ছোট্টু!’ রাজীবের কৌতূহলী প্রশ্ন।
‘আমার ছেলের ডাকনাম। ওরই ঘর এটা।’
‘দেখছি না তো তাকে!’
‘ও বেঙ্গালুরুতে থাকে।’ তৃণার কণ্ঠস্বরে বিষন্নতার আঁচ, ‘হোটেল ম্যানেজমেন্ট করে তাজ গ্রুপে জয়েন করেছে।’
‘তুমি একা থাকো?’
‘ভয় পেলে নাকি?’ তৃণার অধরে কেমন রহস্যের হাসি।
তৃণা চেঞ্জ করতে গেল। রাজীব মোবাইলে দিয়াকে ধরে রাতে ফিরতে না পারার খবরটা জানিয়ে দিল।
তৃণা ফিরে এল একটু পরেই। পায়জামা-পাঞ্জাবি বিছানায় নামিয়ে রেখে বলল, ‘যাও স্নানটা সেরে এসো।
রাজীব স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে পোশাক বদল করে ঘরে ফিরল।
স্নান করে শরীরটা ছেড়ে দিয়েছিল রাজীবের। কতক্ষণ চোখ বুজে শুয়েছিল খেয়াল নেই। একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে আসায় চোখ খুলল। সামনে দাঁড়িয়ে তৃণা। স্নান সেরে সামান্য প্রসাধনও করেছে। বাসন্তী রঙের শাড়ির সঙ্গে কচি কলাপাতা রঙের ব্লাউজে তৃণাকে কেমন রহস্যময়ীর মতো লাগছে।
রাজীব উঠে বসল। তৃণা একটু দূরত্ব রেখে বসল।
‘এখনও কবিতা লেখো?’
‘নাঃ!’ সংক্ষিপ্ততম উত্তর।
‘ভালই তো লিখতে। লেখা ছাড়লে কেন?’
‘আমি আর ছাড়লাম কই। সেই আমাকে ছেড়ে গেল যে।’ রাজীব বিমর্ষভাবে উত্তর দিল। ‘অনিকে তুমি বিয়ে করার পর, আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।’
‘অনির মৃত্যুর খবরটা তুমি তো পেয়েছিলে রাজীব, একবারের জন্য এলে না কেন?’ তৃণার গলায় অভিযোগের সুর।
‘সাহস হয়নি তৃণা, তোমার সামনে দাঁড়াবার সাহস হয়নি।’ তৃণার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘কী সান্ত্বনা দিতাম!’
দু’জনেই নীরব। অনেকগুলো নীরব মুহূর্ত অতিক্রান্ত হবার পর তৃণা বলল, ‘চলো, খেয়ে নেবে।’
‘তোমার খাবারে ভাগ বসাব?’ হালকাভাবেই কথাটা বলল রাজীব।
‘আর কিছুর ভাগ তো নিলে না।’ তৃণার সপ্রতিভ উত্তর, ‘না হয় খাবারের ভাগই নিলে।’
ডাইনিংয়ে এল দু’জনে। রাতের খাওয়া শেষ হল।
রাজীব ফিরল নির্দিষ্ট ঘরে। রাতবাতি জ্বালাল। নরম নীলাভ আলো। গ্রীষ্মের গুমোট কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে বাতাস আসছে দক্ষিণের জানলা দিয়ে। নাম না-জানা একটি পাখি খ্যাঁ খ্যাঁ করে ডেকে জানালার পাশ থেকে উড়ে গেল।
এমন সময় তৃণা ঘরে ঢুকল। হাতে কাচের গ্লাসে জল, গেলাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে তৃণা হাসল, ‘এখনও ঘুমোওনি!’
‘নতুন জায়গায় ঘুম আসতে চায় না।’
‘ঘুমের ট্যাবলেট নেবে একটা?’
‘নাঃ থাক।’
রাজীব তাকিয়ে আছে তৃণার দিকে, লেসের কাজ করা দুধ-সাদা চিকনের ফিনফিনে রাতপোশাকে তৃণা যেন রাতপরী।
‘কী দেখছ?’ ফিসফিসিয়ে উঠল তৃণা।
‘তোমাকে!’ মুগ্ধতা গোপন করল না রাজীব।
‘আগে দেখোনি?’ লজ্জায় আরক্ত তৃণা মুখ নিচু করল।
‘এমনভাবে তো দেখিনি!’ সরল স্বীকারোক্তি রাজীবের।
রাতের নির্জনতায় দূর-অতীতের প্রেমিক এক পুরুষের বিমুগ্ধ দৃষ্টির আরতিতে তৃণার দেহের আনাচ-কানাচে অবিরাম ঘণ্টাধ্বনি। হুঁশ হারাল তৃণা। আগ্রাসী আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলল রাজীবকে।
রাজীবের মনের আয়নায় ভেসে উঠল স্ত্রী দিয়ার সরল মুখটা। তৃণাকে প্রতিহত করার আপ্রাণ চেষ্টা করল রাজীব। পারল না। একেই প্রাক্তন প্রেমিকা, তার শরীরের প্রতি একান্ত গভীর আকর্ষণ যে ছিল না তা তো নয়। সেই তৃণার বুকের নরম রেশম স্পর্শে প্রতিরোধের প্রাচীর ভেঙে খান খান হয়ে গেল। বুভুক্ষু নারীর দুর্বার কামনার কাছে হার মানতে হল রাজীবকে। ওর পৌরুষকে নিঃশেষ করে তৃপ্ত হল তৃণা।
দুধসাদা চিকনের রাতপোশাকটা কোনওমতে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে প্রায় ছুটেই ঘর ছাড়ল তৃণা।
বাইরের ছোট্ট ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়াল। দেওয়ালে হেলান দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে অস্ফুট উচ্চারণ করল, ‘ছিঃ ছিঃ, এ কী হল!’ তৃণা তো এমনটা চায়নি। এক রাতের আশ্রিতের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। খুন করল তাকে! এটা তো খুনই। তৃণা তো বিষকন্যা! এলাইজা টেস্টে এইচআইভি পজিটিভ।
তৃণার ভেতরের ভূমিকম্পের ঘূর্ণিপাক। অনিবার্য পতনের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার তাগিদে ব্যালকনির রেলিং চেপে ধরল সে। অবিশ্রান্ত জলধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল দু’চোখ বেয়ে। অনিরুদ্ধের মৃত্যুর পরও এমন বুকভাঙা কান্না কাঁদেনি সে।
চিত্রণ: বাপ্পাদিত্য জানা






